নাকের এলার্জি

1172

দেশের অসংখ্য মানুষের কাছে এক অসহনীয় ব্যাধি এলার্জি। এটি হাঁচি থেকে শুরু করে খাদ্য ও ওষুরের ভীষণ প্রতিক্রিয় ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে । হাঁটি হলো এবং নাক দিয়ে পানি পড়লো, এটা কোন রোগ হলো? প্রথম প্রথম কেউই এ লক্ষণগুলোকে রোগ বলে মনে করেন না । সবাই স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করেন এবং মনে করেন আপনা-আপনিতেই সেরে যাবে কিন্তু যখন তখন হচ্ছে বিশেষত পুরোনো জিনিসপত্র পরিষ্কার করতে গেলে বা ফুলের গন্ধ নেওয়ার সময় বা ফুলের বা ফুলের বাগানে পায়চারি করার সময় এবং প্রায় সময় যখন অনবরত হাঁচি বা নাক বন্ধ হয়ে যায় তখন এ লক্ষনগুলোকে রোগ হিসাবে ভাবতে শুরু করেন এবং নিজে নিজেই অথবা ওষুধের দোকানদারের সাথে আলাপ করে দু-একটি এন্টিহিস্টামিন খেতে শুরু করেন । এন্টিহিস্টামিন খেলে অবশ্য রোগের লক্ষন কিছুটা উপশম হয় । কিন্তু যখন বার বার হয় তখন স্থানয় যে কোন ডাক্তার এবং পরবর্তীতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শবনাপন্ন হন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তখন এন্টিহিস্টামিনের পাশাপাশী স্প্রে আকারে স্টেরয়েড নাকের নাসারন্ধ্রে ব্যবহার করতে বলেন। এতে অবশ্য রোগী পূর্বেব তুলনায় অনেক বেশি ভাল অনুভব করেন। কিন্তু দুঃখ হলো বাস্তব সত্য যে যতদিন নেসাল স্টেরয়েড ব্যবহার করেন তত দিনই ভাল থাকেন, যেই নাকের স্প্রে বন্ধ করেন তার সাথে সাথে না হলেও কিছুদিন পরই শুরু হয় তার সেই পূর্বাবস্থা, এগুলো হলো আপনি এলার্জিজনিত রোগে বিশেষত এলার্জিক রাইনাইটিস রোগে ভুগছেন ধরে নিতে হবে । তাহলে এই এলার্জিক রাইনাইটিস রোগটি কি, কেন হয় এবং কিভাবে এড়ানো যায় তা নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। এলার্জিক রাইনাইটিস রোগটি হলো এলার্জিজনিত নাকের প্রদাহ। উপসর্গগুলো হচ্ছে অনবরত হাঁটি, নাক চুলকানো, নাক দিয়ে পানি পড়া এবং নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, কারো কারো চোখ দিয়ে পানি পড়া এবং চোখ লাল হয়ে যায়।
প্রকারভেদ :
সারা বছর সার্বক্ষনিক এলার্জিক রাইনাইটিস : সারা বছর ধরেই এই রোগের লক্ষন দেখা দেয়। বিশেষ করে পুরাতন ধুলাবালি (যাতে মাইট থাকে), ছত্রা বা পোষা প্রাণীর লোম সংস্পর্শে এলেই এর লক্ষন শুরু হয় ।
ঋতুনির্ভর এলার্জিক রাইনাইটিস : অনেক ঋতুতে ফুলের রেনু আধিক্য থাকে এবং ঐ রেনুর সংস্পর্শ এলেই রোগের লক্ষন গুলো দেখা দেয়। সাধারণত গ্রীষ্মের শেষে এবং বর্ষা ও শরতে এ রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।
বারবার রোগাক্রান্ত হওয়ার মাত্রাঃ যদিও বাংলাদেশে কতজন এই রোগে ভুগে থাকেন তার সঠিক তথ্য নেই তবে মোট জনগনের ১০-১৫ ভাগ ভোগে থাকেন বলে অনেকের ধারণা । বিশ্বের কোনও দেশ, বিশেষত অস্ট্রেলিয়াতে ৩০ ভাগ জনগণ এ রোগে ভোগে থাকেন।
যদিও এ রোগের লক্ষন যে কোন বষসেই দেখা দিতে পারে তবে শিশুদেরই এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায বেশি। যদিও এ রোগটি বংশানুক্রমিক তথাপি বার বার একই এলারজেনের সংস্পর্শে এলেই রোগের লক্ষন দেখা দিতে পারে।
তাছাড়া নতুন পোষাপ্রাণী অথবা বাসস্থান পরিবর্তনে নতুন পরিবেশে এলার্জিক রাইনাইটিস রোগের লক্ষন প্রকট আকার ধারন করতে পারে।
কিভারে এলার্জি নারে উপসর্গগুলো ঘটায় : যে সমস্ত রোগীদের বংশানুক্রমিক ভাবে এলার্জি হওয়ার প্রবনতা বেশি থাকে তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় কিছু কিছু এলারজেনের সংস্পশে এলে রক্তের আইজিই এর মাত্রা অনেক বেড়ে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গাতে বিশেষত নাকে অবস্থিত মাস্টসেল নামক এক ধরনের কোষের সঙ্গে লেগে থাকে। কোনও ভাবে শরীর আবার এই এলারজেনের সংস্পর্শে এলে মাস্টসেলগুলো ভেঙে যায় এবং এর থেকে ভাসো একটিভএমাইনো নির্গত হয় এবং এই রাসায়নিক পদার্থগুলো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং উপসর্গগুলো ঘটায় ।
