নানাভাই ও পিন্টু

69

সারারাত বিড়ালটা কাঁদতে লাগলো মিউ মিউ করে। নানা ভাইয়াকে যেখানটায় রাখা হলো তার আশপাশে ঘুরঘুর করতে লাগলো। কখনো বা পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকলো প্রিয় মানুষটার কাছ ঘেঁষে। চোখের কিনারগুলো কান্নার ভেজা দাগ লেগে কালো হয়ে আছে। সাদা ধবধবে গায়ের রং হওয়াতে কান্নার দাগটা ফুটে উঠেছে বেশী। মামা খালামণি আম্মা সবাই নানা ভাইয়ার শোকে কাতর। বাবাকে হারিয়ে সবাই দিকভ্রান্তের মতো আজ। নানুমণি মারা যাওয়ার পঁচিশ বছর পর নানাভাই পৃথিবী ছাড়ল।
দু’যুগের ও বেশী সময় একা একা পার করে দিলো আমার নানাভাই। কোন শখ আহ্লাদ অপূরণ রাখেনি ছেলে-মেয়েরা। বাবার সেবার যেন হেরফের না হয় তাই পালা করে দেখতো নানাভাইকে। একমাস বড় খালা তো তারপরের মাস ছোট খালা। আবার কখনো আমার মা। এভাবে পঁচিশটা বছর কোন দিকে চলে গেলো কেউ বুঝতেও পারলোনা।
নানাভাই বিশাল দেহী মানুষ ছিলেন। আমরা নাতী নাতনীরা নানাভাইয়ের ব্যক্তিত্বকে ভয় পেতাম বেশী। সকাল সকাল ঘুম থেকে ডাকতো আমাদের । সাথে একটা কথা আওড়াতো সবসময়
-আমি এতক্ষণে রেঙ্গুন চলে গেছি ব্যবসা করতে। আর তোরা পরে পরে ঘুমাস।
হাতে কাঠের কারুকাজ করা একটা লাঠি থাকতো। ঐ লাঠিটা দিয়ে গুঁতো মেরে মেরে বলতো——
উঠলে উঠ—- না হয় পানি ঢেলে দিচ্ছি। এই দিলাম বলে—
পড়িমরি করে উঠে দৌড় লাগাতাম উনার সামনে থেকে।
ঘুম থেকে তুলতে পেরে উনার সে কি হাসি। কথাগুলো আবার সবাইকে বলে বেড়াতো। নানাভাইয়ের খাবার খাওয়ার টেবিলটাও ছিলো রেঙ্গুন থেকে আনা। ছোটখাটো সুন্দর। নক্সা করা। শুধু উনার জন্য বরাদ্দ ছিলো ওটা। আমরা কেউ কোনদিন ঐ টেবিলে বসে খাইনি। আম্মার খালাদের নিষেধ ছিলো। উনি যখন খেতে বসতো উনার পায়ের কাছে একটা সাদা ধবধবে বিড়াল বসে থাকতো। নানাভাই বিড়ালটার সাথে কথাও বলতো। এটা ওটা খেতে ও দিতো। যতক্ষণ খাওয়া শেষ হতোনা ওটা ঠায় বসে থাকতো। আর মজা করে খেতো চেয়ারে বসা মনিবের সাথে।
মাঝেমধ্যে দেখতাম লাঠি দিয়ে তাড়া করতে। উনার বিছানা ভিজিয়ে দিয়েছে তাই। আমরা যেখানে নানাভাইয়ার বিছানা শোয়া তো দূরের কথা বসতেও পারিনি। সেখানে বিড়ালটা শখ করে বিছানায় উঠতো। আর উঠেই অঘটন ঘটাতো। তাতেই নানাভাইয়ার মেজাজ সপ্তমে চড়ত। তাড়া করে ধরতে তো পারতই না। বরং হাঁপাতে হাঁপাতে বলতো থথথথ
আসিস তুই আর আমার কাছে। তখন হাড়গোড় সব ভেঙে দেবো না তোর?
তারপর ধোয়া চার পাঁচদিন ধরে রোদে শুকানো। কত ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হতো ছোট খালামণির। দু’চারদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর রাতের বেলায় এসে হাজির হতো খাবারের সময়। দুর থেকে ডাকতো মিউমিউ করে। তাতেই মনিব গলে যেতো। আদর করে ডেকে খেতে দিতো দ্বিগুণ পরিমাণে। গত দু’চারদিনের খাবারসহ উসুল করে দিতো। তারপর নানাভাই আর তার কত কথা। লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে চোখ পিটপিট করে শুনতো সব কথা।
তুই এতদিন কোথায় ছিলিরে পিন্টু? আমি রাগের বশে তাড়া করেছি তাই বলে এত দিন? তোকে না দেখে আমার খুব মন খারাপ ছিলোরে এ কয়দিন। খেতেও পারিনি ভালো করে। খাওয়ার সময় তুই না থাকলে আমার ভালো লাগে নারে। আর খবরদার আমার বিছানায় উঠে অকাজ করবি না কিন্তু বলে দিলাম।
আদর করে নানাভাই বিড়ালটাকে পিন্টু ডাকতো। পিন্টু মিয়াও আদরে আহলাদে আটখানা। মিউমিউ ডাকটা বাড়িয়ে দিলো আরো।
আমরা নানাবাড়িতে গেলেই পিন্টুর খোঁজ নিতাম আগে। কিন্তু সে আমাদের পাত্তাই দিতোনা। সবসময় নানাভাইয়ার রুমে তার চৌহুদ্দিতে আনাগোনা। বিরাট ভাবসাব পিন্টু মিয়ার। আর যখন কুকাজগুলো করে নানাভাইয়ার বিছানায় তখন আমরা ও খুশীতে লাফাই। তার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা দেখে। আমাদের সাথে ভাব জমাতে আসে বিপদে পড়লে। তার আগে সে বিরাট জমিদার।
নানাভাইয়ার এ হঠাৎ চলে যাওয়া পিন্টুর মেনে নিতো খুব কষ্ট হলো। দুপুরে ও দুজন একসাথে খেলো।
কথা একটু কমই হয়েছে অবশ্য প্রতিদিনেরর তুলনায়। পিন্টু ভাবলো হয়তো মন খারাপ তাই। আসলে সারাদিন খারাপ লাগছে নানাভাইয়ার। বুঝতে দেয়নি কাউকে। তবে নানুমণিকে স্বপ্নে দেখলো পরপর কয় রাত। এটা বললো ছোট খালাকে। ছোট খালার মনে ও একটা দুঃশ্চিন্তা আসলো।
মনে মনে ভাবলো, বাবাটা মনে হয় চলে যাবে এবার মার কাছে। না হলে মা এত ঘনঘন দেখা দিচ্ছে কেন?
মাকে ছোটবেলায় হারিয়েছি। বাবাটা হারালে কাকে নিয়ে বাঁচব আমি? বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো তার।
নানাভাইকে যখন সমাহিত করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো পিন্টুও পিছন পিছন দৌড়ে কবর পাড়ে চলে গেলো। কবরে সমাহিত করার পর সবাই যার যার মতো ঘরে চলে গেলো। কিন্তু পিন্টু ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল কবর পাড়ে। হয়তো আশায় আছে নানাভাই তাকে ডেকে নিয়ে ঘরে ফিরবে। পিন্টু জানেনা ওর আশা আর কখনো পুরণ হওয়ার নয়। এর পর পিন্টুকে আর কেউ কোথাও দেখলো না। নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো প্রিয় মনিবের অন্তর্ধানে।