নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার দাম্পত্য জীবন

178

বেগম রোকেয়া এমন এক অসামান্য নারী, যিনি এদেশের অবহেলিত নারী সমাজকে দিয়েছেন এক অভাবনীয় আলোক বর্তিকার সন্ধান। বেগম রোকেয়া নারী অধিকার, চেতনা ও সমাজ নির্মাণ মানসিকতার যথার্থ রেখাপাত ঘটেছে তাঁর সৃজন কর্মে। নারী জাগরণ তথা নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া এক প্রদীপ্ত শিখা। যার সংস্পর্শে এসে এই উপমহাদেশের নারী সমাজ লাভ করেছে মুক্তির দিশা। তিনিই প্রথম বাঙালী নারী যিনি নারী হয়ে প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এই উপমহাদেশে নারী সমাজের মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে শিক্ষা ও স্বনির্ভরতা। রোকেয়া প্রগতিশীলতা ও আধুনিকতার নামে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের আদর্শ ও ঐতিহ্যকে কখনই বিসর্জন দেন নাই।
বাংলার নারী সমাজের মুক্তির অগ্রদূত ও জ্ঞানের আলো সঞ্চারিনী বেগম রোকেয়া ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার অন্তর্গত “পায়রাবন্দে” বিখ্যাত জমিদার সাবের বংশে জন্মগ্রহণ করেন। পায়রাবন্দের প্রথম জমিদার টাটি বলদিয়া ইংরেজ পক্ষের গুপ্তচর ছিলেন (“বলদিয়া” অর্থ হলো বলদের পৃষ্ঠে মালামাল চাপিয়ে একস্থান হতে আর এক স্থানে নিয়ে গিয়ে ক্রয়-বিক্রয় করতো যারা তাদেরকে দেশীয় ভাষায় “বলদিয়া” বলা হতো)। টাটি শেখ বলদিয়া তৎকালীন ইংরেজদের পক্ষে সফল গুপ্তচরের বদৌলতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী মহাখুশী হয়ে তাকে বহুলক্ষ টাকার জমিদারী, লাখেরাজ, জলকর, ফলকর, বনকর দান করেন (হায়দার আলী রচিত “পলাশী যুদ্ধোত্তর আযাদী সংগ্রামের পাদপীঠ” পৃষ্ঠা নং ৩৪০)। এখানে বেগম রোকেয়া পরিবারের সংক্ষিপ্ত বংশ পরিচিতি তুলে ধরা হলো: প্রপিতা মহ: টাটি চৌধুরী বলদিয়া (পরবর্তীতে চৌধুরী)। পিতামহ: জমির উদ্দিন চৌধুরী, পিতা- জহির উদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী সাবের চৌধুরী ও রাহাতুন্নেছা সাবেরা চৌধুরানী ছিলেন বেগম রোকেয়ার মাতা। তাঁর মাতা রাহাতুন্নেছা, সাবেরা চৌধুরানী ঢাকার বলিয়াদির জমিদার হোসেন উদ্দীন চৌধুরী সাহেবের কন্যা ছিলেন।
রোকেয়ার ৪ মাতা ছিলেন এবং ভাইবোনের সংখ্যা ছিল ৯ ভাই ৬ বোন। মন্মধ্যে ২ ভাই ও ২ বোন অপ্রাপ্ত বয়সে মারা যান। ভাইরা ছিলেন যথাক্রমে- ১) ইব্রাহিম সাবের, ২) খলিলুর রহমান সাবের, ৩) আবুল বাকের সাবের, ৪) আবুল ফজলে সাবের, ৫) আব্বাস সাবের, ৬) মজলুম সাবের, ৭) মছিহজ্জামান আবুল ওছামা সাবের ও বোনদের মধ্যে ১) করিমন নেছা (টাঙ্গাইলের দেলদূয়ারে বিবাহ হয়। ইনি আব্দুল করিম ও আব্দুল হালিম গজনবীর মাতা ছিলেন), ২) বেগম রোকেয়া (ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট সাখাওয়াৎ হোসেন এর সাথে বিবাহ হয়), ৩) বাদশাহ খাতুন, ৪) হুমেরা খাতুন। রোকেয়ার বড় বোন করিমন নেসা ও বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের হাতেই শৈশব কালে বেগম রোকেয়ার লেখাপড়ার হাতে খড়ি। তাঁদের ঐতিহ্যবাহী এই সাবের পরিবারে আরবী, ফারসী ও উর্দ্দু ভাষার প্রচলন ছিল কিন্তু বাংলা ও ইংরেজী ভাষার প্রচলন ছিল একেবারেই নিষিদ্ধ।