এ রোগের সম্ভাব্য কারণগুলো হলোঃ মাইট (যা পুরাতন ধুলা বালিতে থাকে) ঘরের ধুলা ময়লা, ফুলের বেনু, প্রাণীর পশম বা চুল, প্রসাধন সামগ্রী।
প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা কি? বক্ত পরীক্ষ বিশেষত : ইয়োসিনোফিলের মাত্রা বেশি আছে কিনা তা দেখা।
সিরাম আইজিই এর মাত্রা ঃ সাধারণত এ্যালার্জি রোগীদের ক্ষেত্রে আইজিই এর মাত্রা বেশি থাকে । স্কিন প্রিক টেস্ট : এই পরীক্ষায় রোগীর চামড়ার উপর বিভিন্ন এলারজেন দিয়ে পরীক্ষা করা হয় এবং এই পরীক্ষাতে কোন কোন জিনিসে এলার্জি আছে ধরা পড়ে। সাইনাসের এক্স-রেঃ
সমন্বিতভাবে এ রোগের চিকিৎসা হলো :
এলারজেন পরিহার : যখন এলার্জির সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় তখন তা পরিহার করে চললেই সহজ উপায়ে এলার্জি নিয়ন্ত্রন করা যায়।
ওষুধ প্রয়োগ : ওষুধ প্রয়োগ করে সাময়িকভাবে এলার্জির উপশম অনেকটা পাওয়া যায় । এ রোগের প্রধান ওষুধ হলো এন্টিহিস্টামিন ও নেজাল স্টেরয়েড। এন্টিহিস্টামিন, নেসাল স্টেরয়েড ব্যবহার রোগের লক্ষন তাৎক্ষনিক ভাবে উপশম হয়। যেহেতু স্টেরয়েডের বহুল পাশ্ব প্রতিক্রিয়া তাই এ ওষুধ এক নাগাড়ে বেশিদিন ব্যবহার করা যায় না। যতদিন ব্যবহার করা যায় ততদিনই ভাল থাকে এবং ওষুধ বন্ধ করলেই আবার রোগের লক্ষনগুলো দেখা দেয়।
এলার্জি ভ্যাকসিন বা ইমুনোথেরাপী : এলার্জি দ্রব্যাদি থেকে এড়িয়ে চলা ও ওষুধের পাশাপাশি ভ্যাকসিন বা ইমুনোথেরাপী এলার্জিক রাইনাইটিস রোগীদের সুস্থ থাকার অন্যতম চিকিৎসা পদ্ধতি।
এলার্জি ভ্যাকসিনের মূল উদ্দেশ্য হলো যে মাইট দ্বারা এলার্জিক রাইনাইটিস সমস্যা হচ্ছে সেই মাইট এলারজেন স্বল্পমাত্রায় প্রয়োগ করা হয়। ক্রমান্বয়ে সহনীয় বেশি মাত্রায় দেওয়া হয় যাতে শরীরের এলার্জির কোন প্রতিক্রিয়া দেখা না দেয় কিন্তু শরীরের ইমিউন সিস্টেমের পরিবর্তন ঘটায় বা শরীরের এলার্জির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলে অর্থাৎ আইজিই-কে আইজিজি-তে পরিণত করে, যাতে দীর্ঘমেয়াদি এলার্জির ওষুধ দ্বারা নিয়ন্ত্রন করা যায়।
যদিও ওষুধে উপসর্গের কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসে কিন্তু এলার্জির কোন পরিবর্তন করতে পারে না, বিশেষত স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ এলার্জির জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী এবং এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অনেক। যেহেতু এই ওষুধ বেশিদিন ধরে ব্যবহার করতে হয় তাআ এব পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাড়ায়। তাই এ ধরনের এলার্জিক রাইনাইটিসের ক্ষেত্রে ইমুনোথেরাপী বা ভ্যাকসিন বেশি কার্যকর।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বিশেষত উন্নত দেশগুলোতে ও পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে । বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এই ভ্যাকসিন পদ্ধতির চিকিৎসাকে এলার্জিক রাইনাইটিস রোগের অন্যতম চিকিৎসা বলে অভিহিত করেন । এটাই এলার্জিক রাইনাইটিস রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি সুস্থ থাকার একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি।
আগে ধারণা ছিল এলার্জি একবার হলে আর সারে না। কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। প্রথম দিকে ধরা পড়লে এলার্জি জনিত রোগ একেবারে সারিয়ে তোলা সম্ভব।
অবহেলা করলে এবং রোগ অনেক দিন ধরে চলতে থাকলে নিরাময় করা কঠিন হয়ে পড়ে। উন্নত দেশের সকল পয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা বর্তমানে বাংলাদেশেই রয়েছে। তাই সময়মত এলার্জি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।