নজরুলের নীল বেদনা

70

 

সাম্য, প্রেম, দুঃখ-বেদনা, মানবতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অকুতোভয় কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, গীতিকার, আধুনিক বাংলা গানের সম্রাট, বাংলা গজল ও বাংলায় ইসলামী সংগীতস্রষ্টা, আধুনিক বাংলা সংগীতের সর্বাধিক সুর স্রষ্টা, সংগীতের স্বরলিপিকার, আধুনিক কবিতার মুক্তক ছন্দের স্রষ্টা,বংশী বাদক, প্রথিতযশা সংগীত প্রশিক্ষক, সাংবাদিক, সম্পাদক, প্রথম বাঙালী চলচ্চিত্রকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রথম কবি-অভিনেতা, আবৃত্তিকার,হাবিলদার, ব্রিটিশ রাজদ্রোহী, দেশপ্রেমিক, জনম দুঃখের দুখু মিয়া, রাজনীতিবিদও কারাবরণকারী প্রভৃতি তথা বাংলাভাষার সর্বাধিক বিশেষণের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি আমাদের উন্নয়নশীল জাতির জাগরণের কবি, জাতীয় কবি, মরমী কবি, চারণ কবি, বিদ্রোহী কবি।
যে-কবি উপমহাদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলে স্ব-সম্পাদিত ধূমকেতু পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলেন- ‘স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চাই’ তিনি আমাদের স্বাধীনতাপিয়াসী প্রিয়কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি বুকভাঙা বেদনার কবি, তিনি কুসুম-কোমল প্রেমের কবি।
কাজী নজরুল ইসলাম জীবনে অনেক চিঠি লিখেছেন। তাঁর জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং সাহিত্যের অন্যতম উৎস। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিঠিগুলো কোনো সাধারণ চিঠি নয়। তাঁর চিঠি তখনকার সময় ও তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নানা দিকের উৎস। তাঁর জীবনের সুখ-দুঃখ তিনি তাঁর পরিচিত ও বন্ধুদের চিঠির মাধ্যমে জানিয়েছেন। তাঁর মনের ক্ষত, দুঃখ-বেদনা, অভিমান, আশা-আকাক্সক্ষা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির অনেক কিছুই জানা যায় তাঁর চিঠির মাধ্যমে।
বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘নজরুলের পত্রাবলি’র ৭৯ ও ৮০নং পত্রের মাধ্যমে কবির জীবনের এক মর্মান্তিক তথ্য জানা যায়। তিনি ৭৯নং পত্রটি লেখেন সূফী জুলফিকার হায়দারকে আর ৮০নং পত্রটি লেখেন তখনকার প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ শ্যামা প্রসাদকে। শ্যামা প্রসাদ আর শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক একসাথে রাজনীতি করতেন। বেশ সখ্য ছিল তাঁদের।
১৯৪২ সালের ১০ জুলাই এর ৭দিন পরে কবি ১৭/৭/১৯৪২ইং তারিখে পত্র দুটি লেখেন। নজরুলের স্নেহধন্য লেখক ছিলেন সূফী জুলফিকার হায়দার। তিনিও কবির মতো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক ছিলেন। যুদ্ধ শেষে ফিরে বৃটিশ ফার্ম ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জিতে যোগ দেন। নজরুলের অসুস্থতার সময়ে তিনি নজরুল ও তাঁর পরিবারকে আন্তরিকতার সাথে দেখাশোনা করেন। সেদিনের স্মৃতি নিয়ে ‘নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায়’ শিরোনামে তিনি একটি জীবনীগ্রন্থ রচেছেন। ‘নজরুল প্রতিভা পরিচয়’ শিরোনামে তাঁর সম্পাদনায় নজরুলকে নিয়ে বিভিন্ন লেখকের লেখার একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।

