নির্বাচনী সভায় যাওয়ায় হামলা, আহত ৯

138

সাতকানিয়ায় উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যান প্রার্থীর মতবিনিময় সভায় যাওয়ার অপরাধে শ্রমিক লীগের এক নেতাকে মরধর ও লাঠিপেটা করেছে ধর্মপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা এম ইলিয়াছ চৌধুরী। শুধু তাই নয়, চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে হামলা চালিয়ে কয়েকটি বসত ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়েছে। মারধর করা হয়েছে ধর্মপুর দরবার শরীফের কয়েকজন মুরিদ ও ছাত্রদের। এসব ঘটনায় বৃদ্ধা ও ছাত্রসহ ৯ জন আহত হয়েছেন। ঘটনার আকস্মিকতায় বিক্ষুব্ধ জনতা ও ধর্মপুর দরবার শরীফের ভক্তরা ইউপি চেয়ারম্যান ইলিয়াছ চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পরে পুলিশের আশ্বাসে বিক্ষোভ স্থগিত করা হয়। ঘটনার প্রেক্ষাপটে এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টা থেকে রাত সাড়ে ৩টা পর্যন্ত সময়ে উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নে এসব ঘটনা ঘটে। গতকাল শুক্রবার সারাদিনও এলাকায় একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও অর্ধ শতাধিক পুলিশ মোতায়েন ছিল। এ ঘটনায় আহতরা হলেন মো. ইদ্রিচ (৩৫), তার মা রশিদা বেগম (৬০), ধর্মপুর ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক মো. মাসুদ (৩২), মো. ফারুক (৩৩), হেফজখানার ছাত্র রবিউল হোসেন (১৩), মো. জাহেদ (২৬), মো. রুবেল (১৭), তারেক মাহমুদ বাপ্পি (৩০) ও সাইদুল মুনির আরিফ (৩০)।
ঘটনার খবর পেয়ে গতকাল চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোসলেম উদ্দিন আহমদ, সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, আওয়ামী লীগ মনোনীত উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী এম এ মোতালেবসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সাতকানিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
পুলিশ ও এলাকাবাসী জানিয়েছে, সাতকানিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্ব›দ্বী ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সালাহ উদ্দিন হাসান চৌধুরীর সমর্থনে বৃহস্পতিবার বিকালে সাতকানিয়া পৌর এলাকায় মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর বড় ভাই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মঈন উদ্দিন হাসান চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। সভায় ধর্মপুর দরবার শরীফের মুরিদ, ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের প্রচার সম্পাদক ও ধর্মপুর ফকির পাড়ার আবু তাহেরের ছেলে মো. ইদ্রিচ অংশ নেয়। পরে সন্ধ্যার দিকে ইদ্রিচ তার বাড়ির নিকটবর্তী ঈশ্বর বাবুর হাটে (বিশ্বহাট) যায়। সেখানে ইউপি চেয়ারম্যান এম ইলিয়াছ চৌধুরী শ্রমিক লীগ নেতা ইদ্রিচকে পেয়ে তাকে না জানিয়ে ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সালাহ উদ্দিন হাসান চৌধুরীর মতবিনিময় সভায় কেন গেলেন তা জানতে চান। তখন চেয়ারম্যান ইলিয়াছের সাথে ইদ্রিচের কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে চেয়ারম্যান ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে কিল ঘুষি ও লাঠিপেটা করে কিছুক্ষণ আটকে রাখে।
এসময় চেয়ারম্যানের সাথে ধর্মপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মো. ফোরকান, সাধারণ সম্পাদক তছলিম উদ্দিন ও সহ-সভাপতি ওয়াহাব মিয়াসহ বিএনপি এবং এলডিপির কিছু নেতাও উপস্থিত ছিলেন। ইদ্রিচকে মারধর করে আটকে রাখার খবর পেয়ে ধর্মপুর ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক ও দরবার শরীফের মুরিদ মো. মাসুদ ও সাইদুল মুনির আরিফের নেতৃত্বে ১০-১২ জনের দল তাকে উদ্ধার করার জন্য ঈশ্বর বাবুর হাটের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এরইমধ্যে চেয়ারম্যান ও তার লোকজন আহত অবস্থায় ইদ্রিচকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু ঈশ্বর বাবুর হাটের দিকে মাসুদ ও আরিফের নেতৃত্বে লোকজন যাওয়ার খবর পেয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে চেয়ারম্যান ইলিয়াছ শতাধিক লোক জড়ো করে। পরে চেয়ারম্যানের লোকজনের সাথে ফকির পাড়ার বাসিন্দা ও ধর্মপুর দরবার শরীফের মুরিদদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলে। এক পর্যায়ে চেয়ারম্যান ইলিয়াছ, বিএনপি নেতা ফোরকান, ওয়াহাব মিয়া ও তছলিমের নেতৃত্বে শতাধিক লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে ফকির পাড়া এলাকায় ইদ্রিচের বসত ঘর ও কয়েকটি দোকানে ভাঙচুর চালায়। এসময় হামলাকারীরা ধর্মপুর দরবার শরীফের বেশ কয়েকজন মুরিদ ও ছাত্রকে মারধর করে। পরে তারা সেখান থেকে চলে যাওয়ার সময় পাজের পাড়া এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জব্বার তালুকদার, আবু ছিদ্দিক তালুকদার, হারুন ও আইয়ুবের বসত ঘর ও আকতার হোসেন এবং মো. সুমনের দোকানে হামলা চালায়।