রোকেয়ার দুই সহদোর ভাই, ইব্রাহিম সাবের ও খলিলুর রহমান সাবের সর্বপ্রথম সাবের পরিবারের ঐতিহ্য ভেঙ্গে ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৮৯৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ভাগলপুর নিবাসী খানবাহাদুর সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে বেগম রোকেয়া বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ছিলেন সে আমলে প্রথম সারির উল্লেখযোগ্য মুসলিম গ্রাজুয়েট (১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে মোহসেনের হুগলী কলেজ থেকে বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন)। কর্মজীবনের শুরুতে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন। সাখাওয়াৎ হোসেন যখন বি.এ পাশ করে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হন, বেগম রোকেয়া তখনও জন্মগ্রহণ করেন নাই (বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে)। সাখাওয়াৎ হোসেনের এটি দ্বিতীয় বিয়ে। এই অসম বিয়েতে বেগম রোকেয়ার গর্ভে দুটি কন্যা সন্তানের জন্মের কিছুদিন পর পরই তাদের অকাল মৃত্যু হয়। তাঁর স্বামী ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে ডায়াবেটিক রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালেই মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র ২৮ বছর বয়সে বেগম রোকেয়া তাঁর স্বামীকে হারান। সাখাওয়াৎ হোসেনের আকস্মিক মৃত্যু বেগম রোকেয়াকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়। তাঁর ১০ বছরের দাম্পত্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। অকাল বৈধব্য তাঁকে সে যুগে দমিয়ে রাখতে পারে নাই। বেগম রোকেয়ার মনোবল ছিল অপরিসীম। তাই তিনি তার এই শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। পরবর্তীতে মৃত স্বামীর সম্পত্তি নিয়ে প্রথমা স্ত্রীর সন্তানদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ হওয়ায় স্বামীর মৃত্যুর মাত্র ২ বছর পরেই ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে স্বামীর সঞ্চিত ১০,০০০/- (দশ হাজার) টাকা নিয়ে কলকাতায় পাড়ী জমান। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মার্চ কলকাতার তালতলা অঞ্চলে ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের ভাড়া বাড়ীতে মাত্র দুটে ক্লাশ দু’খানা বেঞ্চ আর ৮ জন ছাত্রী নিয়ে স্কুলের যাত্রা শুরু করেছিলেন। মরহুম স্বামীর নামানুসারে স্কুলের নাম দিয়েছিলেন “সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল”। অভিভাবকদের আশ্বস্ত করে জানিয়েছিলেন স্কুলে কঠিনভাবে পর্দা মানা হবে। নিজে বোরকা পড়ে বাড়ী বাড়ী যেতেন ছাত্রী যোগাড় করতে। স্কুলের মিটিংও করতেন পর্দার অন্তরাল থেকে। এক পর্যায় স্কুলের ফান্ড শূন্য হলে তিনি বিত্তবানদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে স্কুল টিকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ ব্যাপারে রোকেয়ার হিতৈষীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খান বাহাদুর তসাদ্দক আহমেদ। ইতিহাসের পাতায় সেই ৮ জন ছাত্রীর নাম লিপিবদ্ধ থাকা দরকার। কেননা একটা যুগের পরিবর্তনে এরাই এগিয়ে এসেছিলেন
ছাত্রীর নাম পিতার নাম
১) আখতারুন্নেছা সৈয়দ আহাম্মদ আলী
২) জোহরা সৈয়দ আহাম্মদ আলী
৩) মোনা মাওলানা মোহাম্মদ আলী
