নতুন ইপিজেড আর নয়

144

সরকার আপাতত নতুন করে আর কোনও রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা বা ইপিজেড (এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন) নির্মাণের চিন্তা করছে না। বরং ইতোমধ্যে যেসব ইপিজেড গড়ে উঠেছে, সেগুলোকে পর্যায়ক্রমে কীভাবে বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া যায়, তার সম্ভাব্যতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। সময়ের প্রয়োজনে এবং বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের ধারা পরিবর্তনের কারণেই সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকার মনে করছে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে ইপিজেডের চেয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল বেশি কার্যকর। একইসঙ্গে দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীরাও মনে করেন, এখন আর ইপিজেড নয়, অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাই তাদের জন্য বেশি লাভজনক। কারণ ইপিজেডে প্রতিষ্ঠিত কারখানায় উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা যায় না। এক্ষেত্রে আইনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অপর দিকে অর্থনেতিক অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত কারখানায় উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় মার্কেটসহ বিদেশেও রফতানি করা যায়, যা বেশি লাভজনক। এক্ষেত্রে আইনে কোনও বাধা নেই। তাই ব্যবসায়ীরা তাদের নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান সুবিধাজনক অর্থনৈতিক অঞ্চলে গড়ে তুলতে আগ্রহী। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ বা বেপজা (বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি) বাংলাদেশের রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের আওতাভুক্ত সংস্থা। যা মুক্ত বাজার অর্থনীতির এই যুগে শিল্পায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে দ্রæত উন্নয়ন এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বেপজার প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা প্রতিষ্ঠা করে সেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশে বিনিয়োগের সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করা।
দ্য এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি অ্যাক্ট ১৯৮০ অনুযায়ী গঠিত হয় বেপজা। সংস্থাটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পরিচালিত হচ্ছে। আশির দশকের শুরুতে চট্টগ্রামের দক্ষিণ হালিশহর এলাকায় প্রথম ইপিজেড নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয়। এ, বি ও সি, এই তিন ক্যাটাগরিতে গড়ে উঠছে দেশের ইপিজেডগুলো। শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগে নির্মিত হয় ‘এ’ ক্যাটাগরির ইপিজেড। ৫০ শতাংশ বিদেশি ও ৫০ শতাংশ দেশি বিনিয়োগে নির্মিত হয় ‘বি’ ক্যাটাগরির ইপিজেড। আর শতভাগ দেশি বিনিয়োগে নির্মিত হয় ‘সি’ ক্যাটাগরির ইপিজেড।
দেশে এখন পর্যন্ত আটটি ইপিজেড নির্মাণের কাজ শেষ করা হয়েছে। এসব ইপিজেডে স্থাপিত কারখানাগুলো উৎপাদনের কাজ করছে। এই আটটি ইপিজেড হচ্ছে, চট্টগ্রাম, ঢাকা (সাভার), আদমজী, কুমিল্লা, ঈশ্বরদী, মোংলা, উত্তরা (নীলফামারী) ও কর্ণফুলী (কোরিয়ান) ইপিজেড। আরও দুটি ইপিজেড নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে। এর একটি মুন্সীগঞ্জে, যার নামকরণ করা হয়েছে মেঘনা ইপিজেড এবং অপরটি ফেনী জেলায় ফেনী ইপিজেড।
ইপিজেডগুলোর মধ্যে একমাত্র কৃষিভিত্তিক ইপিজেড হচ্ছে নীলফামারীতে অবস্থিত উত্তরা ইপিজেড। আর দেশের প্রথম বেসরকারি ইপিজেড ‘আরইপিজেড’-এর নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ১৯৯৯ সালের ১০ অক্টোবর।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের প্রথম ইপিজেড হচ্ছে চট্টগ্রাম ইপিজেড। দক্ষিণ হালিশহর এলাকায় ১৯৮৩ সালে এই ইপিজেডের নির্মাণকাজ শুরু হয়। এর মোট আয়তন ৪৫৩ একর। এখানে শিল্প প্লটের সংখ্যা ৫০১টি। চট্টগ্রাম ইপিজেডে বিনিয়োগের পরিমাণ ২১ হাজার ৩২৭ দশমিক ৯১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
দ্বিতীয় ইপিজেড হিসেবে ঢাকা ইপিজেডের নির্মাণকাজ শুরু হয় ঢাকার অদূরে সাভারের আশুলিয়ায় গনকবাড়ি এলাকায়। এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৮৭ সালে। এই ইপিজেডের মোট আয়তন ৩৫৬ দশমিক ২২ একর। এখানে মোট শিল্প প্লটের সংখ্যা ৪৫১টি। এখানে বিনিয়োগের পরিমাণ ১৭ হাজার ৯৪১ দশমিক ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
