নারীর আত্মরক্ষায় কারাতে

128

সকাল ৭টা। ভোরের নরম রোদ তার উষ্ণতা ছড়াতে শুরু করেছে। এরই মাঝে দেখা গেল, একদল তরুণীকে। যারা সারিবদ্ধ হয়ে নানা শারীরিক কসরত প্রদর্শন করে চলেছেন। তাদের নেতৃত্বে আছেন এক যুবক। যার নির্দেশনায় তরুণীরা আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ শিখছেন। এসব তরুণীর আত্মবিশ্বাস দেখে চলতি পথের আশেপাশে ভিড় করছে অনেকেই। এমন দৃশ্য এখন প্রতিদিন দেখা যায় সিআরবির শিরীষতলায়।
বলছিলাম ‘দ্যা ক্র্যাক প্লাটুন’ নামে একটি সংগঠনের কথা। যে সংগঠনটি দুই বছর ধরেই নিয়মিত নারীদের এমন আত্মরক্ষার কসরত শিখাচ্ছেন।
চলতে-ফিরতে নানা অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছেন অসংখ্য নারী। স্কুল, কলেজ কিংবা কর্মক্ষেত্র কোথাও যেন সুরক্ষিত নয় নারীরা। দেশের অগ্রগতি যেমন বাড়ছে তেমনি বেড়েছে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, ইভটিজিং এর মতো ঘটনা। আবার খুব কম মানুষই রাস্তাঘাটে হেনস্থার শিকার হওয়া মেয়েদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। কিন্তু কেমন হয় যদি নারীরা নিজেকে রক্ষা করার কৌশলগুলো নিজেই শিখে নেয়? নিপীড়ক, ইভটিজারদের দৃঢ় হস্তে প্রতিবাদ করে?
এমনই প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ নিয়েছে ‘দ্যা ক্র্যাক প্লাটুন’ সংগটনটি।
২০১৪ সালে এই সংগঠন ‘সেভ দ্যা হিউম্যানিটি’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। শুরুতে সংঘঠনটি একটি সামাজিক সেবামূলক সংগঠন ছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল সমাজের অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু একটি নারী নির্যাতনের ঘটনা বদলে দিল সংগঠনটির কাজের পরিধি। বর্তমানে সংগঠনটির প্রধান কাজ মেয়েদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দেয়া।
যার প্রশিক্ষণে এবং যে সংগঠনের মাধ্যমে শত শত নারী আজ আত্মরক্ষার কৌশল শিখছে সে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা মোহম্মদ ইমরান নামের এক যুবক।
কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালের পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ উৎসবে ঢাকায় নারী নিপীড়নের একটি ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করছিল। ওই ঘটনা আমাকে এবং আমার সহযোগীদের ভীষণ মর্মাহত করেছিল। নারীরা এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে এমন কোন উদ্যোগের কথা ভাবছিলাম। ‘যে ভাবা সেই কাজ করা শুরু’
ইমরান নিজে কারাতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাই কারাতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই নারীদের দক্ষ করে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। শুরুটা খুব একটা সহজ ছিল না। ২০১৫ সালের শেষের দিকে মেয়েদের কারাতে প্রশিক্ষণের আহব্বান জানাতে থাকেন ইমরান। কিন্তু আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছিলেন না। কয়েকজন প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী হলেও পরিবারের আপত্তিতে আসতে পারছিলেন না। পরে তাহিয়া তারান্নুম নামের আরেকটি সংগঠটের এক সদস্য প্রশিক্ষণ নিতে এগিয়ে আসে। জায়গার অভাবে নিজের বাসাতেই তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন ইমরান। ২০১৬ সালের ১৪ ফেব্রæয়ারি সংগঠনটির পক্ষ থেকে একটি অনুষ্ঠানের আয়েজন করা হয়। অনুষ্ঠানে অনেক মানুষের সামনে তাহিয়া