৪) রাজিয়া খাতুন আবদুর রব
৫) জানি বেগম আবদুল ওহাব
৬) সৈয়দা কানিজ ফাতেমা সৈয়দ আবদুস সালেক
৭) সৈয়দা সাকিনা সৈয়দ আবদুস সালেক
অষ্টম ছাত্রীর পরিচয় পাওয়া যায় নাই। অবশেষে তাঁর অক্লান্ত চেষ্টায় ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র তিনটি মেয়ে তাঁর স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে।
মেয়েদের সার্বিক উন্নতির জন্য তিনি শিক্ষা গ্রহণকেই সর্বাগ্রে জোর দিয়েছিলেন, তাঁর স্বপ্ন ছিল নারীকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা। এরই জন্য তিনি ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে “আঞ্জুমান খাওয়াতীনে ইসলাম” নামক মহিলা সংগঠন সে সময় কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শুধু সে সময় স্কুল ও “আঞ্জুমান খাওয়াতীনে ইসলাম” নামক মহিলা সংগঠন তৈরীর মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন নাই। বেগম রোকেয়া সে আমলে ছিলেন একজন নামকরা কবি ও সাহিত্যিক। মিসেস আর.এস হোসেন নামে সেকালের বিখ্যাত পত্র-পত্রিকায় তিনি অসংখ্য কবিতা, উপন্যাস ও নারীদের জন্য সমাজ সচেতন মূলক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে অভিহিত বেগম রোকেয়ার (১৮৮০-১৯৩২ খ্রি.) সাহিত্য জগতে আবির্ভাব ঘটে বিশ শতকের প্রারম্ভে ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে “নব প্রভা” পত্রিকায় “পিপাসা” শীর্ষক রচনার মাধ্যমে সাহিত্য জগতে তার আবির্ভাব।
বেগম রোকেয়ার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলির নাম হলো- মতিচুর, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, সুলতানার স্বপ্ন (ইংরেজীতে লেখা), সুবেহ সাদেক, অর্ধাঙ্গী, জাগো হে ভগিনী, স্ত্রী জাতির অবনতি, গৃহ ইত্যাদি। রোকেয়া সাহিত্য রচনায় বেশীর ভাগ সময় লিখতেন মিসেস আর.এস হোসেন। দাফতরীক চিঠি বা অনাত্মীয়দের নিকট চিঠি লিখতেও এই নামই স্বাক্ষর করতেন। একান্ত আপনজনদের নিকট লেখা চিঠিতে স্বাক্ষর করতেন “রোকেয়া বা রোকেয়া খাতুন”।
রোকেয়ার সমাজ চিন্তা ও সমাজ পরিবর্তনের বিশ্বাস আধুনিক মতবাদে উজ্জীবিত। নারীর কাঙ্খিত মুক্তি সাধনে ও নারী শিক্ষায় উদ্দীপ্ত প্রাণ বেগম রোকেয়া তাই চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবেন তাঁর আপন কীর্তিও সৎকর্মের জন্য।
প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর থেকে ৩ দিনের জন্য মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়া মেলা বসে। তখন মেলার পদভারে লোক সমাগমে এই এলাকাটি সরব ও কোলাহল মুখর হয়ে ওঠে। পায়রাবন্দে আরো রয়েছে বেগম রোকেয়া একাডেমী ভবন, রোকেয়া ডিগ্রী কলেজ ও বেগম রোকেয়ার যাদুঘর। যাদুঘরের থেকেও আকর্ষণ হলো বেগম রোকেয়ার মূল বসতভিটার ধ্বংস স্তুপ ঘিরে তৈরী উদ্যানটি। ইটের দেয়াল দিয়ে গাঁথুনী দেওয়া এই উদ্যানে ঢোকার মুখে রয়েছে একটি প্রবেশদ্বার। লোহার গেট খুলে ভেতরে প্রবেশ করলেই ভাঙ্গা ইটের প্রাচীর ও পিলার। পুরানো স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষ ঐতিহ্যবাহী সাবের বংশের আভিজাত্যকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। বেগম রোকেয়ার আত্মত্যাগ কেবল স্কুল প্রতিষ্ঠা কিংবা আঞ্জুমান প্রতিষ্ঠার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলনা। কর্মী রোকেয়ার চেয়েও অনেক বড় ছিলেন সাহিত্যিক রোকেয়া।
এ প্রসঙ্গে রোকেয়ার স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে “সওগাত” সম্পাদক নাসির উদ্দীন বলেছেন- “বেগম রোকেয়া ছিলেন তৎকালীন মুসলমান নারী সমাজের স্বাধীনতার অগ্রদূত”। ‘সওগাত’ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ ছিল অবিস্মরণীয়। সওগাতের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রথম কবিতাটিও ছিল বেগম রোকেয়ার। (সওগাত প্রথম বর্ষ, প্রথম খন্ড, অগ্রহায়ন ১৩২৫ বাংলা প্রথম সংখ্যা, ইংরেজি নভেম্বর ১৯১৮ খ্রি.)। লেখাটির সঙ্গে ছিল একটি চিঠি। আমি কবি নই, উৎসাহ দমন করতে না পেরে এটা লিখেছি। কবিতা হিসেবে হয়তো কিছুই হয়নি, তবে অভিনন্দন হিসেবে গ্রহণ করলে খুশি হবো। (তৎকালীন সওগাত সম্পাদক নাসির উদ্দীন কে উদ্দেশ্য করে লিখা)।
সওগাতের মহিলা সংখ্যা ও বেগম রোকেয়ার কথা বলতে বলতে মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন (বর্তমান প্রয়াত) আপন মনে হেসে উঠে ছিলেন। হাসির কারণ সম্পর্কে তিনি জানান “মহিলা সওগাত” বের হওয়ার পরে বেগম রোকেয়া তাঁর বাড়ীতে মোহাম্মদ নাসির উদ্দীনকে চায়ের দাওয়াত করেন। লোয়ার সার্কুলার রোডের বাড়ীর নীচ তলায় স্কুল এবং ওপর তলায় বেগম রোকেয়া থাকতেন। পর্দার ওপাশে টেবিলে নাশতা দিয়ে পরিচারিকা বসতে বললেন। কিছুক্ষণ পর পর্দার ওপাশে হাসির শব্দ। হাসতে হাসতে পর্দার ওপাশ থেকেই বললেন-“মহিলা সংখ্যার জন্য আপনাকে অভিনন্দন”। প্রগতিপন্থী হওয়া স্বত্বেও বেগম রোকেয়া পর্দার আড়াল থেকে কথা বলতেন। কারণ তাঁর স্কুল। যদি বেপর্দা বলে মুসলমান সমাজ তাদের মেয়েদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দেয়। সামাজিক পরিবেশে এরূপ কঠিন শৃঙ্খলার মধ্যে বেগম রোকেয়াকে তৎকালীন টিকে থাকতে হয়েছে।
রোকেয়া এই উপমহাদেশে প্রথম মুসলিম নারীবাদী আন্দোলনের একজন প্রবক্তা ছিলেন একথা নিঃশংসয়ে বলা যায়। ১৯৮০ সালে বেগম রোকেয়ার শর্তবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলী জানাতে বাংলাদেশ ডাকবিভাগ তাঁর দুটি স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করেছিলো। বাংলাদেশ ডাকবিভাগের এটি একটি মহৎ কাজ।
এই মহিয়সী নারী উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের জন্যই মূলত তাঁর সাহিত্য সাধনায় স্থান করে নিয়েছেন। বেগম রোকেয়া ছিলেন সে আমলে নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ ও অগ্রদূত। আমাদের গর্ব। বাঙালি জাতি প্রেরণার উৎস। সত্য কথা বলতে কি বেগম রোকেয়ার কৃতিত্ব হলো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতোই। তিনি শুধু স্কুল প্রতিষ্ঠা কিংবা নারী শিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হন নাই; বরং সেই সঙ্গে ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে সমাজে মহিলাদের অবস্থার সার্বিক উন্নতির জন্য তিনি অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন পুরুষ ব্যক্তিত্ব। বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন নারী। এখানে বিদ্যাসাগরের চেয়ে বেগম রোকেয়ার কৃতিত্ব ছিল বেশি। সমকালীন সামাজিক অনুশাসনের অচলায়তন ভাঙ্গা ছিল তাঁর লক্ষ্য। সুবিধাভোগী পুরুষের বিরুদ্ধে তাঁর ব্যাঙ্গ ছিল, কিন্তু নিছক পুরুষ বিদ্বেষ লালন করেন নাই নিজে অন্তরে। তাই নির্দ্ধিধায় তাঁর নামের সঙ্গে স্বামীর নাম যুক্ত করে নিজের সত্তাকে পূর্ণতা দিয়েছিলেন।
