নির্বাচনী ডামাডোলের সুযোগে তৎপর চোরাকারবারীচক্র

40

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিসহ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যের ব্যস্ততার সুযোগ কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি চক্র। ফলে, সীমান্ত পথ ও বিমানবন্দর দিয়ে হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে চোরাচালান। বিশেষ করে, স্বর্ণের বারের পাশাপাশি মাদক ও অস্ত্রের চোরাচালান বেড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। চলতি মাসে উপর্যুপরি চোরাই স্বর্ণ ও মাদকের কয়েকটি চালান আটকের ঘটনাও হঠাৎ চোরাচালান বেড়ে যাওয়ার ধারণাকে সঠিক হওয়ার ক্ষেত্রে রসদ জোগাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণের চোরাচালান হঠাৎ করে আবার বেড়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ছেড়ে আসা বিভিন্ন ফ্লাইটে করে চোরাচালান চক্রের সদস্যরা স্বর্ণের বার নিয়ে আসছে বিমানবন্দরে। এর মধ্যে কয়েকটি চালান আটক হলেও নজরদারি সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে গেছে তার চেয়ে বেশি। কেননা, বিমানবন্দরে নিয়োজিত সিভিল এভিয়েশনসহ অন্যান্য সংস্থাগুলোর কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারির চোরাকারবারি চক্রের সংশ্রব রয়েছে। তাদের সহায়তায় বিমানবন্দর পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে অবৈধ স্বর্ণের চালান। এর মধ্যে প্রায় ৮০ লাখ টাকা মূল্যের ১৬টি স্বর্ণের বারসহ শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়োজিত সিভিল এভিয়েশন বিভাগের এক কর্মচারিকে গ্রেপ্তারও করেছে পতেঙ্গা থানা পুলিশ। অস্ত্র ও ইয়াবাসহ ডিবি পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে একজন আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারি। যিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী সাইফুল করিমের পার্টনার বলে ডিবি দাবি করেছে।
প্রসঙ্গত, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) গত বছরের শেষদিকে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, বাংলাদেশে বছরে ৪০ মেট্রিক টন স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ৩৬ মেট্রিক টনই আমদানি করতে হয়। ২০১৭ সাল পর্যন্ত পূর্ববর্তী চার বছরে দেশের বিমানবন্দরগুলোতে দেড় হাজার কেজিরও বেশি পরিমাণ অবৈধ স্বর্ণ আটক করা হয়েছে। যা থেকে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ ব্যবহারকারী দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে প্রতিবেশি দেশ ভারত। আর ভারতে স্বর্ণ চোরচালানের গুরুত্বপূর্ণ রুট বলা হয় বাংলাদেশকে।
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক পূর্বদেশকে বলেন, ‘নির্বাচন সামনে রেখে বিভাগীয় আইন-শৃংখলা কমিটির বৈঠকে আমরা গত নভেম্বরেই সীমান্তে সতর্কতা বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলাম। তাই চোরাকারবারিরা তাদের অপতৎপরতা বাড়ালেও খুব একটা সুবিধা করতে পেরেছে বলে মনে হয়না। কারণ, আমাদের নজরদারি এড়িয়ে নির্বিঘ্নে চোলাচালান আসলে সম্ভব নয়।’
শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়োজিত শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, চলতি মাসের গত এক পক্ষকালে বিমানবন্দরে অবৈধভাবে নিয়ে আসা স্বর্ণের কয়েকটি চালান আটক করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে স্বর্ণ বহনকারীকে। সর্বশেষ গত ২১ ডিসেম্বর সকালে ওমান থেকে রিজেন্ট এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে করে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসা জাহিদুল ইসলাম নামে এক যাত্রীর লাগেজ তল্লাশি করে প্রায় এক কেজি স্বর্ণ জব্দ করে কাস্টম’স কর্মকর্তারা। জাহিদুল সুকৌশলে একটি হামানদিস্তার (পেশাই করার যন্ত্র) ভেতরে করে স্বর্ণগুলো আনেন। লাগেজ স্ক্যানিংয়ের সময় এটির অস্তিত্ব ধরা পড়ে। এরপর যাত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ওই হামানদিস্তা ভাঙা হয়। সেখানেই স্বর্ণগুলো পাওয়া যায়। এ ঘটনায় পতেঙ্গা থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে বিমানবন্দর সড়কের ১৫ নম্বর ঘাট এলাকা থেকে পতেঙ্গা থানা পুলিশ অবৈধ পথে নিয়ে আসা প্রায় ৮০ লাখ টাকা মূল্যের ১৬টি স্বর্ণের বারসহ শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়োজিত সিভিল এভিয়েশন বিভাগের কর্মচারি মো. আকরাম হোসেনকে (২৮) গ্রেপ্তার করে। তিনি বিমানবন্দরের সিভিল এভিয়েশন বিভাগে ট্রাফিক হ্যান্ড পদে কর্মরত। পুলিশের ধারণা, সিভিল এভিয়েশন বিভাগের কর্মী আকরাম আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের হয়ে বিমানবন্দর থেকে এসব অবৈধ স্বর্ণের বার নজরদারি সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলেন। পরদিন তার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে পতেঙ্গা থানায় মামলা করেছে পুলিশ। এরপর তাকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হলে বিচারক কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন। জব্দকৃত স্বর্ণের বারের ওজন এক কেজি আটশ ৬৬ গ্রাম। যার বাজারমূল্য প্রায় ৮০ লাখ টাকা। আকরামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার কোতোয়ালী থানার রসুলপুর গ্রামে। তার বাবার নাম মো. আমিন মিয়া। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া, বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে। গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিন সকাল সাড়ে দশটায় দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের বিজি-১৪৮ ফ্লাইট থেকে এক কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল্যের চার কেজি দুইশ ৫৬ গ্রাম স্বর্ণসহ মো. শওকত আকবর নামে এক যাত্রীকে গ্রেপ্তার করে কাস্টমস কর্মকর্তারা। তার পাসপোর্ট নং- বিআর ০৩৯২৩৪৭। স্বর্ণগুলো শওকতের ব্যাগের ভেতর ব্লেন্ডার মেশিনসহ বিভিন্ন পণ্যের ভেতর লুকানো ছিল। এর মধ্যে ফুড ব্লেন্ডার মেশিনের মোটর খুলে তিন কেজি চারশ ৪০ গ্রম সিলভার প্রলেপযুক্ত গোল আকৃতির স্বর্ণ পাওয়া যায়। এছাড়া, খেলনা পিয়ানো ও ডিভিডি প্লেয়ারের অ্যাডাপ্টারের ভেতর থেকে সিলভার প্রলেপযুক্ত সাতশ গ্রাম স্বর্ণ এবং যাত্রীর ব্যবহৃত মোবাইল সেট থেকে একটি স্বর্ণবার জব্দ করা হয়।
এদিকে, গত ১৪ ডিসেম্বর ভোরে নগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ফিরিঙ্গীবাজার এলাকা থেকে পাঁচ হাজার ইয়াবা, একটি একনলা বন্দুক ও দুই রাউন্ড গুলিসহ মো. সাব্বির ওরফে বার্মা সাব্বিরকে গ্রেপ্তার করে। ডিবি পুলিশ দাবি করেছে, গ্রেপ্তার হওয়া বার্মা সাব্বির মিয়ানমার থেকে সরাসরি ইয়াবা এনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহের পাশাপাশি জাহাঙ্গীর নামে এক ইয়াবা ব্যবসায়ীর মাধ্যমে ভারতেও পাচার করতেন। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী সাইফুল করিমের নেতৃত্বাধীন ইয়াবা সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য। মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর কয়েকদিন পর সাইফুল নজরদারি সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশ ত্যাগে সক্ষম হয়।