নামে পণ্য পরিবহন কাজে ইয়াবা পাচার

38

সারাদেশে পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন শ্রেণির যানবাহন ও পরিবহন শ্রমিকদের একটি অংশের সাথে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে ইয়াবা চোরাকারবারি চক্র। এমনকি মাদক ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ আবার অর্থ বিনিয়োগ করেছে পণ্য পরিবহন ব্যবসায়। মিয়ানমারে উৎপাদিত মাদক ইয়াবা সীমান্ত পেরিয়ে উখিয়া, টেকনাফ কিংবা কক্সবাজার আসার পর চোরাকারবারি চক্রের সিন্ডিকেট তাদের মালিকানায় থাকা ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনে করেই এখন দেশ ও দেশের বাইরে পাচার করছে। স্বীকৃত ব্যবসার আড়ালে মূলত ইয়াবা পাচারই তাদের অন্যতম কারবারে পরিণত হয়েছে
সর্বশেষ গত ২ ফেব্রুয়ারি নগরীর বন্দর থানা এলাকার মনছুর মার্কেটের সামনে একটি পণ্যবাহী ট্রাকে তল্লাশি চালিয়ে ৩০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করে বন্দর থানা পুলিশ। এসময় মো. খুরশিদ (৩০), মো. ইলিয়াছ (২৮) ও আবু বক্কর সোহাগ (২৫) নামে তিনজনকে আটকের কথাও জানায় পুলিশ। তারা প্রত্যেকেই পরিবহন শ্রমিক হলেও প্রকৃতপক্ষে মাদক পাচারের কারবারে জড়িত। এরকম পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত অনেক যানবাহন এবং পরিবহন শ্রমিকদের একাংশ মূল ব্যবসার আড়ালে মাদকের কারাবারে জড়িত বলে পুলিশের দাবি। নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (বন্দর) এস এম আরেফিন জুয়েল বলেন, ‘গ্রেপ্তার তিনজনই ট্রাকে পণ্য পরিবহনের আড়ালে মূলত দেশজুড়ে ইয়াবা পাচারে জড়িত। পাচারের সুবিধার্থে তারা ট্রাকের বডিতে বিশেষ কায়দায় গোপন কুঠুরিও বানিয়ে নিয়েছে। কক্সবাজার থেকে পণ্য লোড করার পাশাপাশি তারা ওই গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে ইয়াবা নিয়ে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিত। গোপন কুঠুরি থেকেই ইয়াবাগুলো জব্দ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা ট্রাকে পণ্য পরিবহনের আড়ালে দেশব্যাপী চুক্তিতে ইয়াবা সরবরাহ করত বলে জানিয়েছে। তাদের মত আরও অনেকেই একই কায়দায় ইয়াবা পাচারে জড়িত থাকার তথ্যও দিয়েছে। ’
এদিকে, বিক্রি কিংবা পাচারে নিয়োজিত ব্যক্তিরা হরহামেশা এবং প্রভাবশালী অনেক মাদক কারবারি বিভিন্ন সময় ধরা পড়লেও আইনি ফাঁকফোকর কিংবা রাজনৈতিক প্রভাবে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট দুর্বলতার কারণে জামিনে মুক্তি থেকে শুরু করে মামলা থেকে খালাসও পেয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জামিনে মুক্তির পর তারা আর্থিক প্রলোভন বা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সাক্ষীদের আদালতে হাজির হওয়া থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করে। এসব কারণে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ দুরূহ হয়ে পড়ায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শেষপর্যন্ত মাদক নির্মূলে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বেছে নিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মাদকদ্রব্য হেফাজতে রাখাকেই শুধু অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। সুতরাং ওই অপরাধের পেছনে থাকা গডফাদারদের আইনের আওতায় আনার সুযোগ নেই। ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৯ ধারায় আইন ভঙ্গের শাস্তি সম্পর্কে বলা আছে। তবে, ওই ধারায় মাদকদ্রব্যের শ্রেণিবিন্যাস করা হয়নি। ১৯(২) ও (৩) ধারায় ক, খ ও গ শ্রেণির মাদকদ্রব্য চাষাবাদ, উৎপাাদন বা প্রক্রিয়াজাত করা বা বিক্রয় করার জন্য শাস্তির কথা বলা হয়েছে। আইনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, কেউ যদি মাদকদ্রব্য চাষাবাদ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, ধারণ, বিক্রয়, বহন, পরিবহন, সরবরাহ, আমদানি, রপ্তানি, গুদামজাত, প্রদর্শন, প্রয়োগ ও ব্যবহার করে তাহলে সেই ব্যক্তি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে শাস্তির আওতায় আসবে। এসব ক্ষেত্রে শাস্ত দিতে হলে মাদকদ্রব্য দখলে রাখার ওপরই জোর দেয়া হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, দখল শব্দের অর্থই হচ্ছে, পরোক্ষ দখল নয়, বরং প্রকৃত দখল। মাদকদ্রব্য নিয়ে নিরীহ ব্যক্তিকে পুলিশের হয়রানি করার নজির থাকায় দখল সম্পর্কে উচ্চ আদালতও বিভিন্ন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, দখল বলতে শারীরিক দখলকে বোঝাবে। এ কারণেই ঘটনার নেপথ্যে থাকা শীর্ষ মাদক চোরাকারবারিদের আসামি করা হয় না।
এ বিষয়ে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘আসামি পক্ষ মামলা থেকে রেহাই পেতে ফাঁকফোকর তো খুঁজে বের করবেই। তাই চিহ্নিত মাদক কারবারিদের ক্ষেত্রে মামলা দায়েরের সময় অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু দখল নয়, নিয়ন্ত্রণকারীকেও শাস্তির আওতায় আনার জন্য আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা উচিত।
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক অফিসের (ইউএনওডিসি) তথ্যমতে, ইয়াবার স্বর্গভূমি মিয়ানমার দক্ষিণ এশিয়ার ‘ড্রাগ ল্যান্ড’ বলে পরিচিত। লাওসের উত্তরাঞ্চল, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের কিয়দংশ মিলেই ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল’। আফিম ও হেরোইন বাণিজ্যে এক সময় কুখ্যাত ছিল এ অঞ্চলটি। পৃথিবীতে আফিমের মোট চাহিদার অর্ধেকের বেশি যোগান দিত এই অঞ্চল। ১৯৯৩ সালে মিয়ানমার একাই উৎপাদন করেছিল ১৮ শ’ মেট্রিক টন আফিম। এর এক দশক পর তিনটি দেশই (লাওস, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার) মাদক নিধন কর্মসূচি গ্রহণ করায় ফল এসেছিলো হাতেনাতে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে বছরে আফিম উৎপাদন নেমে এসেছিল তিনশ’ ৫০ মেট্রিক টনে। আর গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলে ব্যাপক নজরদারির কারণেই দারুণ লাভজনক পপি চাষের বিস্তার ঘটেছিল আফগানিস্তান ও কলম্বিয়ায়। এই দুটি দেশে শুরুতে পপি চাষে ঝুঁকি বলতে কিছুই ছিল না। দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশিরভাগ দেশেই ইয়াবা সরবরাহ করে মিয়ানমার। তারাই বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে মিলে মাদকের এই ছড়াছড়িতে জড়িত। মিয়ানমারে উৎপাদিত মাদক অতীতে থাইল্যান্ড হয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বিস্তার লাভ করলেও বর্তমান প্রধান গন্তব্য চিন অভিমুখে। আর পাচারের প্রধান রুট হচ্ছে বাংলাদেশ। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার শুরু হয় ২০০৬ সাল থেকে। ২০১২ সালে চীন ও থাইল্যান্ডের মধ্যে চুক্তির পর মিয়ানমারের মাদক উৎপাদনকারীদের জন্য সেসব দেশে ইয়াবা পাচার কঠিন হয়ে পড়ে। তখন তারা বাংলাদেশকেই মাদক পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। মিয়ানমারের ওয়া এবং কোকাং নামের আদিবাসী স¤প্রদায় মেথাএম্ফিটামিনযুক্ত বড়ি বা ইয়াবার প্রধান উৎপাদনকারী। এই দুই গোষ্ঠীর লোকজন একসময় আফিম ও হেরোইন উৎপাদনে জড়িত ছিল। সংস্থাটির ২০১৭ সালের হিসাবে, মিয়ানমারের কাচিন ও শ্যান স্টেটে আফিম উৎপাদনে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ ৪১ হাজার হেক্টর। এখন ইয়াবা পাচারের জন্য রুট হিসেবে বেছে নেয়া বাংলাদেশ কার্যত ভিকটিমে পরিণত হয়েছে। দেশের বিরাট জনগোষ্ঠী মাদকের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ মাদকসেবী হওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ভূমিকা বিশেষভাবে দায়ি। মিয়ানমারের ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল’ যদি জিরোতে চলে আসে, তাহলে বাংলাদেশে ইয়াবার প্রবেশও অনেকাংশে জিরো হয়ে যাবে।