নারীমুক্তি ও ক্ষমতায়ন

68

দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারীদের পিছিয়ে রেখে দেশ,সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধন সম্ভব নয়। যদিও বর্তমানে আমাদের দেশে নারীরা অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে। নারী ক্ষমতায়নের কথা বললে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী ,এমপি সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন নারীদের কথা চলে আসে। এসব ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে গেছেন তাঁদের মেধা, স্বগুণ ও দক্ষতায়। তবে সার্ভিকবে এখনো আমাদের দেশে প্রকৃত নারীমুক্তি ও ক্ষমতায়ন আসেনি। আশির দশক থেকে নারীর ক্ষমতায়ন শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। নারীর ক্ষমতায়ন মানে নারী নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারা এবং বাস্তবায়নে সব বাধা বিপত্তি অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। বৈষম্যহীনভাবে নারী- পুরুষের সিদ্ধান্ত বা মতামতের সমান গুরুত্ব। সাংবিধানিকভাবে নিজের অবস্থান তৈরির অধিকার লাভ। রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণে সরাসরি নির্বাচনের অধিকার ও সকল অন্তরায় দূরীকরণে আইনগত পরিবেশ সৃষ্টি । অনেক ক্ষেত্রে নারীদের দুর্বল, অন্যের উপর নির্ভর ও যৌন চাহিদা মেটানোর বস্তু মনে করা হয়। নারীদের এগিয়ে যাবার পথে রয়েছে পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয়, কুসংস্কার, অশ্লীল কথা, বিদ্রুপ, যৌন নির্যাতন ,ধর্ষণ সহ নানা অন্তরায়। সম্প্রতি আলোচিত নুসরাত হত্যাকান্ড নারীমুক্তি ও স্বাধীনতার অন্তরায়ের চরম উদাহরণ। একজন নারী ভোগপণ্য হওয়া থেকে বাঁচতে সবার সহযোগিতা চেয়ে ব্যর্থ হয়ে মামলা করেন। এখানে যৌন নির্যাতন,হত্যাকারী, সহযোগী, প্রশাসন সবাই নুসরাতের বিপক্ষে। তাঁর চরিত্র হনন করেছে। প্রতিবাদের কারণে তাঁকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। আবাক করা বিষয় হল অভিযুক্তদের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা নারীও রয়েছে। আমাদের দেশে নারী নির্যাতনে অনেক ক্ষেত্রে নারীরাও জড়িত থাকে। এখানে সব পুরুষ ও নারী একজন নুসরাতের প্রতিপক্ষ। কারণ নুসরাত একজন নারী। তাঁকে হয়ত ভোগ্যপণ্য হতে হবে অথবা মরতে হবে। নুসরাত মরণকে বেচে নিয়েছে । নুসরাত যখন থানায় অভিযোগ করে ওসি তাঁকে অশ্লীল প্রশ্ন ও বক্তব্য ভিডিও করে । ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। আমাদের দেশে অধিক যোগ্যতা থাকার পরেও শুধু নারী হওয়ার কারণে পুরুষদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। অবলা শব্দের অযৌক্তিক ব্যবহারে নারীদের পিছিয়ে রাখা হয়। জম্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নারীদের কোননা কোন অধীন থাকতে হয়। নিজের মত, স্বাধীনতা,চাওয়া,জগত থাকেনা। বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের পথিকিৃৎ বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, “এদেশের মেয়েরা সব অবস্থাতেই অভিভাবকদের বাড়িতে থাকে। প্রাণী জগতে সবার ঘর আছে নেই শুধু মেয়েদের । পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর আলাদা কোন জগৎ নেই। পুরুষের জগতে নারীদের বাস করতে হয়। নারীদের মনে করা হয় প্রজনন ক্ষমতা সম্বলিত একটি প্রাণী বিশেষ। শারিরীক গঠন ও মানসিকতা,মেধায় দুর্বল। তাই নারীরা বংশ বৃদ্ধি ও গৃহস্থালী কাজে ব্যস্ত থাকবে । বাইরের কাজে তাদের যাওয়ার দরকার নেই। দু’শ বার বছর আগে ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে বত্রিশ বছরের তরুণী নারীবাদের জননী মেরি ওলষ্টোনক্রাফট তাঁর ‘ভিনিডকেশন অব দি রাইটস অব ওমেন’ নামক বইতে পৃথিবীতে সর্ব প্রথম নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলেছিলেন। বইটি প্রকাশের পর