নারায়ণগঞ্জ ট্র্যাজেডি : তদন্ত প্রতিবেদনে কী আছে

19

এশার নামাজ আদায়ের সময় ৪ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা বায়তুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। একজন বাড়ি ফিরলেও চিকিৎসাধীন রয়েছেন আরও চার জন। ইতিহাসের এই ভয়াবহতম বিস্ফোরণের পরপরই বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটির পাশাপাশি তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির পক্ষ থেকেও একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু প্রথম দফায় পাঁচ দিন শেষে ১০ সেপ্টেম্বর আরও চার দিন সময় চাইলে গড়িমসির অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। অবশেষে ৯ কার্যদিবস সময় নিয়ে মসজিদ কমিটি এবং দুজন গ্রাহকের ওপর দায় চাপিয়ে নারায়ণগঞ্জ মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলো তিতাস। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের হাতে এই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। এ সময় জ্বালানি সচিব আনিছুর রহমান, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আব্দুল ফাত্তাহ, তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মো. মামুন, তদন্ত কমিটির প্রধান আব্দুল ওয়াহাব তালুকদার উপস্থিত ছিলেন।
এক সংবাদ সম্মেলনে তিতাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই বিস্ফোরণে তিতাসের কোনও দায় নেই। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী বলেন, দায় শুধু এককভাবে কাউকে দেওয়া যাচ্ছে না। তিতাসের পাইপলাইনে যেমন সমস্যা ছিল, তেমনি গ্রাহকেরও দায় আছে। দুই পক্ষেরই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। তিতাসের প্রতিবেদন আমরা আজ হাতে পেলাম। এখন সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো। ডিপিডিসির অবৈধ লাইনের বিষয়ে তদন্ত চলছে এখনও। কেউ দায়ী হলে তিতাসের মতোই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা ইতোমধ্যে তিতাসের ৮ জন কর্মকর্তা কর্মচারীকে বরখাস্ত করেছি। তিতাসের লিকেজ মেরামতসহ পুরনো পাইপলাইন বদলে নতুন পাইপলাইন করার বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী।
কী আছে তদন্ত প্রতিবেদনে : তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে কমিটির প্রধান জানান, টিনশেড মসজিদটি ১৯৯৬ সালে পাকা ভবনে রূপান্তরিত করা হয়। এর আগে ১৯৮৭ সালে তিতাস গ্যাসের এক ইঞ্চি ব্যাসের নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হয়, যা থেকে ৩টি আবাসিক সংযোগ দেওয়া হয়েছে; যার একটি ছিল মসজিদের দক্ষিণে এবং অপর দুটি মসজিদের উত্তর দিকে। মসজিদের উত্তর পাশের রাস্তায় সংযোগ দুটির সার্ভিস লাইন প্রায় চার ফুট মাটির নিচে ছিল। মসজিদের পূর্ব পাশে তিতাস গ্যাসের এক ইঞ্চি ব্যাসের একটি বিতরণ লাইন রয়েছে। তাছাড়া মসজিদের উত্তর পাশের রাস্তায় দুটি ৩ বাই ৪ ইঞ্চি ব্যাসের পরিত্যক্ত সার্ভিস লাইন রয়েছে। সেই সার্ভিস লাইনের নিচ দিয়ে মসজিদের উত্তর-পূর্ব থেকে উত্তর দিকের ৪নং কলামের বেইজ নির্মাণ করা হয়েছে। বেইজ নির্মাণ করার সময় মাটি খনন, সাটারিং স্থাপন কাজে কোদাল, গেতি, হাতুড়ি ব্যবহার হয়েছে। তাতে ‘মেকানিক্যাল ড্যামেজ বাই এক্সটারনাল ত্রাস্ট’-এর জন্য পাইপের উপরিভাগ দেবে গেছে এবং গ্যাস লাইনের রেপিং নষ্ট হয়েছে, ফলে গ্যাস পাইপ (এমএস পাইপ) মাটির সংস্পর্শে আসে এবং মরিচাজনিত কারণে পাইপে লিকেজ সৃষ্টি হয়েছে। মসজিদ কমিটি মসজিদের কলামের বেইজ তৈরি করার সময় তিতাস গ্যাসকে অবহিত করলে ওই সার্ভিস লাইন অপসারণ করতে বা ক্ষতিগ্রস্ত রেপিং মেরামত করে দিতো। তাহলে লিকেজ সৃষ্টি হতো না।
