নিত্য বৈরী আবহাওয়া দুর্যোগেও নতুন মাত্রা

144

সময় ও কালের ব্যবধানে আবহাওয়ার বৈরী আচরণ কিংবা খেয়ালীপনা দেশের মানুষের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে ধরা দিচ্ছে। বর্ষায় অতিবৃষ্টি, বন্যা ও জলাবদ্ধতা এবং শুল্ক মৌসুমে অনাবৃষ্টি ও অত্যধিক খরা, কালবৈশাখী মৌসুমে অস্বাভাবিক শিলাবৃষ্টি, ভূমিক্ষয়, টর্নেডা, সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় বজ্রপাতের মত বিষয়ও নতুন করে ঠাঁই নিয়েছে। ক্রমেই সহনীয় মাত্রা ছাড়াতে চাইছে তাপদাহ। এভাবেই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকিও।
আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতিতে বিরাজমান এমন পরিস্থিতিকে সঙ্গে নিয়েই আজ ২৩ মার্চ পালিত হচ্ছে বিশ্ব আবহাওয়া দিবস। প্রতিবছর বাংলাদেশসহ বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার ১৯৩টি সদস্য দেশ ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল দিনটি পালন করে আসছে। বিশ্ব আবহাওয়া দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘সূর্য, পৃথিবী ও আবহাওয়া’।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এর বরাত দিয়ে বাসস জানিয়েছে, পৃথিবীর প্রাকৃতিক শক্তির ভারসাম্য রক্ষা, আবহাওয়া, জলবায়ু এবং একইসঙ্গে পৃথিবীর পানিচক্র ও জলবায়ু ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে সূর্য ও পৃথিবীর মিথস্ক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ কারণে আবহাওয়া দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘সূর্য, পৃথিবী ও আবহাওয়া’ বিশ্বের আবহাওয়া ও জলবায়ুর ওপর সূর্য ও পৃথিবীর যৌথ প্রভাব সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে আবহাওয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও প্রামাণ্য চিত্র নিয়ে জনসাধারণের জন্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন এ বিষয়ে বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান স¤প্রচার করছে। এছাড়া ঢাকা, কক্সবাজার, খেপুপাড়া, রংপুর ও মৌলভীবাজারের অপারেশনাল ইউনিট ও রাডার স্টেশন জনসাধারণের প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত রাখা হচ্ছে।
আবহাওয়াবিদদের মতে, দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বাড়ছে ভূমিকম্প ও বজ্রপাত। গত কয়েকবছরে বজ্রপাতজনিত প্রাণহানি বাড়ছে। বজ্রঝড় এক ধরনের ক্রান্তীয় ঝড়। বজ্রপাত ও বিজলি চমকানো সহযোগে ঝড়ের সঙ্গে হয় ভারী বর্ষণ অথবা শিলাবৃষ্টি। বাংলাদেশের পরিবর্তিত ঋতুচক্রে মার্চ অথবা এপ্রিল মাসে এবং বর্ষা মৌসুমের শেষে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে সন্ধ্যার দিকে তীব্র বজ্রঝড়ের শঙ্কা থাকে। তবে, এবার তা একমাস এগিয়ে এসেছে বলে আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। সাধারণত গ্রীষ্মের প্রথম ভাগে বজ্রঝড় ‘কালবৈশাখী’ নামে এবং বর্ষা ঋতুর শেষভাগে ‘আশ্বিনের ঝড়’ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। বজ্রঝড় হলে বজ্রপাতের সঙ্গে ঝড়ের বেগে বাতাস বইতে থাকে। আমাদের দেশে প্রাক-বর্ষা ঋতুর সময় বজ্রঝড়ের আশঙ্কা থাকে। তবে, বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতুচক্রের এই হিসাব পাল্টে যাচ্ছে। কারণ, গত বছর বজ্রঝড় দাপট দেখিয়েছে। অনেকের প্রাণ সংহার করেছে। সরকারের প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকাভুক্ত হয়েছে বজ্রপাত। সা¤প্রতিক সময়ে বজ্রঝড়ের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে গেছে।