১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর শীতের ভোরে ফজরের নামাজের জন্য জায়নামাজে দাড়িয়ে ছিলেন তিনি। ভোরের নামাজরত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। মাত্র ৫২ বছর বয়সে বেগম রোকেয়া ইন্তেকাল করেন। (১৮৮০-১৯৩২ খ্রি.) শোনা যায় মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছা ছিল তার প্রাণের হাতে গড়া স্কুলের প্রাঙ্গনে কবর হবে এটি ছিল তাঁর অন্তিম বাসনা। বলাবাহুল্য সে আশাও তাঁর পূরণ হয়নি। সে আমলে এক শ্রেণির রক্ষণশীল গোড়া মুসলমান সমাজ সে সময়ে তাকে তাঁর স্কুল প্রাঙ্গণে জানাযা ও কবর দিতে বাঁধা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে কলকাতার কাছে “সোঁদপুরে” তাঁর এক আত্মীয়ের বাগান বাড়ীতে বেগম রোকেয়ার কবর দেয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। আজ তার চিহ্ন মাত্র কোথাও বিদ্যমান নেই। যে নারী সারাটা জীবন তাঁর সর্ব্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে জাতির উন্নতির প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তাঁর কবরটিও ধরে রাখার চেষ্টা করেন নাই পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিংবা বুদ্ধিজীবী মহল। সোঁদপুরের নিকটে পানহাটিতে একটি স্কুল বাড়ীতে বেগম রোকেয়ার কবর পাওয়া গেছে বলে কলকাতার বামপন্থি মহল থেকে একবার দাবি করা হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন ওমর কে দিয়ে দেড়যুগ আগে সেই কঙ্কাল বিহীন কবরের উদ্বোধনও করা হয়েছিল। কঙ্কালটি নাকি স্কুল বাড়ী তৈরি করার সময় পাশের গঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে অনুসন্ধানে জানাগেছে এ দাবি অলীক সম্পূর্ণ ভুয়া। বর্তমানে বেগম রোকেয়ার উদ্বোধন করা সেই সমাধীটি এখনও রয়েছে কলকাতার সোঁদপুরের পানহাটির ঐ স্কুল প্রাঙ্গনে। বিশ্বমানের বিচারে আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া সমাজে আজ বেগম রোকেয়া চর্চ্চার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বেগম রোকেয়া শুধূ নারীর অধিকার ও জাগতিক মুক্তির কথাই বলেন নাই; প্রায় একশতাব্দী আগে সা¤প্রদায়িকতা বিহীন মুক্ত জীবনবোধ ও জীবনাচরনের উৎসাহ দিয়েছিলেন।
বর্তমানে কলকা তার লর্ড সিনহা রোডে অবস্থিত বেগম রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল সরকারি বালিকা বিদ্যালয় আজও তাঁর গৌরব ও ঐতিহ্য বহন করে চলছে।
তথ্যসূত্রঃ
১) তালা বন্ধ থাকবে রোকেয়ার জাদুঘর?
-অদিতি ফাল্গুনী, প্রথম আলো, ১০ ডিসেম্বর ২০০৩ খ্রি.
২) কোলকাতায় বেগম রোকেয়া বিস্মৃতির অতলে
-আহমদ হাসান ইমরান, নয়াদিগন্ত, ৯ ডিসেম্বর ২০০৪ খ্রি.
৩) বেগমের খোলসে অবরোধ বাসিনী রোকেয়া
-ড. এ.কে.মে শাহনাওয়াজ, জনকন্ঠ ২৬ অগ্রহায়ন ১৪১১ খ্রি.
৪) বেগম রোকেয়ার পত্রাবলী
-জোহরা শিউলী, দৈনিক প্রথম আলো, ৯ ডিসেম্বর ২০০৬ খ্রি.
৫) বেগম রোকেয়া ও সওগাত
-নাসির উদ্দিন (সওগাত সম্পাদক)
সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ঢাকা, ১৯৮৬ খ্রি.
৬) বেগম রোকেয়ার দাম্পত্য জীবন
-মোঃ জোবায়ের আলী জুয়েল
দৈনিক ডেসটিনি, ৯ ডিসেম্বর ২০০৯ খ্রি.