১৯৯৮ সালে দেশের তৃতীয় ইপিজেড হিসেবে মোংলা ইপিজেডের কাজ শুরু হয়। বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত মোংলা ইপিজেডের মোট আয়তন ২৫৫ দশমিক ৪১ একর। এখানে মোট শিল্প প্লটের সংখ্যা ১৯০টি। এখানে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৩৫০ দশমিক ২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
কুমিল্লায় দেশের চতুর্থ ইপিজেডের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০০ সালে। কুমিল্লার পুরাতন বিমানবন্দর এলাকায় অবস্থিত কুমিল্লা ইপিজেডের আয়তন ২৬৭ দশমিক ৪৬ একর। এখানে মোট শিল্প প্লটের সংখ্যা ২৩৮টি। এখানে বিনিয়োগের পরিমাণ ১ হাজার ৩২৪ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
দেশের পঞ্চম ইপিজেড হিসেবে ঈশ্বরদীতে ইপিজেড প্রতিষ্ঠা করা হয় ২০০১ সালে। পাবনার পাকশীতে অবস্থিত ঈশ্বরদী ইপিজেডের মোট আয়তন ৩০৯ একর এবং মোট প্লটের সংখ্যা ২৯০টি। এই ইপিজেডে বিনিয়োগের পরিমাণ ৩২০ দশমিক ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
নীলফামারীতে দেশের ষষ্ঠ ইপিজেড হিসেবে উত্তরা ইপিজেড নাম নিয়ে ২০০১ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। নীলফামারী জেলার সোনারায় এলাকায় অবস্থিত একমাত্র কৃষিভিত্তিক ইপিজেড হিসেবে উত্তরা ইপিজেডের মোট আয়তন ২১৩ দশমিক ৬৬ একর। এখানে মোট শিল্প প্লটের সংখ্যা ১৮০টি। উত্তরা ইপিজেডে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ১৪৪ দশমিক ৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
দেশের সপ্তম ইপিজেড হিসেবে নারায়ণগঞ্জের আদমজীর সিদ্ধিরগঞ্জে অবস্থিত আদমজী ইপিজেডের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০৬ সালে। এই ইপিজেডের আয়তন ২২৯ দশমিক ১২ একর। এই ইপিজেডের রফতানির বার্ষিক সক্ষমতার পরিমাণ ১ হাজার ৫৯৯ দশমিক ৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এখানে মোট প্লটের সংখ্যা ২২৯টি।
২০০৬ সালে দেশের অষ্টম ইপিজেড হিসেবে নির্মাণকাজ শুরু হয় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ইপিজেড। চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গায় অবস্থিত স্টিল মিল এলাকায় অবস্থিত এই ইপিজেডের আয়তন ২০৯ দশমিক ৬ একর। এই ইপিজেডে বিনিয়োগের পরিমাণ ১ হাজার ৯৬৫ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এখানে মোট শিল্প প্লটের সংখ্যা ২৫৫টি।
পোশাক মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও এনভয় গ্রæপের চেয়ারম্যান সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘আমরা যারা বিনিয়োগ করতে চাই, তারা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগে আগ্রহী। কারণ এখানে শিল্প কারখানা গড়ে তুললে পণ্য লোকাল মার্কেটেও তোলা যায়, যে সুযোগটা ইপিজেডে নেই। তাই ইপিজেডগুলো অর্থনৈতিক অঞ্চলে যুক্ত করে দেওয়া হলে, তা যুগোপযোগী ও ব্যবসাবান্ধব পদক্ষেপ হবে।’
ইপিজেড স্থাপনে সরকারের অবস্থান বিষয়ে জানতে চাইলে বেপজার মহাব্যবস্থাপক নাজমা বিনতে আলমগীর জানান, সরকার হয়তো নতুন করে আর কোনও ইপিজেড নির্মাণের অনুমতি দেবে না। ইপিজেড হিসেবে যেগুলো কাজ করছে, সেগুলোকে হয়তো অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হতে পারে। কারণ ইতোমধ্যে দেশের সবচেয়ে বড় ইপিজেড চট্টগামের মিরসরাই ইপিজেডকে অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। তবে বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি।
শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ হুমায়ুন বলেন, ‘সরকার আর ইপিজেড প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী না। কারণ ইপিজেড এলাকায় স্থাপিত কারখানায় উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা যায় না। এগুলো রফতানি করতে হয়। অপরদিকে অর্থনেতিক অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত কারখানায় উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় মার্কেটসহ বিদেশেও রফতানি করা যায়। যেটা ব্যবসায়ীদের জন্য বেশি লাভজনক। অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারী শিল্প মালিকরা তাদের মুনাফার টাকার পুরোটা নিজ দেশে নিয়ে যেতে পারবেন। দেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী করতে সরকার এমন সুবিধা দিয়েছে।’