এদিকে দেশের কোনও কোনও অঞ্চলে এবারের আগাম কালবৈশাখীর প্রথম শিলাবৃষ্টির ধরণ স্থানীয় বাসিন্দাদের ‘চোখ কপালে’ তুলে দিয়েছে। বিশেষ করে রাজশাহীর পুঠিয়ায় শিলাবৃষ্টির তান্ডবলীলার সাক্ষী হয়ে স্থানীয় প্রবীণরা বলছেন, বিগত ৬০ বছরে এমন ভয়াবহ শিলাবৃষ্টি তারা আগে কখনও দেখেন নি। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ভোরের এই শিলাবৃষ্টির অসংখ্য ছবি এবং ভিডিওচিত্র গণ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ছবিগুলোর দিকে তাকালে দেশের প্রত্যন্ত জনপদের যে কোনও মানুষের চোখ হঠাৎ করে আটকে যেতেই পারে বিস্ময়ে! এমন দৃশ্য আমাদের দেশে খুব একটা পরিচিত নয়। দেখে মনে হবে ইউরোপ কিংবা আমেরিকার মত শীতপ্রধান কোনও দেশের তুষারপাতের দৃশ্য। শিলাবৃষ্টির তীব্রতা এতোটাই বেশি ছিল যে, গ্রামগুলোতে টিনের চাল ছিদ্র হয়ে ঘরেও শিলা ঢুকে যায়। শিলাবৃষ্টি থামার তিন ঘণ্টা পরও বাইরে চলাচল করা সম্ভব হচ্ছিল না। স্থানীয়রা কোদাল দিয়ে রাস্তায় জমে যাওয়া শিলা সরিয়ে চলাচলের উপযোগী করে। ৩৮ মিনিট স্থায়ী শিলাবৃষ্টিতে ১৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে দিল্লিতে অনেকটা একইধরণের শিলাবৃষ্টি হয়েছে। ধোঁয়াশা-দূষণের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দিল্লিতে শিলাবৃষ্টি কখনো-সখনো হয়, কিন্তু এত তীব্র শিলাবৃষ্টি শহরের অনেক বাসিন্দাই আগে দেখেন নি। সাথে সাথেই শোরগোল পড়ে যায় সামাজিক মাধ্যমে। বহু লোক ফেসবুক-টুইটার-হোয়াটস অ্যাপে শিলাবৃষ্টির ছবি ও বরফ-ঢাকা রাস্তায় গাড়ি চালানো কিংবা হৈ-হুল্লোড়ে মাতামাতির ছবি পোস্ট করতে থাকেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে বজ্রপাতও বেড়েছে। শীতের পর কালবৈশাখীর প্রাক মৌসুম থেকে শুরু করে আশ্বিনের শেষ পর্যন্ত ভয়ঙ্কর বজ্রপাতসহ ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা বেড়ে যায়। তাপমাত্রা যত বাড়বে, তত বাড়বে বজ্রপাতের পরিমাণ। গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে ২০ শতাংশ বজ্রপাত বৃদ্ধি পায়। সে হিসাবে গত ৪০ বছরে প্রায় বজ্রপাতের হার ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বজ্রপাতের পূর্বাভাস না জানায় হতাহতের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে তারা জানান। সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি জরিপ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের ১৫টি দেশ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে নবম স্থানে। এছাড়া, ১৫টি দেশের মধ্যে ৯টি বিভিন্ন দ্বীপদেশ রয়েছে। বিদায়ী ২০১৮ সালের বিশ্ব ঝুঁকি প্রতিবেদনে একশ’ ৭২ টি দেশের ভূমিকম্প, সুনামি, হারিকেন এবং বন্যার ঝুঁকি বিশ্লেষণ এবং দুর্যোগ মোকাবিলা করার সক্ষমতা যাচাই করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। জার্মানির রুহর বিশ্ববিদ্যালয়, বোখাম এবং ডেভেলপমেন্ট হেল্প অ্যালায়েন্স নামে একটি জার্মান বেসরকারি মানবিক সংস্থা যৌথভাবে এই গবেষণা পরিচালনার পর এ প্রতিবেদন তৈরি ও প্রকাশ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া বিশেষ কোনও নিয়মকানুন অনুযায়ী চলছে না। এ কারণেই শীতও তার রুটিন মেনে আচরণ করেনি। মেরু অঞ্চলে বরফের স্তর ক্রমেই কমছে। আবহাওয়ার এ পরিবর্তনের জন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ন, বায়ু দূষণ, কলকারখানার দূষণ, অতিরিক্ত কার্বন নির্গমনসহ আরও বহুবিধ কারণ রয়েছে। বহুতল ভবন ও কলকারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি উষ্ণতা বাড়াচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে প্রকৃতিতেও। এতে আবহাওয়া খেয়ালী আচরণ করছে। সময় ও কালের ব্যবধানে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র। যার প্রভাব পড়ছে জনজীবনে।
এ ছাড়া দেশে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহের মধ্যে ভূমিকম্প অন্যতম। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এ দুর্যোগ সংঘটনের কারণ। একই স্থানে সাধারণ পর পর কয়েকবার বড়, মাঝারি ও মৃদু ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা, সিলেট, রংপুর ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই ঝুঁকি বেশি। চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে ক’বছর ধরে হরহামেশাই মৃদু ভূমিকম্প হচ্ছে। ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সংঘটিত ভূমিকম্পটি ছিল এযাবত বেশি শক্তিশাণী এ ভূমিকম্পে সারদেশ কেঁপে উঠে। ভূমিকম্প প্রতিরোধের কোনও ব্যবস্থা এখনও মানুষের জানা নেই। তবে, বিশেষজ্ঞরা ভূমিকম্পের সময় আত্মরক্ষা এবং ভূমিকম্পের পর উদ্ধার ও ত্রাণকাজ কিংবা ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।