নিজ ভাষায় বই চায় তারা

59

পার্বত্য জেলা বান্দরবানে ১১টির মধ্যে ৮টি সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা এখনও নিজ মাতৃভাষার পাঠ্যবই পাচ্ছে না। ওই নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর মানুষেরা জানান, তাদের বিদ্যালয়গামী শিশুদের বেশিরভাগই বাংলা ভাষায় পড়া আয়ত্ত করতে পারে না। এতে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই ঝরে যায় অনেক শিশু। এদিকে, নিজ মাতৃভাষার পাঠ্যবই পেলেও হাতেকলমে শেখানোর মতো প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় বাকি তিন নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা তা পড়ার সুযোগ পায় না। এ নিয়ে ওই তিন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে।
বান্দরবানে মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, খেয়াং, খুমি, লুসাই, চাক, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, মুরুং ও পাংখোয়া, এই ১১টি সংখ্যালঘু নৃতাত্তি¡ক গোষ্ঠী বাস করে। এর মধ্যে মারমা, চাকমা ও ত্রিপুরা এই তিন নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী ২০১৭ সাল থেকে নিজ মাতৃভাষার পাঠ্যবই পায়। কিন্তু বাকি ৮ নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা তা পায় না। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
স্কুল অ্যাসেম্বিলিতে শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষার বই পায় না, এমন নৃগোষ্ঠীর কয়েকজন জানান, গত কয়েক বছর ধরে সরকার কয়েকটি স¤প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাতৃভাষার বই বিতরণ করছে। কিন্তু তাদের বিদ্যালয়গামী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সেটা করার আলামত দেখছেন না তারা। তারা চান, তাদের ছেলেমেয়েরাও মাতৃভাষার বই পাক। তাদের দাবি, নিজ ভাষায় পড়ার সুযোগ না পেয়ে তাদের সন্তানদের অনেকেই ঝরে পড়ে প্রাথমিকে।
আনুম বম নামে বম নৃগোষ্ঠীর এক শিক্ষার্থী জানায়, ‘বিভিন্ন বিদ্যালয়ে মাতৃভাষার বই দেওয়া হলেও আমাদের মাতৃভাষার বই দেওয়া হচ্ছে না। আমরাও আমাদের নিজ মাতৃভাষায় বই চাই।’
খুমি নৃগোষ্ঠীর স্কুলপড়ুয়া শিশু হেনা খুমি বলে, ‘স্কুলে আমাদের বাংলা ভাষায় কথা বলতে হয়, বাংলা ভাষায় লেখা বই পড়তে হয়, এটা কঠিন। আমরা নিজের ভাষায় পড়তে চাই।’
এদিকে মারমা, চাকমা ও ত্রিপুরা স¤প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা জানায়, তারা নিজ নিজ মাতৃভাষার বই পায়। কিন্তু শিক্ষক না থাকায় বইগুলো কোনও কাজে আসে না। তাদের ভাষ্য, শুধু বই দিয়ে কী হবে।
এ তিন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর অনেকে জানান, শিক্ষক নেই। এ অবস্থায় বই দেওয়া মানে সরকারি অর্থের অপচয়। বইয়ের পাশাপাশি প্রশিক্ষিত শিক্ষকও দরকার।
ল²ী ত্রিপুরা নামে এক শিক্ষার্থী জানায়, ‘আমরা বই পেলেও এসব বই পড়তে না পাড়ায় বাসায় ফেলে রাখতে হচ্ছে। এসব বই পড়ানোর জন্য আমাদের শিক্ষকের প্রয়োজন।’
উসাইনু মারমা নামে আরও এক শিক্ষার্থী জানায়, ‘আমরা বই পেয়ে অনেক খুশি হয়েছি। এখন এগুলো পড়ানোর জন্য শিক্ষক প্রয়োজন।’
ফারুক পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুমন বলেন, ‘আমাদের এখানে সবাই বম স¤প্রদায়ের শিক্ষার্থী। মারমা, চাকমা ও ত্রিপুরা স¤প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের বই পাওয়ার কথা জানিয়ে নিজ ভাষায় বই পাওয়ার জন্য আমাদের খুব বিরক্ত করে শিক্ষার্থীরা।’
আরেক প্রধান শিক্ষক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমার এখানে প্রায় ৬টি নৃগোষ্ঠির শিক্ষার্থী আছে। এর মধ্যে অনেকে নিজ ভাষার পাঠ্যবই পায়, অনেকে পায় না। যারা পায় না তারা মন খারাপ করে। আবার যারা বই পাচ্ছে তারাও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবে তা পড়ার সুযোগ পায় না, ফেলে রাখে।’
পাঠ্যবইয়ে মনোযোগী শিক্ষার্থীরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, সাত উপজেলায় প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির ২২২ জন চাকমা, দুই হাজার ১৮১ জন মারমা ও ৪৮৪ জন ত্রিপুরা, প্রথম শ্রেণির ২৩৬ জন চাকমা, দুই হাজার ৫৬৭ জন মারমা ও ৫৮৬ জন ত্রিপুরা, দ্বিতীয় শ্রেণির ২০৪ জন চাকমা, দুই হাজার ৬০২ মারমা ও ৬০৮ জন ত্রিপুরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজ ভাষার বই বিতরণ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে মারমা, চাকমা ও ত্রিপুরা স¤প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষার বই দিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ তিন নৃগোষ্ঠী থেকে নিজ নিজ মাতৃভাষায় বই লিখে আমাদের কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল। আমরা তা পর্যালোচনা করে বই আকারে শিক্ষার্থীদের মাঝে দিচ্ছি। অন্য গোষ্ঠীগুলো তাদের মাতৃভাষায় বই লিখে এখনও আমাদের কাছে জমা দেয়নি। তবে ম্রো স¤প্রদায় তাদের নিজ ভাষায় লেখা বই আমাদের কাছে জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’