সূফী জুলফিকার হায়দারকে লেখা পত্রটি হলো:
প্রিয় হাইদর,
খোকাকে পাঠালাম। তুমি এখনই খোকার সাথে চলে এসো। Blood pressure এ শয্যাগত। অতি কষ্টে চিঠি লিখছি। আমার বাড়িতে অসুখ, ঋণ, পাওনাদারের তাগাদা প্রভৃতি worries, সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত খাটুনি। তারপর নবযুগের worries ৩/৪ মাস পর্যন্ত। এই সব কারণে আমার nerves shattered হয়ে গেছে। ৭ মাস ধরে হক সাহেবের কাছে গিয়ে ভিখারির মতো ৫/৬ ঘণ্টা বসে থেকে ফিরে এসেছি। হিন্দু-মুসলিম equity-র টাকা কারুর বাবার সম্পত্তি নয়, বাংলার বাঙালির টাকা। আমি ভালো চিকিৎসা পাচ্ছি না। একমাত্র তুমিই আমার জন্য cerely appeal করেছ সত্যিকার বন্ধু হয়ে। আমার হয়তো এই শেষপত্র তোমাকে। একবার শেষ দেখা দিয়ে যাবে বন্ধু? কথা বন্ধ হয়ে গিয়ে অতি কষ্টে দু-একটা কথা বলতে পারি। বললে যন্ত্রণা সর্বশরীরে। হয়তো কবি ফেরদৌসির মতো ঐ টাকা আমার জানাজার নামাজের দিন পাব। কিন্তু ঐ টাকা নিতে নিষেধ করেছি আমার আত্মীয় স্বজনকে। হয়তো ভালোই আছ।
তোমার নজরুল
১৭/৭/৪২
এই পত্র থেকে জানা যায় ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে কবির জীবনে একটা নিদারুণ ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। ঘরে তাঁর স্ত্রীও ছিলেন অসুস্থ। কবিপত্নির চিকিৎসা, সংসারের ব্যয় নির্বাহ নিয়ে কবি হিমশিম খাচ্ছিলেন। তখন তাঁর অর্থের ভীষণ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তিনি কারো কাছ থেকে পর্যাপ্ত অর্থ পাচ্ছিলেন না উপরন্তু কবির কাছেও অনেকে পাওনাদার ছিলেন। ধার-দেনায় কবি জর্জরিত হয়ে পড়লেন। তিনি হক সাহেবকে টাকার জন্য তাগাদা দিতে লাগলেন। হক সাহেবকে আমরা সবাই বাংলার হাতেম তাঈ হিসেবে জানলেও তিনি কবির প্রতি সেই রকম মনোভাব পোষণ করেননি। তিনি কবিকে তাঁর বদান্যতা থেকে চিরতরে বঞ্চিত করেছেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে ‘হক সাহেবের কাছে কবি কীসের টাকা পেতেন?’ কবি তৎকালীন একটা ফিল্ম কোম্পানীর সাথে সাত হাজার টাকার কন্ট্রাক্ট করেন। ৮০নং পত্র অর্থাৎ শ্যামা প্রসাদের কাছে লেখা পত্রে কবি বলেন ‘নবযুগের সম্পাদনার ভার যখন নিই, তার কিছুদিন আগে ফিল্মের Music Direction এর জন্য সাত হাজাপর টাকার কন্ট্রাক্ট পাই। হক সাহেব ও তাঁর অনেক হিন্দু-মুসলমান supporter আমায় বলেন যে, তাঁরা ও-ঋণ শোধ করে দেবেন। আমি Film এর contract cancell করে দিই।’
হক সাহেব তখন কবিকে উক্ত কন্ট্রাক্ট বাতিল করে তাঁর দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় কাজ করতে বলেন। বিনিময়ে তিনি কবিকে সাত হাজার টাকা পরিশোধ করবেন। এই ঘটনার সাক্ষী থাকেন শ্যামা প্রসাদ। পত্রে কবি শ্যামা প্রসাদকে বলেন, ‘ আপনি জানেন Secretariat-এ আপনার সামনে হক সাহেব বলেন, ‘কাজীর ঋণ শোধ করে দিতে হবে।’
কবি হক সাহেবের কথায় রাজি হলেন এবং ফিল্ম কোম্পানীর চুক্তি বাতিল করে দৈনিক নবযুগের দায়িত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। হক সাহেব তাঁকে সাত হাজার টাকা দেবেন এই আশায় তিনি রাত-দিন দৈনিক নবযুগের জন্য অসুস্থ শরীরে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে লাগলেন।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পুত্র। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ও বি.এল ডিগ্রি লাভ করে পরে বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে আসেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট এবং বারানসী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এল.এল.ডি উপাধী প্রদান করে। ১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন। ১৯৪১ সালে হক মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী হন। তিনি হিন্দু মহাসভার নেতারূপে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। যাহোক, নজরুল ইন্সটিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত ‘নজরুল পত্রাবলি’ গ্রন্থের ৮০নং পত্র এটি। ১৯৪২এর ১০ জুলাই নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায় চিকিৎসার জন্য মধুপুরে পাঠান। চিঠিতে উল্লেখ পাই ‘শ্রীচরণেষু, আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম গ্রহণ করুন। মধুপুর এসে অনেক relief & relaxation অনুভব করছি। মাথার যন্ত্রণা অনেকটা কমেছে। জিহব্বার জড়তা সামান্য কমেছে। আপনি এত সত্বর আসার ব্যবস্থা না করলে হয়তো কবি মধুসূদনের মতো হাসপাতালে আমার মৃত্যু হত।’সেখান থেকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে কবি ১৭/৭/১৯৪২ ইং এই চিঠি লেখেন। চিঠিটি সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকার ১৩ এপ্রিল ১৯৯১ সংখ্যায় কবির হাতের লেখাসহ প্রকাশিত হয়।
পত্রে কবির বক্তব্যানুযায়ী ‘নবযুগের’ এর সম্পাদক হলে হক সাহেব এই টাকা কবিকে দেবেন বলে কথা দেন। কিন্তু হক সাহেব তাঁর কথা বরখেলাপ করেন। তিনি নজরুলকে সে-টাকা আর দেননি। নজরুল এই টাকা পাওয়ার জন্য হক সাহেবের কাছে কয়েকবার গিয়ে শূন্যহাতে ফিরে আসেন এবং শেষবারে হক সাহেব নজরুলকে বলেন ‘কীসের টাকা?” সেদিন অভিমানী আর আত্মমর্যাদা সম্পন্ন কবি কাজী নজরুল ইসলাম কোনো বাক্য ব্যয় না করে রিক্ত হস্তে ফিরে আসেন। সূফী জুলফিকারকে সে-অভিমান-ক্ষুব্ধ হৃদয়ের কথা বলতে গিয়ে বলেন- ‘৭ মাস ধরে হক সাহেবের কাছে গিয়ে ভিখারীর মতো ৫/৬ ঘণ্টা বসে থেকে ফিরে এসেছি।’
কবি একবার নয়, দুবার নয়; বেশ কয়েকবার হক সাহেবের দরবারে গিয়ে শূন্যহাতে ফিরে এসেছেন। হক সাহেব শেষবারে কবির প্রতি নিষ্ঠূর ও অন্যায় আচরণ করে কবিকে বিদায় করেছেন। যে আচরণটা কবির অসুস্থ হওয়ার জন্য অনেকখানি দায়ী। কবি এই আচরণে গভীরভাবে মানসিক আঘাত প্রাপ্ত হন। পরিস্থিতি বিবেচনায় এতটা আঘাত হয়ত কবি অতীতে কোথাও কারো কাছ থেকে পাননি। পরিস্থিতি বিবেচনায় এই আঘাত কবিকে নির্বাক করে দিতে অনেকখানি সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। অকালে-অসময়ে কবির নির্বাক হওয়ার পেছনে, অসুস্থ হওয়ার পেছনে মূলত তাঁর এইসব মানসিক আঘাতই ছিল মূখ্য।
শ্যমা প্রসাদকে লেখা এই পত্রে জানা যায়, কবির স্ত্রী পঙ্গু হয়ে প্রায় পাঁচ বছর যাবৎ শয্যাশায়ী ছিল এবং কবি কাদের ঋণে জর্জরিত ছিলেন। পত্রের উদ্ধৃতি ‘আমার স্ত্রী আজ প্রায় পাঁচ বৎসর পঙ্গু হয়ে শয্যাগত পড়ে আছে। ওকে অনেক কষ্টে এখানে এনেছি। ওর অসুখের জন্য এখানে সাত হাজার টাকার ঋণ আছে। এর মধ্যে মাড়োয়ারি ও কাবুলিওয়ালাদের ঋণই বেশি।’
বন্ধু জুলফিকার হায়দারকে লেখা চিঠির ভেতরেই কবি মানসিক আঘাতের কথা উল্লেখ করেন। কবি প্রায় ৭মাস ধরে হক সাহেবের কাছে গিয়ে ভিখারির মতো ৫/৬ ঘণ্টা বসে থেকে শূন্যহাতে ফিরে এসেছেন। টাকা মূলত হিন্দু-মুসলিম ইকুইটি ফান্ড থেকে কবিকে দেয়ার কথা ছিল। তাই তিনি জুলফিকা হায়দারকে লেখা পত্রে বলেন, ‘হিন্দু-মুসলিম equity-র টাকা কারুর বাবার সম্পত্তি নয়, বাংলার বাঙালির টাকা।’ অর্থাভাবের কারণে চিকিৎসার অভাবে কবি জীবনের ভরসা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাই জুলফিকার হায়দারকে বলেছেন, ‘আমার হয়তো এই শেষ পত্র তোমাকে’।
ব্রিটিশ আমলে সাত হাজার টাকা কম ছিল না। এখনকার হিসেবে প্রায় ২০ লক্ষ টাকার সমান। এই পরিমাণ টাকা না পাওয়ার কষ্ট ছিল অনেক, মানসিক আঘাতটাও ছিল প্রচন্ড যখন তিনি ছিলেন ঋণে ঋণে জর্জরিত। এই সমস্ত ঋণ শোধ করার জন্য কবি কয়েক মাস হক সাহেবের কাছে যান। পত্রের উদ্ধৃতি ‘পরে যখন দু’তিন মাস তাগাদা করে টাকা পেলাম না, তখন হক সাহেবকে বললাম, ‘আপনি কোনো ব্যাংক থেকে অল্প সুদে আমায় ঋণ করে দেন, আমার মাইনের অর্ধেক প্রতিমাসে কেটে রাখবেন। হক সাহেব খুশি হয়ে বললেন, পনের দিনের মধ্যে ব্যবস্থা করব। তারপর সাত মাস কেটে গেল, আজ নয়, কাল করে তাঁর Supporter-রাও উদাসীন হয়ে রইলেন। আপনি জানেন Secretariat-এ আপনার সামনে হক সাহেব বলেন, ‘কাজীর ঋণ শোধ করে দিতে হবে।’ পত্রের এই অংশ থেকে বোঝা যায় ‘দু’তিন মাস ও সাত মাস’ প্রায় ন’দশ মাস কবি টাকার জন্য হক সাহেবের পিছনে হন্যে হয়ে পাগলের মতো ঘুরেছেন। শ্যামা প্রসাদ এই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন।
কিন্তু হক সাহেব তাঁকে বারবার নিরাশ করেন পাওনা টাকা পাওয়া থেকে। পত্রের উদ্ধৃতি ‘হক সাহেব একদিন বললেন, ‘কিসের টাকা?’ আমি চুপ করে চলে এলাম। তারপর আর তাঁর কাছে যাইনি।’ এই কথাটা সূফি জুলফিকার হায়দারকে লেখা পত্রেও উল্লেখ আছে।
তিনি অবশ্য পাঁচশো টাকা পেয়েছিলেন। কিন্তু কার হাত থেকে পেয়েছিলেন তাঁর উল্লেখ নেই। পত্রে শ্যামা প্রসাদকে বলেন, ‘পাঁচশো টাকা পেয়েছি। আরো পাঁচশো টাকা অনুগ্রহ করে যত শীঘ্র পারেন পাঠিয়ে দিবেন, বা যখন মধুপুরে আসবেন নিয়ে আসবেন।’ পত্র থেকে বোঝা যায় কবির অর্থের কতটা প্রয়োজন ছিল। কবি কতটা অর্থের অভাবে ছিলেন। পত্র থেকে এটাও বোঝা যায় কবির নামে কোর্টে পাওনাদারের কেস ছিল। কোর্টে ডিক্রির টাকা দেবার কথা ছিল। সে-টাকা কবি তিন-চার মাস দিতে পারেননি। কবি পত্রে শ্যামা প্রসাদকে বলেন, ‘কোর্টের ডিক্রির টাকা দিতে হবে। তিন-চারমাস দিতে পারিনি। তারা হয়ত body warrant বের করবে।’