তাঁকে রক্ষণশীলদের কাছে অনেক ধিক্কার, নিন্দিত হতে হয়েছিল। তাঁর বইটি মূলত নারী স্বাধীনতা,সমঅধিকারের বিপ্লব সূচনা করেছিল। মেরি বলেছিলেন, আমি পুরুষকে ভালোবাসি আমার সমকক্ষ হিসেবে, প্রভু হিসেবে নয়। নারীকে তার অধিকার, জগত সৃষ্টির জন্য নিজেকে এগিয়ে আসতে হবে। বাধা,বিঘœ অতিক্রম করতে হবে। দৃঢ় মনোবল নিয়ে সর্বোচ্চ পদ অলংকরণের অবিরাম চেষ্টা করতে হবে। ১৯৯৪ সালে কায়রোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলনে প্রথমবারের মত নারীর ক্ষমতায়নকে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ঘোষণা করে । ১৯৯১ সালে সরকার নবম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রী উপবৃত্তি ও প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক নিয়োগে ৬০ ভাগ কোটা নির্ধারণের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নতুন মাত্রা পায়। ১৯৯৭ সালের ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ঘোষণার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সর্বত্র নারী অধিকার আরো বেগবান হয়। বিগত ২৮ বছর ধরে বাংলাদেশে সরকার ও বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী হওয়ার কারণে দেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও স্বাধীনতায় অভুতপূর্ব উন্নয়ন হলেও আমাদের সার্বিক মানসিকতার পরিবর্তন না হওয়ার কারণে আমরা প্রকৃত নারীমুক্তি ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। আমাদের দেশের বৃহৎ রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে সিংহাভাগ নারী শ্রমিক কর্মরত। যাদের ঘামের উপর দাড়িয়ে আমরা প্রবৃদ্ধির ছক তৈরি করি । সেই নারীরা পদে পদে অবহেলিত ও নির্যাতিত। সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৪ জেলার আদালতে ১ লাখ ৬০ হাজার ৭৫১ টি নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে বাংলাদেশে নারী নির্যাতন সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ধর্ম ,পারিবারিক ও সামাজিক রীতিনীতির দোহাই দিয়ে নারীদের অধিনস্থ করে রাখার নীতি চলে আসছে। তারপরেও অনেকে কঠিন বাধা পেরিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তথা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন, আইন অমান্যকারী আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, ভোটাধিকার আন্দোলন, ভারত ছাড় আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল। পাকিস্তান আমলে নারী আন্দোলন বাধার সম্মুখিন হলেও কিছু নারী সংগঠন নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেছিল। তম্মধ্যে গেশ্চারিয়া মহিলা সমিতি, ওয়ারী মহিলা সমিতি উল্লেখযোগ্য। ১৯৭০ সালে ৪ এপ্রিল বেগম সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে পাকিস্তান মহিলা পরিষদ ( বর্তমানে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠন নারীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ভুমিকা পালন করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা অনন্য ও বীরত্বপূর্ণ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নারীরা পুরুষের মতোই সকল সেক্টরে যুদ্ধ করেছিলেন। সশস্ত্র যুদ্ধ ও কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনে নারীদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। নারীমুক্তি ও ক্ষমতায়নের জন্য নারীদের প্রতি মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। নারীদের মানুষ মনে করে তাঁদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। মানসিক সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে এসে সকলে জাতি গঠনে মনোনিবেশ করতে হবে। দেশ ও জাতিকে অনন্য উচ্চতা ও সভ্যতা পৌঁছাতে নারীমুক্তি ও স্বাধীনতার বিকল্প নেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক