নগরীর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করবে সিটি কর্পোরেশন

81

নগরীর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এ লক্ষ্যে ওয়ার্ডভিত্তিক জরিপের কাজ চলছে। চসিকের পাইলট প্রকল্পের অধীনে এ জরিপ চালাচ্ছে বায়োডাইভার্সিটি রিসার্চ গ্রূপ অব বাংলাদেশ (বিআরজিবি)। জরিপ শেষে বিদ্যমান জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে চসিক।
ইতোমধ্যে সিটি কর্পোরেশনের ৮নং শুলকবহর ওয়ার্ডের জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। যেখানে ৭৯০টি প্রজাতি চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ২২ প্রজাতির অনুজীবের মধ্যে ১৬টি ছত্রাক এবং ৬টি ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে গ্যানোডার্মা নামের একটি ছত্রাক (ঔষধি) সংগ্রহ করেছে বিআরজিবি।
গত বছরের ৮ অক্টোবর সিটি কর্পোরেশনের ৪১ ওয়ার্ডজুড়ে জীব-বৈচিত্র্য জরিপ চালাতে সিটি কর্পোরেশনের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে বিআরজিবি। এরই প্রেক্ষিতে জরিপ শেষে শুলকবহর ওয়ার্ডের জীব-বৈচিত্র্য রিপোর্ট সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে প্রতিষ্ঠানটি।
গতকাল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কনফারেন্স হলে জীব-বৈচিত্র্য সার্ভে এবং সংরক্ষণ শুলকবহর ওয়ার্ডের পাইলট প্রকল্প হন্তান্তর অনুষ্ঠান হয়। সেখানে এসব তথ্য জানানো হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, বিপুল জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ। আমাদের এ বিপুল জনসংখ্যা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে জীব-বৈচিত্র্যের সাথে সম্পৃক্ত। সে হিসেবে জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। নগরের প্রতিষ্ঠান হিসেবে চসিক এ দায়িত্ব কোনভাবে এড়াতে পারে না। তাই নগরীর সকল ওয়ার্ডের জীব-বৈচিত্র্যের জরিপ ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। পাইলট প্রকল্পের অধীনে একটি ওয়ার্ডের জরিপ শেষ হয়েছে। ক্রমান্বয়ে আরও ৪০টি ওয়ার্ডের জরিপ করা হবে। তারপর জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে চসিক। কেননা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা না করে উন্নত নগরায়ন কখনও নিশ্চিত করা যাবে না।
অন্যদিকে জরিপের সার সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়, শুলকবহর ওয়ার্ডকে চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করে তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে (অনুজীব, উদ্ভিদ ও প্রাণি) বিআরজিবি জরিপ করে। অবশেষে দলগুলি ওই ওয়ার্ডে ৭৯০টি প্রজাতি চিহ্নিত করেছে। ৩০২টি গণ এবং ১১২টি পরিবারের অন্তর্গত ৩৯০টি উদ্ভিদ প্রজাতি চিহ্নিত হয়েছে, যার অধিকাংশই বনজ, ফলদ, ফুল-বাগান, কৃষি ও ওষুধের জন্য অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ গাছ, ৩৫ শতাংশ গুল্ম, ১৫ শতাংশ দুর্বা এবং ১৩ শতাংশ লতা গাছের সন্ধান পাওয়া যায়।