তিনি আরও জানান, মসজিদের উত্তর দিকের পূর্ব-পশ্চিম বরাবর ৪ ফুট পুরুত্ববিশিষ্ট আরসিসি ঢালাই করা রাস্তা। গ্যাস লাইন লিকেজ হওয়ার পর লিকেজ গ্যাস সরাসরি আরসিসি ঢালাই বিশিষ্ট রাস্তা ভেদ করে ওপরে আসতে পারেনি কিন্তু পাইপ লাইনের পাশেই (মাত্র ১৬ ফুট দক্ষিণে) মসজিদের দেয়াল। কিন্তু সেই দেয়ালের নির্মাণ মান খুবই খারাপ ছিল বা দেয়ালে আস্তরণ ছিল না। তাছাড়া পাকা বাড়ি বা মসজিদ নির্মাণের সময় মানসম্মত ফ্লোর নির্মাণ করার বিধান রয়েছে, যা এখানে করা হয়নি। ফলশ্রæতিতে ফ্লোর টাইলসের সংযোগস্থল থেকে গ্যাস বের হতে পারে। আবার মসজিদের নিচের মাটির কম্পাকশন ঠিক ছিল না। মসজিদের নিচের মাটি যথাযথ না থাকায় গ্যাস সরাসরি ওপরের দিকে বের হতে পারেনি। এ কারণে গ্যাস মসজিদের ভেতরে চলে যেতে পারে এবং ফ্লোরের বিভিন্ন স্থানে টাইলসের সংযোগস্থল থেকে বের হতে পারে। আবার লিকেজস্থল থেকে প্রায় ৪০-৫০ ফুট দূরে মসজিদে প্রবেশপথ (কলাপসিবল গেট) পর্যন্ত গ্যাস প্রবাহিত হতে পারে ও কলাপসিবল গেটের নিচ দিয়ে গ্যাস বের হতে পারে। এসব বিষয়ের কারণে মসজিদ নির্মাণকাজের ত্রæটিগুলো নিশ্চিত হওয়া গেছে।
তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর : এদিকে বিদ্যুতের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মসজিদে দুটি বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। যার মধ্যে একটি সংযোগ ছিল বৈধ এবং অপর সংযোগটি মিটারবিহীন এবং অবৈধ। উক্ত বৈধ ও অবৈধ সংযোগ দুটির মধ্যে একটি চেঞ্জ ওভার ছিল। একটি ফিডারের বিদ্যুৎ চলে গেলে অন্য ফিডার থেকে তারা অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতো। অপর দিকে বৈধ সংযোগটি তিন ফেইজবিশিষ্ট কিন্তু অবৈধ সংযোগটি সিঙ্গেল ফেইজবিশিষ্ট ছিল। মসজিদ কমিটির সভাপতি জনাব আ. গফুর সাহেব বিষয়টি স্বীকার করে বিভিন্ন মিডিয়াসহ তদন্ত কমিটির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। এখানে উল্লেখ্য, চেঞ্জ ওভার সুইচ ব্যবহার করে বিদ্যুতের ফিডার পরিবর্তন করার সময় কম-বেশি স্পার্ক হয়। গত ৪ সেপ্টেম্বর রাত ৮টা ৪০ মিনিটে বিদ্যুতের লোডশেডিং হওয়ায় মসজিদের মুয়াজ্জিন চেঞ্জ ওভার দিয়ে বিদ্যুতের ফিডার পরিবর্তন করার সময় স্পার্কের সৃষ্টি থেকে মসজিদে জমে থাকা গ্যাসে আগুন ধরে বিস্ফোরণ বা অগ্নিদুর্ঘটনার সৃষ্টি হতে পারে।
তদন্ত কমিটির মতামত ও সুপারিশে দায়ী করা হয় ওই এলাকার দুজন গ্রাহককে। বলা হয়, মসজিদের উত্তর পাশের পূর্ব-পশ্চিম সড়কে তিন ইঞ্চি ব্যাসের বিতরণ লাইন নির্মাণের পর আগে স্থাপিত এক ইঞ্চি ব্যাসের বিতরণ লাইন হতে আবাসিক সংযোগ নেয় মো. শওকত আলী এবং মো. বারেক দেওয়ান। তারা তিন ইঞ্চি ব্যাসের বিতরণ লাইনে তিতাস গ্যাসের রাইজার স্থানান্তর বিষয়ক নিয়ম-কানুন না মেনে, তিতাস গ্যাস নারায়ণগঞ্জ অফিসকে না জানিয়ে, নিজেদের উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে অনভিজ্ঞ কোনও ওয়েন্ডার দিয়ে রাইজার দুটি স্থানান্তর করেছেন এবং রাইজার দুটির দৃশ্যমান অংশ কেটে ফেলেন। তিতাসের লোক স্থানান্তর করলে সার্ভিস লাইন ও সার্ভিস লাইনের সংযোগস্থল থেকে বিচ্ছিন্ন করা হতো। এতে এই দুর্ঘটনার সৃষ্টি হতো না। অর্থাৎ এই দুই গ্রাহক নিয়মবহির্ভূতভাবে রাইজার স্থানান্তর করায় এই দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে এবং সে জন্য তারা দায়ী।
এদিকে মসজিদে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে তদনত্ প্রতিবেদনে পুরো দোষ চাপানো হয়েছে মসজিদ কমিটির ওপর। বলা হয়, গ্যাস নিজে নিজে জ্বলতে পারে না। অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়ার জন্য মসজিদ কমিটি দায়ী। মসজিদ কমিটি দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার কযেক দিন আগে থেকেই মসজিদে গ্যাসের গন্ধ পাচ্ছিলেন। তারপরও মসজিদ কমিটি এসি অংশের দরজা জানালা বন্ধ করে এসি চালিয়ে নামাজ আদায় করেছেন কিন্তু নিরাপত্তার জন্য মুসল্লিদের সতর্ক করা হয়নি। মসজিদ কমিটির অজ্ঞতা-অসচেতনতার জন্য এবং মসজিদে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য এই দুর্ঘটনার সৃষ্টি হতে পারে। তাই এর দায়ভার তাদের ওপর বর্তায়।
এদিকে কমিটি আরও জানায়, মসজিদটি নির্মাণ ও তৃতীয় তলাবিশিষ্ট মসজিদ ভবন নির্মাণ করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়নি, যা মসজিদ কমিটির তাদের বক্তব্যে উল্লেখ করেছে।
অপরদিকে এই দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন মিডিয়াতে গ্যাস লিকেজ মেরামতের জন্য তিতাস গ্যাসের লোকজন তাদের কাছে ৫০ হাজার টাকা চেয়েছে বলে মসজিদ কমিটির সভাপতি একটি অভিযোগ এনেছিলেন। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি, মসজিদ কমিটির সভাপতি ও জমিদাতার কাছে বিষয়টি বিস্তারিত জানতে চাইলে, তারা দুজনই তাদের লিখিত জবাবে এ বিষয়ে কিছুই জানেন না মর্মে উল্লেখ করেন। তবে ১৪-১৫ দিন আগে মসজিদ কমিটির সেক্রেটারির থেকে তারা বিষয়টি শুনেছেন মাত্র বলে জানান।
এদিকে এই অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তিতাস গ্যাস নারায়ণগঞ্জ অফিসের গত ছয় মাসের অভিযোগ রেজিস্ট্রার পরীক্ষা করে কোনও কিছু পাওয়া যায়নি। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কাছে তিতাসের কোন লোক টাকা চেয়েছে, তার নাম, পদবি, ফোন নম্বর ইত্যাদি চাওয়া হয়। তবে তারা এ বিষয়ে কোনও তথ্য দিতে পারেননি। আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য স্থানীয় কমিশনার, মসজিদের মুসল্লিসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের সাক্ষাৎকারে এই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ তদন্তে অভিযোগটির ভিত্তি প্রমাণাদি পাওয়া যায়নি। কিন্তু মসজিদ কমিটির সভাপতির এ ধরনের মিথ্যা বক্তব্যে তিতাস গ্যাসের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে।
এর বাইরে তদন্ত প্রতিবেদনে নারায়ণগঞ্জ তিতাসের অধীনে থাকা গ্যাস পাইপ নেটওয়ার্ক, বিভিন্ন শ্রেণির সংযোগ ইত্যাদি পরিদর্শন করে লিকেজ শনাক্ত করা এবং লিকেজ স্থান অবিলম্বে মেরামতের ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়। তাছাড়া ওই অফিসকে তাদের নিয়ন্ত্রিত নেটওয়ার্কে স্বল্প সময় পর পর পরীক্ষা বা পরিদর্শনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়। এই সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় জনবল ও লজিস্টিকের জোগান দিতে কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।