নগরীতে শতকোটি টাকার ‘ভর্তি কোচিং’ বাণিজ্য!

256

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শেষ হয়েছে মাস খানেক আগে। ফলাফলের তারিখ এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। কিন্তু পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ভর্তি কোচিংয়ের’ তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
এ সময় নগরীর বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে প্রায় শতকোটি টাকার অধিক বাণিজ্য হয়। তবে যে ভর্তিকে কেন্দ্র করে এ বাণিজ্য, তা কেবলই ‘অসাধু শিক্ষা মাফিয়াদের’ সৃষ্টি এবং মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য কোনো কোচিংয়ের প্রয়োজন নেই বলে বলে দাবি করেছেন শিক্ষাবিদরা।
এছাড়া সরকারের নির্ধারিত শিক্ষার্থী প্রতি ১৫ শতাংশ ভ্যাট কেবলই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ! কোচিং পরিচালকরা যৎসামান্য টাকা ভ্যাট দিয়ে কোটি কোটি টাকা প্রতিবছর হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
সরকারি মেডিকেলের, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা আলাদা কোচিং রয়েছে। এরপরই রয়েছে বিভিন্ন ‘স্যারের’ বিশেষ প্রাইভেট পোগ্রাম। তার উপর অনেকে একই কোচিংয়ে কয়েকটি ইউনিটে কোচিং করে। কলেজ ও মাদ্রাসা থেকে পাস করা প্রতিবছর লাখের অধিক শিক্ষার্থী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কোচিং করে। ইউনিট প্রতি সর্বনি¤œ ফি ৭ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা। এর বাইরে অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করেন কোচিং মালিকরা। সবমিলিয়ে এ সময়টায় শতকোটি টাকার অধিক বাণিজ্য হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করা হলেও তারা সরকারকে ভ্যাট দেন যৎসামান্য। পূর্বদেশের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া অভিনব কায়দার কথা।
জানা গেছে, প্রতিটি কোচিংয়ে তিনটি করে ‘ভাউচার’ বই করা হয়। একটি শিক্ষার্থীদের দেখানোর জন্য, আরেকটি সত্যিকারের হিসাব রক্ষার জন্য এবং বাকিটা ভ্যাট প্রদানের জন্য। যে পরিমাণ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, তার সামান্য একটি অংশ ভ্যাট দেওয়ার সময় দেখানো হয়। এতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করা হয়। আর এটা কোচিং পাড়ায় ‘কন্ট্রাক ভ্যাট’ নামে পরিচিত।
খবর নিয়ে জানা গেছে, নগরীতে সবচেয়ে বেশি স্টুডেন্ট পায় ইউসিসি কোচিং সেন্টার। তাদের চকবাজার ও জিইসি মোড়ে শাখা রয়েছে। এছাড়া হাটহাজারী উপজেলায়ও একটি শাখা রয়েছে। এ তিনটি শাখায় প্রতিবছর তারা ১০ হাজারের অধিক শিক্ষার্থীর কোচিং করায়। তবে সেই সংখ্যা হাজার-বারশয়ের বেশি নয় বলে দাবি করেন চট্টগ্রামে কোচিং সেন্টারটির পরিচালক আব্দুর রব সোহেল।
তিনি পূর্বদেশকে বলেন, আমাদের শহরের দুইটি শাখায় হাজার-বারশ স্টুডেন্ট হয়। এসব শিক্ষার্থীর ভ্যাট দেওয়া হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভ্যাটের হিসেবে চার-পাঁচশ শিক্ষার্থী হয়। কেননা আমাদের অনেক শিক্ষার্থী শুধু মডেল টেস্টের জন্য ভর্তি হয় এবং ইউনিটভিত্তিক হিসেব রয়েছে। তাছাড়া আমাদের সকল হিসেব কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা পাঠানো হয়। সেখান থেকে ভ্যাট দেওয়া হয়।