জানা যায়, দরবার শরীফের মুরিদ ও ছাত্র আহত হওয়ার ঘটনার পর দরবার শরীফে হামলার গুজব রটে যায়। এসময় পটিয়ার খরনায় একটি মাহ্ফিলে অবস্থানরত ধর্মপুর দরবার শরীফের পীর আল্লামা কাযী সৈয়্যদ মোহাম্মদ আবদুস শকুর রায়হান আযিযী নক্শবন্দী মোজাদ্দেদী (মা.জি.আ.) হামলার খবর পেয়ে দরবারের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এসময় পীরের সাথে কয়েক শতাধিক মুরিদও দরবার শরীফ এলাকায় চলে আসেন। তখন ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ও দরবারের মুরিদগণ মিলিত হয়ে চেয়ারম্যানকে খুঁজতে থাকে। খবর পেয়ে সাতকানিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান মোল্যা ও থানার ওসি মো. সফিউর কবীরের নেতৃত্বে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালায়। এরমধ্যে বিক্ষুব্ধরা চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে পুলিশ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিলে বিক্ষোভকারীরা চলে যায়। এরপর থেকে ফের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ধর্মপুর দরবার শরীফ এলাকায় সাতকানিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর তঞ্চঙ্গ্যা এবং বিপুল সংখ্যক পুলিশ অবস্থান নেয়। গতকাল সারা দিন দরবার শরীফ এলাকায় পুলিশ মোতায়েন ছিল।
ধর্মপুর দরবার শরীফের পীর হযরতুলহাজ্ব আল্লামা কাযী সৈয়্যদ মোহাম্মদ আবদুস শকুর রায়হান আযিযী নক্শবন্দী মোজাদ্দেদী (মা.জি.আ.) জানান, ঘটনার দিন আমি খরনায় একটি মাহ্ফিলে ছিলাম। তখন হঠাৎ খবর পেলাম চেয়ারম্যান ইলিয়াছের নেতৃত্বে লোকজন দরবার শরীফে আক্রমন চালাচ্ছে। আমার মুরিদ ও হেফজখানার ছাত্রদের মারধর করছে। আমি ঘটনার সত্যতা যাচাই করার পর দরবার শরীফের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। এরইমধ্যে খবর পেয়ে আমার অনেক মুরিদও দরবার শরীফ এলাকায় চলে আসে। আমার মুরিদরা আসার খবর পেয়ে চেয়ারম্যান ইলিয়াছ ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। তবে এর আগে তারা আমার কয়েজন মুরিদকে মারধর ও তাদের বসত ঘরে হামলা চালিয়েছে।
ধর্মপুর ইউপি চেয়ারম্যান এম ইলিয়াছ চৌধুরী জানান, ইদ্রিচকে আমি মারধর করিনি। সে নেশাগ্রস্ত ছেলে। তাকে নৌকার প্রার্থীর ক্ষতি হয় এমন কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার জন্য বলেছি। দরবার শরীফের কোনো মুরিদের সাথে আমার কোনো ঝামেলা হয়নি। বসত ঘর ও দোকান ভাঙচুরের যে অভিযোগ আনা হচ্ছে তা পুরোটাই মিথ্যা। আমি নই, কোনো চেয়ারম্যান-মেম্বার এ ধরনের কাজ করবে না। আর ঘটনার দিন দরবার শরীফ এলাকায় আমি এবং আমার কোনো লোক যাইনি।
তাকে গ্রেপ্তারের দাবিতে এলাকায় বিক্ষোভ প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান জানান, এ ধরনের কোনো বিষয় আমার জানা নাই। মূলত নৌকার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা আমার বিরুদ্ধে এরকম অপপ্রচার চালাচ্ছে। বিএনপি এবং এলডিপির লোকজন নৌকার পক্ষে কাজ করায় কিছু লোক সহ্য করতে পারছে না। তাই এরকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তিনি আরো জানান, এলাকার কিছু উচ্ছৃঙ্খল লোকজন আমার কয়েকজন লোকের উপর হামলা করেছে। ভাঙচুর করেছে বিএনপি নেতা তছলিমের বাড়ির গেইট। এখন উল্টো আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে।
সাতকানিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান মোল্যা জানান, চেয়ারম্যান ও তার লোকজন মিলে ইদ্রিচ নামের এক লোককে মারধর করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মূলত ঝামেলা হয়েছে। এসময় দরবার শরীফের মুরিদসহ কয়েকজন লোক আহত হয়েছে। তবে দরবার শরীফের কোথাও হামলা বা ভাঙচুর করার ঘটনা ঘটেনি। ঘটনার পর থেকে গতকাল সারা দিন ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন ছিল।