এছাড়া ৩৭০টি প্রাণী প্রজাতির মধ্যে ৪টি ক্রাস্টাসিয়া, ৫ প্রজাতির শামুক, ২০৫ প্রজাতির পোকা,, ১২ প্রজাতির মাকড়সা, ১৬ প্রজাতির মাছ, ৫ প্রজাতির উভচর, ৫ প্রজাতির টিকটিকি, ৭ প্রজাতির শাপ, ৫৯ প্রজাতির পাখি এবং ১৩ প্রজাতির বন্যপ্রাণি রয়েছে। জরিপে ১৮টি খামার প্রাণির মধ্যে ৪ জাতের মুরগী, ৩ জাতের হাঁস এবং কয়েক জাতের কোয়েল, ৪ জাতের গবাদি পশু এবং ৩ জাতের ছাগল পাওয়া গেছে। স্থানীয় ও বিদেশি জাতের বিড়াল এবং কুকুরও তালিকাভুক্ত করা হয়। একই সাথে এ্যাকুয়ারিয়ামে ১২টি প্রজাতির মাছ, কুকুরের ৪টি ভ্যারাইটি, ১টি প্রজাতির চিত্রল হরিণ এবং ১০ প্রজাতির পাখি বন্দী অবস্থায় পাওয়া গেছে। এছাড়া এ ওয়ার্ডে অনেক প্রজাতির জীব বিলুপ্তির হুমকিতে আছে।
চসিকের প্রধান নিবার্হী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সামসুদ্দোহা সভায় সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠানে বায়োডাইভার্সিটি রিচার্স গ্রুপ অব বাংলাদেশ (বিআরজিবি) এর চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. বদরুল আমিন ভূইয়া পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে জীব-বৈচিত্র্যের জরিপ তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কামাল হোসাইন এবং চবির প্রাণি বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মো. ইসমাঈল মিয়া বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে সিটি মেয়র আরও বলেন, মানুষসহ সমগ্র প্রাণী ও উদ্ভিদজগতের বেঁচে থাকার জন্য প্রাকৃতিক ভারসাম্য একান্ত অপরিহার্য। আর এ ভারসাম্য বজায় রাখতে সঠিক সংখ্যায় সকল প্রাণি ও উদ্ভিদ প্রজাতির বেঁচে থাকাটা দরকার। মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকা এবং স্বাভাবিক জীবন যাপনের স্বার্থে জীব-বৈচিত্র্য রক্ষা করা আবশ্যক। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেঁচে থাকার জন্য জীব-বৈচিত্র্যের প্রয়োজন। শুধু কয়েকটি আলোচিত প্রজাতি রক্ষা করলেই জীব-বৈচিত্র্য রক্ষা হয় না। জীব-বৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন সব প্রকারের জীব প্রজাতির ব্যাপারে সমান গুরুত্ব দেয়া। কাজটি অচিরে শুরু করবে চসিক।
জীব-বৈচিত্র্য সার্ভে ও সংরক্ষণ প্রকল্পের চেয়ারম্যানের প্রস্তাবে সিটি মেয়র বলেন, হারিয়ে যাওয়া জীব-বৈচিত্র্যের সংরক্ষণ করা খুব জরুরি। তাই চট্টগ্রাম নগরে একটি জীব-বৈচিত্র্য সংগ্রহশালা (জাদুঘর) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হবে। এতে আমি সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো।
বিআরজিবি’র জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণে সুপারিশসমূহ যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাস্তবায়নেরও আশ্বাস দিয়ে মেয়র বলেন, মানুষের মধ্যে জীবাণু বিস্তারের সম্ভাব্য কীট-পতঙ্গ বিশেষত ডেঙ্গুর জীবাণু বাহক এডিস মশাও এ ওয়ার্ডে পাওয়া যায়। নগরায়নের কারণে চট্টগ্রাম শহরে জীব-বৈচিত্র্য বর্তমানে হুমকিতে রয়েছে। তাছাড়া ক্ষতিকর পতঙ্গ দমনে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে এবং উপকারী পতঙ্গ যেমন- পরাগায়নকারী মৌমাছি ও প্রজাপতি মারা পড়ছে।
এ সার্ভেতে বিআরজিবি’র বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. আমিন উদ্দিন মৃধা, প্রফেসর ড. মো. ইসমাইল মিয়া, প্রফেসর ড. মো. কামাল হোসাইন, প্রফেসর নোমান আহমদ সিদ্দিকী, ড. শেখ আবদুল মান্নান, ড. শহিদুর রহমান, সন্তোষ মজুমদার, উম্মে হাবিবা রীমা, আকতার হোসেন, ড. এম এ খালেকসহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চটগ্রাম কলেজের ১৬ জন ছাত্র-ছাত্রী অংশ নেন।