নতুন সময়ের কাছে প্রত্যাশা

57

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরংকুশ জয়লাভ করে শেখ হাসিনা টানা তিনবার ও চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হিেেসবে শপথ নিয়ে দেশ বিদেশে চমক সৃষ্টি করেছেন। নির্বাচিত সরকারের অধীনে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও টানা তিনবার দল ক্ষমতায় আসা ও চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হওয়া বাংলাদেশে এই প্রথম। বিগত মন্ত্রিসভার ৪৮ জনের ৩৪ জনকে বাদ দেয়া ও নবীন প্রবীণের সমন্বয়ে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন আরেক চমক। স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারি দলটির হাত ধরে উদযাপিত হবে স্বাধীনতার ৫০ বছরের সুবর্ণজয়ন্তী তাতে কোন সন্দেহ নেই। দলটি বিগত দশ বছরের শাসনামলে ব্যাপক উন্নয়নের কারণে মোট জিডিপি রেকর্ড ছুঁয়েছে। ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ সেøাগানে দুর্নীতি, মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ রোধ, গণতন্ত্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, যোগাযোগ খাতে উন্নয়ন মেগা প্রজেক্টগুলো দ্রæত বাস্তবায়ন, বিদ্যুৎ জ্বালানি নিরাপত্তা সহ বেশ কিছু প্রতিশ্রæতি দিয়ে এবার ক্ষমতায় আসে। নতুন মন্ত্রিসভার অনেকের কথা শুনে আমাদের অকেটা আশাবাদী করে তুলে। সকাল বলে দেয় দিনটা কেমন যাবে। আমরা আশাবাদী হতে চাই আগামী সময়টা হবে সমৃদ্ধি ও শান্তির। আর এই সমৃদ্ধি ও শান্তি আনতে হলে বিগত সময়ে আলোচিত বিষয়সহ অন্যান্য বিষয়গুলোর দিকে সরকারকে মনযোগ দিতে হবে। দুর্নীতি দেশের উন্নয়নের বড় অন্তরায়। দেশে সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব নয়। দুর্নীতির জিরো টলারেন্সের কথা বলা হলেও বিগত সময়ের রাষ্ট্রীয় পরিচালিত ব্যাংক খাতে রাজনৈতিক প্রভাবে চরম অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও বিদেশে পাচার হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই টাকা ফেরত আনা বা দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তেমন বড় কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। মোট সাংসদের মধ্যে ১৮২ জন ব্যবসায়ী সাংসদের এই সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সফলতা কঠিন হলেও সদিচ্ছা ও অবৈধ প্রভাব বিস্তার বন্ধ করা গেলে অসম্ভব নয়। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ প্রাপ্ত কর্মচারী ও রাজনৈতিক প্রভাবে রাজনীতিবিদরা মূলত দুর্নীতি করে। সরকারি অফিস ও অন্যান্য জায়গায় দুর্নীতি এখন লাজ শরম বাদ দিয়ে অনেকটা প্রকাশ্য। যে কোন কাজে ‘খরচ ’ নামে ঘুষ না দিলে ফাইল বছরের পর বছর আটকে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভূমি অফিস, পাসপোর্ট, পুলিশ বিভাগ, বি আর টি এ, কাষ্টম হাউসসহ এসব জায়গাগুলোতে টাকা ছাড়া কোন সেবা মিলেনা। টিআইবি কর্তৃক পরিচালিত ‘সেবা খাতে দুর্নীতি; জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭’ মতে সেবাখাতে ৬৬.৫% দুর্নীতির শিকার। সাধারণ মানুষও এখন বুঝে গেছে ‘খরচ’ ছাড়া ঘুরতে ঘুরতে সেন্ডেল ক্ষয়ে কিছুই হবে না। বরং ঘুষ দিয়ে সেবা পেয়ে সন্তুষ্ট থাকে। বিশেষত সরকারী সেবা সংস্থগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় এনে সব ধরণের কার্যক্রম ডিজিটাল করলে দুর্নীতি অনেকটা কমে আসবে। দুর্নীতির কারণে দেশে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হয়না। তাই দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ড বিনিয়োগকারীদের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করে সব কার্যক্রমসহ ডিজিটালাইজেশন করে বিনিয়োগ খাতে দুর্নীতি রোধ করা দরকার। প্রশ্নফাঁস, জিপিএ- ৫, শিক্ষার বাণিজ্যকরণ, নোটবই, কোচিং, ভর্তি বাণিজ্য, কর্মমুখি শিক্ষার অভাব এসবের কারণে আমাদের দেশের শিক্ষার মান নি¤œমুখি। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। একজন শিক্ষককে সবাই সম্মান করেন। তিঁনি শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষাদানে সচেষ্ট থাকেন। কিন্তু এখন কথিত শিক্ষকেরা কোচিংয়ে ছাত্রসংখ্যা বাড়িয়ে মাসের শেষে কতটাকা ব্যাংকে জমা পড়বে তা নিয়ে অস্থির থাকেন। তাই নামীদামি স্কুলে অধিকাংশ শিক্ষকের বাসা, কোচিংগুলোতে সারা বছর ভিড় লেগে থাকে। ক্লাশে দায়সারাভাবে পাঠদান করে ছাত্রদের কোচিংমুখি করে। সারা বছরজুড়ে প্রশ্নফাঁস লেগেই ছিল। পরীক্ষার আগের রাতে ছাত্র, অভিভাবক রীতিমত প্রশ্ন সংগ্রহের দৌঁেড় ব্যস্ত ছিল। প্রশ্নফাঁস, শিক্ষার বাণিজ্যকরণসহ সব ধরনের অনিয়ম দূর করে শিক্ষাখাতকে আরো কর্মমুখি করে সনদ সর্বস্ব নয় দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা দরকার। আমাদের দেশের অর্থনীতির অন্যতম খাত হল পোশাক শিল্পখাত। এখানে অনেক বিদেশীরা কাজ করে প্রচুর দেশীয় মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেতদন অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে বেকার ছিল ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। যার মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেশি। তাই দেশের মুদ্রা ধরে রাখা, বেকারত্ব দূর, পোশাক শিল্পের আরো উন্নতি সাধনে তাই কর্মমুখী শিক্ষার বিকল্প নেই। স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে গত বছর অনেক আলোচনা, আন্দোলন হয়েছে। চিকিৎসকদের অবহলোয় রোগী মৃত্যু (সাংবাদিক রুবেল খানের কন্যা শিশু রাইফা খান হত্যাকাÐ আলোচিত ঘটনা), রোগী ও রোগীর স্বজনদের মারধর, রোগীদের সাথে অশোভন আচরণ, নবজাতক বদল, অহেতুক পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগীকে সর্বসান্ত করা, ডাক্তারের অধিক ফিসহ নানা ধরনের অভিযোগ। তাই প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ পার্শ¦বর্তী দেশে চিকিৎসা নিতে পাড়ি দিচ্ছে। বিভাগীয় শহরগুলোতে দেশটির ভিসা সেন্টার খুলতে হয়েছে। চিকিৎসা সেবার মান বাড়ানো, ব্যয় কমানো, মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা ও সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক, নার্স, শয্যা ও চিকিৎসা সেবার মান বাড়িয়ে চিকিৎসা সেবা আরো সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য করা উচিত। নিরাপদ সড়ক নিয়ে দেশে যে বিরল কিশোর আন্দোলন হয়েছিল। তাতে আমরা যে ধরনের আশাবাদী হয়েছিলাম জনগণ, চালক, হেলপার, মালিকদের সচতেনতার অভাব, ট্রাফিক বিভাগে লোকবল সংকট, দুর্নীতিসহ নানা কারণে সড়কে তেমন পরিবর্তন আসেনি। সড়ক দুর্ঘটনার অধিকাংশ ক্ষেত্রে মামলা হয়না। চাপে পড়ে মামলা হলেও তদন্ত এগোয় না। গত বছর দেশজুড়ে আলোচিত ১২টি সড়ক দুর্ঘটনার মোট আসামি ২৬ জনের মধ্যে ১৩ জন এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। অনেকে জামিনে বেরিয়ে গেছেন। ভুক্তভোগিরা পুলিশের ‘ধীরে চল ’ নীতির কারণে তাঁদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদন মতে,২০১৬ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২৪,৯৫৪ জন। ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে নিরাপদ সড়ক আইন ২০১৮ পাশ হলেও সড়কে শৃংখলা ফেরেনি। লাইসেন্স, ফিটনেসবিহীন পুরাতন লক্কর-ঝক্কর গাড়ি, লাইসেন্সবিহীন চালক, সমিতি ও ট্রাফিক পুলিশের চাঁদাবাজি,রাজনৈতিক প্রভাব রোধ করে সড়কে শৃঙ্খলা আনা জরুরি। রুট সংখ্যা কমানো, রুট ভিত্তিক নির্দিষ্ট কোম্পানি ও রংয়ের বাস চলাচল, নির্দিষ্ট স্থানে যাত্রী উঠানামা, রাস্তায় গাড়ির আলাদা লেন, ট্রাফিক ব্যবস্থা আধুনিকায়নে ইন্টিলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম, ডিজিটাল টিকিট, ইন্টারনেট প্রটোকল হাইটেক ক্যামেরার মাধ্যমে সড়কে তদারকি করাসহ সড়কে নিরাপত্তা আনয়নে সব ধরণের ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।

লেখক : প্রাবন্ধিক