মাথার ওপরে আদালতের কেস, হাতে অর্থের প্রচন্ড অভাব আর ঘরে অসুখ-বিসুখে জর্জরিত একটা পরিবার। এমনাবস্থায় সংসার পরিচালকের মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে তা আমাদের সহজেই বোধগম্য। কিন্তু শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বাংলার বাঘ ও মহৎ হৃদয়ের অধিকারী এবং যুগান্তকারী রাজনীতিবিদ হয়েও কবির অভাব অনটন ও কবির অসুস্থতার পরিণতি বোঝেননি। এজন্য কবি শ্যামা প্রসাদকে বলেন, ‘coalition ministry-র মধ্যে একমাত্র আপনাকে আমি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি-আর কাউকে নয়।’
অথচ এই হক সাহেবের জন্য কবি অনেক কিছুই করেছেন যার ভূমিকা যুগান্তকারী। হক সাহেবের দৈনিক নবযুগের জন্য কবি রাতদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছেন। হক সাহেবকে কবি একবার জীবনে বাঁচিয়েছেন। একথা শ্যামা প্রসাদকে পত্রে বলেন ‘হক সাহেব যখন আমার কাছে কাঁদতে থাকেন যে, ‘আমায় রক্ষা কর, মুসলমান ছেলেরা রাস্তায় বেরুতে দিচ্ছে না, আমি তখন মুসলিম লীগের ছাত্র ও তরুণদলের লিডারদের ডেকে তাদের শান্ত করি। তারপর Assembly-র সমস্ত মুসলমান মেম্বারদের কাছে আমি আবেদন করি। তারা আমার আবেদন শুনলেন। ৭৪জন মেম্বার হক সাহেবকে সমর্থন করতে রাজি হলেন।’
তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি হক সাহেবের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। সমস্ত ছাত্র তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপে গিয়েছিল। কমে গিয়েছিল হক সাহেবের জীবনের নিরাপত্তা। এমন পরিস্থিতিতে মুসলিম লীগের ছাত্র ও তরুণদলের লিডারদের শান্ত করা চারটেখানেক কথা নয়। Assembly-র ৭৪জন মেম্বারের সমর্থন আদায় করা সেটাও মোটেই সহজতর বিষয় ছিল না। কিন্তু এই অসহজতর বিষয়টিকেই কবি কাজী নজরুল ইসলাম হক সাহেবের জন্য সহজতর করেছিলেন অনেক ঝুঁকি ও সাহস নিয়ে। যেখানে হক সাহেবের সমর্থন জিরোতে চলে গিয়েছিল, সেখানে ৭৪জন মেম্বারের সমর্থন কবি ফিরিয়ে এনে দিলেন। উত্তেজিত ছাত্রদের ও তরুণদলের লিডারদেরও শান্ত করলেন। এটা হক সাহেবের জন্য তখনকার পরিস্থিতে শুধু বিরাট নয় মহৎকর্মই বটে।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের উদারতা, বদান্যতা আমরা শুধু শুনেই এসেছি। কিন্তু এই হক সাহেবই অমন উপকার করা, বিপদের দিনে পাশে দাঁড়ানো তথা তাঁকে নতুন জীবন পাইয়ে দেয়া অসুস্থ ও ঋণে জর্জরিত কবি কাজী নজরুল ইসলামকে করেছেন আশাহত, বেদনাহত ও প্রতারিত। কবিকে ঠকিয়েছেন বর্তমান বাজার দরের প্রায় ঊনিশ-বিশ লক্ষ টাকা পাওনা থেকে। যার ফলে কবি জীবনের সর্বাধিক আঘাত পেয়েছিলেন। কারণ, কবি এমনিতেই বিভিন্ন ঋণে জর্জরিত ছিলেন, তিনি নিজে অসুস্থ ছিলেন, অসুস্থ ছিলেন প্রমীলাও। এমন পরিস্থিতিতে হক সাহেবের কর্মকান্ডে কবির চরম মানসিক আঘাত পাওয়ারই কথা।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের অসুস্থতার কারণ অনেকেই জানতে চান। কারণগুলো কবি নিজেই দেখিয়েছেন। তিনি তো সূফি জুলফিকার হায়দারকে তাঁর নার্ভ শ্যাটার্ড হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে পত্রে সে-কথা এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘আমার বাড়িতে অসুখ, ঋণ, পাওনাদারের তাগাদা প্রভৃতি worries, সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত খাটুনি। তারপর নবযুগের worries ৩/৪ মাস পর্যন্ত। এই সব কারণে আমার nerves shattered হয়ে গেছে।’ যে-কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে- সে-কারণে মানুষ আত্মহত্যা না করে আত্মশক্তিতে ভর করে বাঁচতে গেলে চেতনা সংযোগকারী নার্ভ ছিঁড়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক এবং বিজ্ঞানসম্মত।
