নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুই মসজিদে বন্দুকধারীর হামলা তিন বাংলাদেশিসহ নিহত ৪৯

76

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুইটি মসজিদে জুমার নামাজের সময় বন্দুকধারীর গুলিতে তিন বাংলাদেশিসহ ৪৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। অল্পের জন্য প্রাণ রক্ষা পেয়েছেন সফররত বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ১৭ জন সদস্য। তারা হামলাস্থল ওই মসজিদটিতে জুমার নামাজ পড়তে যাচ্ছিলেন, মাত্র ৫০ গজের ব্যবধানে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ভাগ্যক্রমে তারা বেঁচে যান।
গতকাল বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে বলে জানিয়েছেন দেশটির পুলিশ কমিশনার মাইক বুশ বলেন, ‘ডিন্স এভিনিউর আল নূর মসজিদে ৪১ জন এবং লিনউড এলাকার অন্য মসজিদে সাত জন নিহত হয়েছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো একজন মারা গেছেন’।
নিহতদের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি রয়েছেন বলে সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে। হামলায় আহত অন্তত ৪৮ জন ক্রাইস্টচার্চ হাসপাতাল চিকিৎসাধীন আছেন বলে নিশ্চিত করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আহতদের মধ্যে শিশুরাও রয়েছে।
হাসপাতাল থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে খুব জরুরি না হলে লোকজনকে আহতদের দেখতে হাসপতালে না আসার অনুরোধ জানানো হয়েছে। তবে এরই মধ্যে দুই শতাধিক মানুষ হাসপাতালে ভিড় জমিয়েছেন।
মসজিদে হামলার এ ঘটনাকে ‘নজিরবিহীন’ এবং ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে বর্ণনা করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী অ’ডুর্ন। তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চিত ভাবেই পরিকল্পনা করে এ হামলা চালানো হয়েছে’। হামলার পর শোক প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী অ’ডুর্ন বলেন, ‘এটা নিউজিল্যান্ডের অন্ধকারতম দিনগুলোর একটি। এখানে যে ঘটনা ঘটেছে সেটা পরিষ্কার ভাবেই অস্বাভাবিক এবং অপ্রত্যাশিত নৃশংসতা’।
এদিকে দুই মসজিদে হামলায় জড়িত সন্দেহে চারজনকে আটক করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে তিনজন পুরুষ এবং একজন নারী বলে জানান পুলিশ কমিশনার মাইক বুশ। গ্রেপ্তার ২৮ বছরের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে জানিয়ে বুশ বলেন, শনিবার (আজ) তাকে আদালতে উপস্থাপন করা হবে। হামলায় জড়িত সন্দেহে আটক এক ব্যক্তি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক বলে নিশ্চিত করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন। তিনি বলেন, সন্দেহভাজন হামলাকারী ‘একজন চরম ডানপন্থি নৃশংস সন্ত্রাসী’।
দুই মসজিদে হামলার পর ক্রাইস্টচার্চ কর্তৃপক্ষ নগরীর সব মসজিদ পরবর্তী নোটিস না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। নগরীর সব স্কুলও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় হত্যাকান্ড :
প্রত্যক্ষদর্শীরা স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আল নূর মসজিদে গুলি শুরু হলে তারা প্রাণ বাঁচাতে সেখানে থেকে দৌড়ে পালিয়ে যান। মসজিদের বাইরে রক্তাক্ত অবস্থায় লোকজনকে পড়ে থাকতে দেখার কথাও জানান তারা। আল নূর মসজিদ এলাকায় মহান ইব্রাহিম নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘শুরুতে আমি ভেবেছিলাম বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে এমনটা হচ্ছে। পরে দেখি সবাই দৌড়াতে শুরু করেছে। এখনো আমার বন্ধুরা মসজিদের ভেতরে আছে’।
অন্য এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, হামলাকারী সামরিকবাহিনীর মতো পোশাক পরে ছিল। হাতে থাকা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল দিয়ে সে ক্রামগত গুলি ছুড়তে থাকে।
অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের ১৭ সদস্য :
আল নূর মসজিদে বন্দুক হামলার সময় নিউজিল্যান্ড সফরে থাকা বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ১৭ জন খেলোয়াড়-টীম মেম্বার জুমার নামাজ আদায় করতে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তবে ঘটনা চলাকালীন ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরত্বে ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের এই সদস্যরা। ঘটনার ৩-৪ মিনিট আগে তারা মসজিদে আসলে তারাও এই হত্যাকান্ডের শিকার হতে পারতেন বলে দলের ম্যানেজার খালেদ মাসুদ পাইলট পরে সংবাদমাধ্যমকে জানান, ঘটনার দৃশ্যগুলো আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছিলাম। রক্তাক্ত মানুষগুলো ছুটছিল। ঠিক যেন সিনেমার মতো। তখন আমাদের টীমের অনেকেই কান্না করছিল’। তবে তারা সবাই নিরাপদে আছেন বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে নিশ্চিত করেছেন দলের কোচ ও ম্যানেজার।
নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডের খবরে বলা হয়েছে, গোলাগুলি শুরুর পরপরই আল নূর মসজিদে পৌঁছেছিলেন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা। তারা ঘটনা দেখতে পেরে দ্রুত সেখান থেকে সরে যান।
আজ (শনিবার) ক্রাইস্টচার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তৃতীয় টেস্ট খেলতে মাঠে নামার কথা ছিল বাংলাদেশ দলের। হামলার পর ওই ম্যাচটি বাতিল ঘোষণা করা হয়। আজ (শনিবার) ক্রাইস্টচার্চের হ্যাগলি ওভালে ওই ম্যাচ শুরু হওয়ার কথা ছিল।
নিহতদের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি :
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুই মসজিদে গুলির ঘটনায় নিহতদের মধ্যে অন্তত তিনজন বাংলাদেশি রয়েছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের অনারারি কনসাল ইঞ্জিনিয়ার শফিকুর রহমান। তিনি বলেছেন, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আরও চার বাংলাদেশিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আরও একজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটির কাছ থেকে খবর পেয়েছেন তিনি।
নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের স্থায়ী দূতাবাস নেই, অনারারি কনসাল ইঞ্জিনিয়ার শফিকুর রহমান থাকেন অকল্যান্ডে। সেখান থেকে তিনি ক্রাইস্টচার্চের বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। তিনি বলেন, ‘শুক্রবার অনেকেই জুমার নামাজ পড়তে আল নূর মসজিদে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন না ফেরায় পরিবারের সদস্যরা ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু না পেয়ে খোঁজ শুরু করেন। পরে হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কয়েকজনের ভর্তি হওয়ার খবর পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে তিনজন মারা যান। নিহত বাংলাদেশিরা হলেন লিংকন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. আবদুস সামাদ ও তার স্ত্রী এবং হোসনে আরা ফরিদ নামের এক গৃহবধূ। শফিকুর রহমান বলেন, ‘ষাটোর্ধ্ব আবদুস সামাদের বাড়ি ময়মনসিংহে, এক সময় তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন।’
এদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গতকাল শুক্রবার দুপুরে সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে ক্রাইস্টচার্চের ঘটনা নিয়ে কথা বলেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা নিরাপদে রয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা হচ্ছে। নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের মিশন না থাকায় অন্য একটি মিশনের মাধ্যমে সে দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানান মন্ত্রী।
আজ রাতে দেশে পৌঁছাবেন তামিমরা
ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা নিরাপদে হোটেলে ফিরলেও কত দ্রুত তাদের দেশে ফেরানো যায় সেটাই ছিল চ্যালেঞ্জের। অবশেষে তাদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা হয়েছে। বাংলাদেশ সময় আজ (শনিবার) রাত ১০টা ৪০ মিনিটে ঢাকায় পৌঁছানোর কথা তাদের। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন বিসিবির মিডিয়া ম্যানেজার রাবিদ ইমাম।
ঘটনার আকস্মিকতার পর হোটেলবন্দি ছিলেন ক্রিকেটাররা। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড তাদের ফেরাতে দ্রæত ব্যবস্থা নেয়। সরকারি পর্যায়েও যোগাযোগ করেন বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। টিম ম্যানেজার খালেদ মাসুদ পাইলট জানান, টিকিট পেলেই তারা দেশে ফিরবেন। প্রাথমিকভাবে কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন ফ্লাইটে ওঠার কথা বললেও একইসঙ্গে ফিরছেন সবাই। বিশেষ ব্যবস্থায় টিকিট পেয়েছেন তামিম-মুশফিকরা।
কোচিং স্টাফসহ ১৯ জনের দল একসঙ্গে একই ফ্লাইটে দেশে ফিরবেন। তবে প্রধান কোচ স্টিভ রোডস, পেস বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশ ও ট্রেনার মারিও ভিল্লাভারায়েন ফিরে যাবেন নিজ নিজ দেশে।
১৫ ক্রিকেটারদের মধ্যে আছেন মাহমুদউল্লাহ, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মেহেদী হাসান মিরাজ, মোস্তাফিজুর রহমান, লিটন দাস, তাইজুল ইসলাম, সাদমান ইসলাম, মুমিনুল হক, খালেদ আহমেদ, এবাদত হোসেন, মোহাম্মদ মিঠুন, নাঈম হাসান, আবু জায়েদ ও সৌম্য সরকার।