নিত্যনতুন কৌশলে ইয়াবা পাচার

152

ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট কক্সবাজার জেলার টেকনাফ-উখিয়ায় মাদকবিরোধী অভিযানে হতাহতের ঘটনার মধ্যেও থেমে নেই মিয়ানমারে উৎপাদিত মাদক ইয়াবার পাচার। অভিযান জোরদারের পর নতুন বছরে মিয়ানমার থেকে যেমন বড় চালান আসছে, তেমনি টেকনাফ-উখিয়া থেকে পাইকারি ক্রেতারা সমানে ইয়াবা সংগ্রহ করে ছড়িয়ে দিচ্ছে সারাদেশে। বছর শুরুর গত ২১ দিনে শুধুমাত্র কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে র‌্যাব-পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) জব্দ করেছে ৭০ হাজারেরও বেশি ইয়াবা। গত ৪৮ ঘন্টায় নগরীতেই তিনটি পৃথক চালানে জব্দ করা হয়েছে প্রায় ২১ হাজার ইয়াবা। এর মধ্যে ঢাকার পর চট্টগ্রামে প্রথমবারের মত জব্দ হওয়া সাদা রংয়ের এক হাজার ইয়াবার একটি চালানও রয়েছে।
এদিকে, দেশের অভ্যন্তরে ছোট ছোট চালানে ইয়াবা পাচারে নেয়া হচ্ছে নিত্যনতুন কৌশল। গত বছর সীমান্ত পেরিয়ে আসা রোহিঙ্গা নাগরিকের পাশাপাশি পরিবহন শ্রমিকদের ইয়াবা পাচারে বেশি ব্যবহার করা হলেও এবার ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে পাচারকারীরা। আইন-শৃংখলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে কখনও বালতির তলায় বাড়তি তলা লাগিয়ে, কখনও নারিকেলের ভেতরের পানি ফেলে দিয়ে তার ভেতরে, কখনওবা আচারের প্যাকেটে ভরে নানা কৌশলে গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইয়াবার ছোট ছোট চালান। এসব অভিনব কৌশল আবিষ্কারের পর ‘চোখ কপালে উঠছে’ আইন-শৃংখলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের। পাশাপাশি সাদা রংয়ের ইয়াবার পাচারও বেড়েছে বলে মনে করছেন তারা।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম পূর্বদেশকে বলেন, ‘ঢাকার পর চট্টগ্রামে প্রথমবারের মত ‘সাদা ইয়াবার’ চালান ধরা পড়েছে। এই ধরণের ইয়াবার জব্দের অভিযানে ভিন্ন রংয়ের কারণে যেমন বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়, তেমনি পাচারকারীদের কৌশলও আমাদের হতবাক করেছে। বালতির তলানিতে ইয়াবা রেখে উপরে বাড়তি একটি তলানি লাগিয়ে এগুলো টেকনাফ থেকে চট্টগ্রামে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে এসেছিলেন গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তি। তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এ ধরণের ইয়াবার বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।’
র‌্যাব ও ডিবি পুলিশ কর্মকর্তারা গত ৪৮ ঘন্টায় কেবল নগরীতেই পৃথক অভিযান চালিয়ে প্রায় ২১ হাজার ইয়াবা জব্দ করেছে। এসব ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে পাঁচজনকে। এরমধ্যে গতকাল সোমবার ভোরে র‌্যাব সদস্যরা বন্দর থানার নিমতলী বিশ্বরোড এলাকায় একটি পণ্যবাহী ট্রাক তল্লাশি করে ১৮ হাজার দুইশ’ ২৫ পিস ইয়াবাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মো. মোজাম্মেল (৩০), মো. আব্দুর রহিম (৪০) এবং নুর ইসলাম (২৮)। পণ্য পরিবহনের আড়ালে তারা মূলত মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত বলে র‌্যাব নিশ্চিত হয়েছে। এর আগে ২০ জানুয়ারি দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে নগরীর জেলা পরিষদ মার্কেটের সামনে কক্সবাজার থেকে আসা ইউনিক পরিবহনের একটি বাসে অভিযান চালিয়ে নারকেলের ভেতরে বিশেষ কৌশলে লুকিয়ে রাখা এক হাজার ছয়শ’ ৬৩ পিস ইয়াবাসহ রাকিব হোসেন বাবু (৩০) নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। রাকিব ল²ীপুর জেলার রায়পুর থানার দেনায়েতপুর গ্রামের আবু তাহেরের ছেলে। এর কয়েক ঘন্টা আগে ওইদিন সন্ধ্যায় নগরীর ফিরিঙ্গীবাজার এলাকা থেকে গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম এক হাজার সাদা রংয়ের ইয়াবাসহ মো. ইদ্রিস (২২) নামে এক বহনকারীকে গ্রেপ্তার করে। বালতির তলানিতে ইয়াবা রেখে উপরে বাড়তি আরেকটি তলা লাগিয়ে অভিনব কায়দায় টেকনাফ থেকে এগুলো চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়েছে। গোলাপি বা হলদে রংয়ের ইয়াবার অবয়বে তৈরি এসব ইয়াবা একেবারে দুধ সাদা রংয়ের। আকারে সামান্য ছোট। একইদিন সকালে ডিএনসি ও র‌্যাব নগরের বাকলিয়া, কোতোয়ালী ও পাহাড়তলী এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে দুই রোহিঙ্গা নারী ও এক দম্পতিকে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে। তারা হলেন, রোহিঙ্গা নারী তৈয়বা খাতুন (২৪) ও ফাতেমা বেগম (৩৭) এবং মো. কামাল হোসেন (৩৮) ও তার স্ত্রী যুঁথি বেগম (২৫)। এদের মধ্যে তৈয়বা পরিবার নিয়ে টেকনাফের লেদা এলাকায় এবং ফাতেমা উখিয়া উপজেলার হোয়াইক্ষ্যং এলাকায় বসবাস করেন। আর কামাল দম্পতির বাড়ি নগরীর আহমদিয়া আলীয়া মাদ্রাসা এলাকায়। তাদের মধ্যে ডিএনসি কর্মকর্তারা তৈয়বার কাছ থেকে আড়াই হাজার এবং ফাতেমার কাছ থেকে পাঁচশ’ ইয়াবা জব্দ করে। অপরদিকে, র‌্যাব সকালে পাহাড়তলী এলাকায় অভিযান চালিয়ে পাঁচ হাজার তিনশ’ ইয়াবাসহ মো. কামাল হোসেন ও যুঁথি বেগম দম্পতিকে গ্রেপ্তার করে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের শুরুতে গত ৪ জানুয়ারি কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী পানবাজার থেকে থেকে ১১ হাজার নয়শ’ ইয়াবাসহ মোহাম্মদ সুলতান (২৮) ও মোসাম্মৎ ফাতেমা (৪০) দম্পতিকে গ্রেপ্তার করে। তার পরদিন ৫ জানুয়ারি নগরীর রেল স্টেশন এলাকায় আচারের প্যাকেটে ভরে অভিনব কায়দায় পাচারের সময় আট হাজার পাঁচশ’ ৬৮ পিস ইয়াবাসহ মো. আফসার মিয়া (৩০) ও মোহাম্মদ আলমগীর (৩২) নামে দুই মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এরপর ৬ জানুয়ারি বিকালে ডিএনসি অভিযান দল মামলার নথিসহ কোর্ট ফাইলের ভেতরে বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে ইয়াবা পাচারকালে কক্সবাজার বিমানবন্দর তল্লাশি গেট থেকে নুরুল আলম নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে। পরে ফাইলটি খুলে নথির মাঝখানে বিশেষভাবে রাখা কয়েকটি ইয়াবার প্যাকেট জব্দ করা হয়। তা গণনা করে চার হাজার ছয়শ’ ৮০ পিস ইয়াবা পাওয়া যায়। গত ১৩ জানুয়ারি ভোরে নগরীর বাকলিয়া থানার রাজাখালী এলাকায় মীর ফিলিং স্টেশনের সামনে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব মাহফুজুর রহমান (২৭) নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে। তার কাছ থেকে ১০ হাজার ইয়াবা জব্দ করা হয়। মাহফুজ গাজীপুর জেলার পূর্ব বড়চালা গ্রামের আব্দুর রহিমের ছেলে।
র‌্যাব-৭ এর সহকারী পুলিশ সুপার মো. মাশকুর রহমান বলেন, ‘মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর ইয়াবা পাচারকারীরা নিত্যনতুন কৌশল বেছে নিচ্ছে। আচারের মত খাদ্যদ্রব্যের প্যাকেটে ভরে পর্যন্ত ইয়াবা পাচার হচ্ছে। এটা নতুন উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে। তবে, আমরা সবসময় সতর্ক রয়েছি।’