তারান্নুম নানা কসরত প্রদর্শন করে। এই প্রদর্শনী থেকেই আত্মরক্ষার কৌশল শিখতে আগ্রহী হয় অনেক নারী। একে একে অনেকে যোগাযোগ করতে থাকে ইমরানের সাথে। পরে সিআরবির শিরীষতলায় ১৫ জন নারীকে সপ্তাহে ৭ দিন সকাল ৭ টা থেকে ৮:৩০ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন ইমরান। ধীরে ধীরে সদস্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ এ। পরে প্রেসক্লাবের সামনে একটি অনুষ্ঠানে হাজারো মানুষের সামনে আত্মরক্ষার কসরত প্রদর্শন করেন ওই নারীরা। বাড়তে থাকে সংঘঠনটির পরিধি। ‘দ্যা ক্র্যাক প্লাটুন-সেল্ফ দিফেন্স প্রজেক্ট’ শিরোনামে ইমরানের সংঘঠনটি থেকে শত শত নারী প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেরাও দক্ষ প্রশিক্ষক হয়ে উঠেছেন। এর মধ্যে ছয়জন নারী ইমরানের সহযোগী হিসেবে অন্য নারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। মাত্র একজনকে দিয়ে প্রশিক্ষণের কাজ শুরু হলেও গত দুই বছরে প্রায় ১ হাজার ৫০০ নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ইমরান ও তার ছয় সহযোগী। প্রতিদিন সকাল ৭ টা থেকে রাত ৮:৩০ পর্যন্ত সিআরবির শিরীষতলায় এই প্রশিক্ষণের কাজ চলে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও প্রশিক্ষণ দেয় এই সংঘটন। যেকোনো বয়সের যে কোন নারীই উক্ত প্রশিক্ষণে অংশ নিতে পারবেন ফ্রিতে। ইমরানের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তার ছয় সহযোগী অন্য নারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এরা হলেন- ফাহমিদা আহমেদ, পিনাকী ভট্টাচার্য, তানজিন বিনতে আলম, আন্তারা আনিকা ও জান্নাতুল ফেরদৌস। তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী।
মোহাম্মদ ইমরান আরো বলেন- শিশু থেকে যে কোন বয়সের নারী এই প্রশিক্ষণে অংশ নিতে পারবেন। আর এর জন্য কোন ফি’র দরকার নেই। প্রশিক্ষণের জন্য একে একে ১৭টি কর্মশালার আয়োজন করেছে ‘দ্যা ক্র্যাক প্লাটুন’।
প্রশিক্ষণ নেয়া অনেক তরুণীই আজ অনেক সাহসী। আগে যেখানে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা তারা মুখ বুজে সহ্য করে গেছেন, সেখানে আজ তারা দৃঢ়ভাবে এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন। গত দুই বছরে এসব নারী প্রায় ৮৭টি আপত্তিকর ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন। ইমরান শোনাচ্ছিলেন সেই ঘটনাগুলার কয়েকটি।
ইমরান বলেন- আমার কাছে প্রশিক্ষণ নেয়া এক তরুণী সাইকেলে যাতায়াত করতেন। একদিন জিইসির মোড়ে তার সাইকেলের চাকায় পা দিয়ে আটকে তাকে উত্যক্তের চেষ্টা করে এক বখাটে। এই ঘটনার পালটা জবাব দেন সে তরুণী। পরে তাকে শায়েস্তা করে নিজেই তুলে দেন পুলিশের হাতে। এভাবে এসব তরুণীরা ভয়কে জয় করে প্রতিবাদ করছেন অহরহ নানা ঘটনার।
তবে ইমরানের এমন প্রশংসনীয় উদ্যাগের পেছনে অনেক শ্রম রয়েছে। প্রতিদিন নানা ধরনের টিটকারি, খোচা শুনতে হয় তাকে। তবুও একদিনও নারীদের প্রশিক্ষণ দেয়া থেকে বিরত থাকেন না ইমরান ও তার সহযাগীরা।
মোহাম্মদ ইমরান চান তার এই কার্যক্রমটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ুক, তার ই মত কারো না কারো উদ্যোগে। আর নারীরা প্রতিবাদ করতে শিখুক দৃঢ় হস্তে। নারীরা কেউ আমাদের মা, আমাদের বোন। তাদের কেন নিপীড়নের শিকার হতে হবে-এমনটা মানতে পারি না। তাই চেয়েছিলাম তাদের জন্য কিছু করতে। শুরু করতে পেরেছি, সাড়াও পেয়েছি। অন্যরাও এমন উদ্যোগে এগিয়ে আসুক, এমনটাই প্রত্যাশা তার।