নলিনীকান্ত ভট্টশালী (১৮৮৮-১৯৪৭)

33

ইতিহাসবেত্তা, প্রত্নতত্ত্ববিদ, মুদ্রাবিজ্ঞানী, লিপিবিশারদ ও প্রাচীন বিষয়াবলি সম্পর্কে বিখ্যাত পন্ডিত। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির বহু অস্পষ্টতা অপসারণে তাঁর বিশাল অবদান রয়েছে। মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্গত বিক্রমপুরের এক শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৮৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২২ সালে এম.এ ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ এ যোগদান করেন। সেখানে অবস্থানকালে জেলার বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটে। সারাজীবন তিনি এ সব এলাকার ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে গভীর আগ্রহী ছিলেন এবং এর বিস্মৃত অতীত সম্পর্কে তথ্য আহরণ ও অনুসন্ধানের জন্য এখানে ক্লান্তিহীনভাবে ভ্রমণ করেন।
১৯১৪ সালে তিনি সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা জাদুঘর এর তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রায় ৩৩ বছর তিনি এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। জাদুঘরের চৌহদ্দির মধ্যেই কেটেছে তাঁর সারা জীবন। অসাধারণ নিষ্ঠা ও কর্মশক্তি বলে তিনি এ নগণ্য প্রাদেশিক সংগ্রহশালাকে এক সর্বভারতীয় খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করেছিলেন। এর গঠনমূলক পর্যায়ে ঢাকা জাদুঘর ও ভট্টশালী ছিলেন অবিচ্ছেদ্য। এর বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য ভট্টশালীর ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধান ও মনোযোগ ছিল অপরিহার্য। তিনি গ্রামাঞ্চলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত অবিরাম ঘুরে বেড়িয়েছেন। এ ভ্রমণকালে তিনি অনুসন্ধান ও আবিষ্কার করেছেন, ছবি তুলেছেন এবং বিভিন্ন সামগ্রী ও তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এ সময় তিনি খনন কাজ ও প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য স্থানীয়দের মনে আগ্রহ ও সচেতনতা সৃষ্টি করেছেন।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বহু বছর আগেই তার প্রচেষ্টায় ঢাকা জাদুঘর ইতিহাস পাঠ ও গবেষণার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও কালানুক্রম নির্ধারণে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রীর অবদান সম্পর্কে তিনি প্রতিবেদন এবং গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। বিদ্বজ্জনোচিত কার্যক্রম আয়োজনে আর্থিক অসুবিধা এবং নিজের স্বল্প ও অনিশ্চিত বেতনের কারণে তার ব্যক্তিগত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ভট্টশালী কখনও জাদুঘর ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করেন নি। এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি প্রবল আবেগপূর্ণ এক ভালবাসা তাঁর উৎসাহকে আমরণ টিকিয়ে রেখেছিল।
জাদুঘরে যোগদান করার আগেও তিনি বাংলার ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে মৌলিক ও গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। কালক্রমে এসব ক্ষেত্রে তাঁর লেখালেখির পরিমাণ, পরিসর ও মান বৃদ্ধি পেয়েছিল। এটা স্পষ্ট করে বলা দরকার যে, তাঁর সময় পর্যন্ত বাংলা (বিশেষ করে এর পূর্বাংশ) সর্বভারতীয় খ্যাতিসম্পন্ন ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ব বিদদের অত্যল্প মনোযোগই আকর্ষণ করেছিল। কাজেই এসব ক্ষেত্রে গবেষণায় ভট্টশালীকে যথার্থই পথপ্রদর্শক রূপে গণ্য করা হয়।
বাংলা, অথবা আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে, পূর্ববাংলা (বঙ্গ-সমতট) ছিল ভট্টশালীর গবেষণার বিশেষ ক্ষেত্র। নিজের মূল্যবান রচনাবলি ও এ অঞ্চলের বিভিন্ন অবহেলিত এলাকায় তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তার ব্যাপক ভ্রমণ ও নিরবচ্ছিন্ন অনুসন্ধানের ফলে পূর্ববর্তীকালে এর ইতিহাস ও সভ্যতাকে ঘিরে থাকা অস্পষ্টতা ও অজ্ঞতা তিনি বহুলাংশে দূর করতে সফল হন। তাঁর ব্যক্তিগত মনোযোগ আকর্ষণকারী স্থানসমূহের মধ্যে জন্মভূমি বিক্রমপুর ছাড়া দেউলবাড়ি, চান্দিনা- বড় কামতা, ভারেল্লা, বিহারমন্ডল, ঢাকা-কুমিল্লা সড়কের উভয় পাশে ময়নামতীর উঁচু ভূমিতে কোটবাড়ির প্রাচীন নিদর্শনের কথা উল্লেখ করতেই হয়।
এ পর্যন্ত অজ্ঞাত খড়্গ, চন্দ্র, বর্মণ ও পরবর্তী দেববংশের পরিচয় উদ্ঘাটনের সঙ্গেও ভট্টশালী ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে তাঁদের বেশ কয়েকটি তাম্রশাসন এ সময়ে (গত শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে) আবিষ্কৃত হয়। এ লেখ-প্রমাণগুলি বাংলার প্রাচীন ইতিহাস ও সভ্যতা সম্পর্কে অনেক রহস্য উদ্ঘাটনে মূল্যবান সূত্র জোগায়। প্রাচীন ভারতীয় হস্তলিপিবিজ্ঞান ও মুদ্রাবিজ্ঞানে ভট্টশালীর বিশেষজ্ঞসুলভ জ্ঞান এ সব লেখ-প্রমাণের পরীক্ষা ও ব্যাখ্যায় বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। তাঁর পর্যবেক্ষণ বহু ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত প্রমাণিত হয়েছে।
তবে ভট্টশালী কখনোই কেবল প্রাক্-মুসলিম আমলে তাঁর গবেষণাকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি। জাদুঘরের সংগ্রহে রক্ষিত মুসলমান আমলের মুদ্রাগুলি তিনি অত্যন্ত সতর্কতা ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে পরীক্ষা করে দেখেন এবং যথাসময়ে মুসলিম মুদ্রাবিদ্যা সম্পর্কে একজন স্বীকৃত ও দক্ষ পন্ডিত রূপে পরিচিতি লাভ করেন। এ সব মুদ্রা-সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তিনি প্রাক্-মুগল আমলের বাংলার মুসলমান শাসকদের প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক বিবরণ Coins and Chronology of the Early Independent Sultans of Bengal (১৯২২ সালে কেম্ব্রিজ থেকে প্রকাশিত) রচনা করেছিলেন, যা এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সূত্র : ইন্টারনেট