প্রিয়নেতার কাছ থেকে কবি যে নিদারুণ আঘাত পেয়েছিলেন সেটা তাঁর নার্ভ শ্যাটার্ড হওয়ার অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত করতে কে দ্বিধান্বিত হবেন? এ যেন সুলতান মাহমুদের কাছ থেকে মহাকবি ফেরদৌসের মতো আঘাত পাওয়ার সমান। সম্ভবত সে-জন্যই জুলফিকার হায়দারের কাছে লেখা চিঠিতে কবি সে-কথার উল্লেখ করেছেন এভাবে- ‘হয়তো কবি ফেরদৌসির মতো ঐ টাকা আমার জানাজার নামাজের দিন পাব। কিন্তু ঐ টাকা নিতে নিষেধ করেছি আমার আত্মীয় স্বজনকে’। কাজী নজরুল ইসলাম ফজলুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে সূফী জুলফিকার হায়দারকে যে-চিঠি লিখেছেন তার সঙ্গে মিল রয়েছে শ্যামা প্রসাদকে লেখা চিঠির। চিঠি দু’টিতে বেদনাহত কবির রক্তাক্ত হৃদয়ের চিত্র ফুটে উঠেছে।
এতকিছুর পরও এই মহান কবি তাকে নিয়ে ‘নবযুগ’ পত্রিকায় লেখেন- ‘সে যুগের ওগো জগলুল! আমি ভুলিনি তোমার ¯েœহ/ স্মরণে আসিত তোমার বিরাট হৃদয়, বিশাল দেহ।…/ আমি দেখিয়াছি দুঃখীর তরে তোমার চোখের পানি,/ এক আল্লাহ জানেন তোমারে; দিয়াছ কী কোরবানী।’
আবার তাঁরই রানৈতিক জীবনের ভুলের সপক্ষে ওকালতি করতে গিয়ে কবি বলেন- ‘যত ভুল তুমি করিয়াছ তার অনেক অধিক ফুল/ দিয়াছ রিক্ত দেশের ডালায়, দেখিল না বুলবুল।’
কবি কতটা ধৈর্যশীল ও মহৎ হৃদয়ের ছিলেন এই থেকে বোঝা যায়। আমরা যেখানে মানুষের নামে কেস করি, গালি দেই, সংঘাত করি সেখানে কবি হক সাহেবকে উদ্দেশ্য করে লেখেন- ‘যে সূর্য আলো দেয়, যদি তার আঁচ এতটুকু লাগে, তাহারি আলোকে দাঁড়ায়ে অমনি গাল দেবে তারে রাগে।’ কিন্তু কবি হক সাহেবকে কোনো গালি দেননি কিংবা ভর্ৎসনাও করেননি।
মোটকথা, ১৯৪২ সালটা কাজী নজরুল ইসলামের জন্য মোটেই ভালো যাচ্ছিল না। তিনি নিজেই বিষয়টি উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন যে তাঁর জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের করা ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলছিল। ১৯২৮ সালের দিকে কাজী নজরুল ইসলামের সব থেকে ঘনিষ্ট বন্ধু কাজী মোতাহের হোসেনকে লেখা এক চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন- ‘রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন- ‘দেখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলির মতো, কিটস এর মতো খুব বড় একটা ট্রাজেডি আছে। তুই প্রস্তুত হ!’ বিশ্বকবির সেই ভবিষ্যদ্বাণীই যেন ১৯৪২ সালে এসে সত্যে পরিণত হয়। কবির জীবনে নেমে আসে দুর্যোগের ঘনঘটা। অর্থসংকট, নিজের শারীরিক অসুস্থতা, স্ত্রী প্রমীলার পঙ্গুত্ব। সব মিলিয়ে একটা জীবনসংহারী বেদনার বিষে বিষিয়ে উঠছিলেন আমাদের প্রাণের কবি, জাতিসত্তার কবি কাজী নজরুল ইসলাম।