নির্বাচন কেন্দ্রিক সংঘাত বন্ধে আরো কার্যকর উদ্যোগ চাই

64

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে আকাক্সক্ষা দেশের মানুষ এখনও পোষণ করে তা হল, সংঘাতমুক্ত উৎসবমুখর পরিবেশে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। কিন্তু নির্বাচন যতই সামনের দিকে এগুচ্ছে সংঘাত, সংঘর্ষ তত বাড়ছে, ফলে নির্বাচনের স্বাভাবিক চিত্র যেমন হওয়া উচিত, অনেক স্থানেই তার উপস্থিত নেই বললেই চলে। আমাদের দেশে অতীত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নির্বাচনী উত্তাপের সঙ্গে উত্তেজনার যে সংমিশ্রণ দেখা যেত, ধারণা করা হয়েছিল এবার উত্তাপ থাকবে বটে উত্তেজনা থাকবেনা, কিন্তু এ ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হল। আশা করা হয়েছিল, সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা মাঠে নামলে হয়ত, উত্তেজনা অনেকটা কমে আসবে, অবস্থা দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, তাও সম্ভব নয়। এরপরও আমরা আশাবাদী শেষ পর্যন্ত একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর জন্য নির্বাচন কমিশনসহ সকল রাজনৈতিক দলকে আরো কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
আমরা এতদিন ছোটছাট হামলাগুলোকে হজম করে শান্তির প্রত্যাশা করলেও যখন দেখি সেই ২০১৩-১৪ এর পেট্রোলবোমা আবারও মানুষের গায়ে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, তখন শঙ্কার ডালপালা ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। সংবাদপত্রে ছবিসহ প্রকাশিত হয়েছে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে নৌকার প্রার্থীর ভোটের প্রচার লক্ষ্য করে ছোড়া পেট্রলবোমায় তিনজন দগ্ধ হয়েছেন। চকরিয়ায় নৌকার প্রার্থীর ক্যাম্পে, ফটিকছড়িতে মোমবাতি প্রতীকের প্রচারণায়, পটিয়ায় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীসহ চট্টগ্রামের বাইরে ঢাকার নবাবগঞ্জের একটি গেস্ট হাউসে সাংবাদিকদের ওপর, ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী গায়েশ্বর রায়সহ ল²ীপুর, শরীয়তপুর, মুন্সীগঞ্জ ও শেরপুরে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা প্রতিপক্ষের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর এসেছে গণমাধ্যমে। এসব হামলায় প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীর সমর্থকদের বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তির খবর পাওয়া গেছে। সীতাকুন্ডোয় নৌকার পক্ষে প্রচারণার সময় পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হওয়া দুজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানা গেছে। এভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকেই নির্বাচনী প্রচার মিছিল বা ক্যাম্পে হামলা, গণসংযোগে বাধা, প্রার্থী বা সমর্থকদের গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের সমর্থকদের গ্রেপ্তার করার খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যেখানে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেশবাসীর প্রত্যাশা, সেখানে এ ধরনের ঘটনা মানুষের কাছে নেতিবাচক বার্তা নিয়ে যাবে। আমরা আগেও বলেছি, বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে তীক্ষ দৃষ্টি রেখেছে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ও। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশটিও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে বলে আশা করছে। এই নির্বাচনটি বাংলাদেশের মতোই যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে দেশটি। জাতিসংঘও একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহবান জানিয়েছে। নির্বাচনের দিনটি যতই এগিয়ে আসবে, উত্তাপ-উত্তেজনা ততই বাড়বে। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে দেওয়া যাবে না। দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখার আহবান জানালে কোনো কর্মী-সমর্থকই সংঘাত-সংঘর্ষে জড়াবে না। কোন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে অতি উৎসাহি কর্মী-সমর্থকদের কোনো অংশ অনাকাক্সিক্ষত কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি করলে তাদের বিরুদ্ধে দল থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সবারই মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের সময় সুযোগ সন্ধানী গোষ্ঠী ব্যবহৃত হওয়ার জন্য তৈরি থাকে। সম্প্রতি পোশাক শিল্পে এমনটি ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পেশিশক্তির ব্যবহার যে হয়ে থাকে, তা অস্বীকার করা যাবে না। একই সঙ্গে অস্বীকার করা যাবে না যে, জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা এ সুযোগ ব্যবহার করে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির পায়তারায় লিপ্ত হবে। আর সে কারণেই রাজনৈতিক দলগুলোকে সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে হবে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে যখন সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে, তখনই সৌহার্দ্য ও স¤প্রীতির দৃষ্টান্তও কম সৃষ্টি হচ্ছে না। যেমন চট্টগ্রাম মহানগরীর তিনটিসহ জেলার ৮টি নির্বাচনী এলাকার সব কয়টিতেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ প্রতিদ্ব›দ্বী দলগুলো নেতাকর্মী-সমর্থকরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে রয়েছে। একই অবস্থা সিলেটেও দেখা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, আহত গায়েশ্বর রায়কে দেখতে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীর গয়েশ্বরের অফিসে যাওয়া, সিলেটে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী একে অপরকে ক্রিস্টমাসের কেক খাইয়ে দেয়ার ঘটনাসহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রতিদ্ব›দ্বী দলের নেতাকর্মীরা একে অন্যের সঙ্গে খোশগল্প ও নানা বিষয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলাপ-আলোচনা করছেন বলে প্রাপ্ত খবরে জানা যাচ্ছে। বাস্তবে নির্বাচনী মাঠের চিত্র এমনটিই হওয়া জরুরি। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকবে, কিন্তু তা যেন কোনভাবেই সংঘাতে রূপ না নেয়-সেই উদ্যোগ রাজনৈতিক দলগুলোকেই নিতে হবে।