এর পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং। যেটি প্রতিবছর ৬ হাজারের মত শিক্ষার্থী পায়। এছাড়া এ তালিকায় আরও রয়েছে উদ্ভাস কোচিং, বিটি, থ্রি ডক্টরস, রেটিনা, ফোকাস, ইনডেক্স, ইউনিএইড, প্যারাগন, রিডক্স, রেডিয়েশন, আলফাসহ আরও অনেক কোচিং সেন্টার। এছাড়া শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং নয়, সারাবছরের বিভিন্ন একাডেমিক ও বিসিএস কোচিংও একই পদ্ধতিতে ভ্যাট ফাঁকি দেয় বলে জানা গেছে।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর চাহিদার তুলনায় আসন সংখ্যা অপ্রতুল। তাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে প্রতিযোগিতা করে ভর্তি পরীক্ষায় ঠিকতে হয়। ফলে এ প্রতিযোগিতাকে পুঁজি করে বাজার সৃষ্টি করেছে কোচিং সেন্টার। অনেকে মনে করছেন, যতদিন ভর্তি পরীক্ষা, ততদিন এ কোচিং বাণিজ্য থাকবে।
এ বিষয়ে সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ ফজলুল হক বলেন, মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য কোনো কোচিংয়ের প্রয়োজন নেই। এসব কেবল শিক্ষা মাফিয়াদের সৃষ্টি। তারা কোচিংয়ের একটি বাজার তৈরি করেছে। যার কারণে শিক্ষার্থী বা অভিভাবকরা মনে করেন কোচিং ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সম্ভব নয়। যার পেছনে শিক্ষা মাফিয়ারা সুকৌশলে কাজ করেছে। তারা যত্রতত্র বুকলেট, লিফলেট করে প্রচার করেছে কোচিং করার কারণে এত পরিমাণ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকেছে। অমুক প্রথম হয়েছে বা দ্বিতীয় হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এ কোচিং বাণিজ্যের প্রসার হয়েছে জামায়াত-শিবিরের হাত ধরে। তারা কোচিং চালিয়েছে স্বাধীনতা বিরোধী আদর্শ প্রচার করতে। তাছাড়া এখান থেকে তাদের কর্মীবাহিনী চালানোর জন্য আয়ের ব্যবস্থা হয়। এ ধারা এখনও চলমান। কোচিং থেকে জন্ম হয় শিক্ষা মাফিয়াদের। তারা পরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত হয়। আবার তারাই শিক্ষার পদ্ধতিগত সংকটকে পুঁজি করে বিভিন্ন বাণিজ্যের জন্ম দেয়। এমনকি ‘প্রক্সি’ পরীক্ষা দেওয়া বা প্রশ্ন ফাঁসের কলঙ্কজন ঘটনার পেছনে চাহিদা তৈরি করে এসব শিক্ষা মাফিয়ারা। তাই শিক্ষাকে এদের হাত থেকে বাঁচাতে হলে কোচিং বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় এক সময় পুরো শিক্ষাখাত এরাই নিয়ন্ত্রণ করবে। তবে বর্তমান সরকার সুন্দর শিক্ষানীতি করেছে, কোচিংকে নিরুৎসাহিতও করেছে। এ সরকারের আমলেই অসুস্থ এ বাণিজ্য বন্ধ হবে।
তিনি উদাহরণ টেনে আরও বলেন, আগে কলেজে ভর্তি নিয়ে বিশাল বাণিজ্য হত। সেটা এখন অনলাইনে ফলাফলের ভিত্তিতে হওয়ায়, এখন ঝামেলা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও এমনটা হওয়া উচিত।
প্রসঙ্গটি নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা পড়তে আসেন। তবে ভর্তি হওয়ার আগে কোচিং করে অনেক টাকা খরচ করেন তারা। যা আমাদের অনেক কষ্ট দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য কোনো কোচিংয়ের প্রয়োজন নেই। সরকার এখন সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষা চালু করছে। তখন ‘অটোমেটিক’ কোচিং প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে যাবে।
এ বিষয়ে কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার মোহাম্মদ এনামুল হক পূর্বদেশকে বলেন, আমাদের কাছেও কোচিং সেন্টার নিয়ে প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। তারা প্রকৃত ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা গোপন রেখে ভ্যাট প্রদান করেন। যা কোনভাবেই কাম্য নয়। যারা কোচিং সেন্টার পালন করেন, তারা সবাই শিক্ষিত নাগরিক। তাদের বিরুদ্ধে আমরা অন্যদের মত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চাই না। তাই সময়ের মধ্যে সরকারকে সত্যিকারের ভ্যাট দেওয়ার জন্য আহŸান রইল। তবে আমরা চট্টগ্রামের কোচিংগুলোর খোঁজ-খবর নিচ্ছি, শীঘ্রই ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এতদিন এসব প্রতিষ্ঠান ক্লোজলি মনিটরিং করা হয়নি, এখন সবাইকে নিয়মিত মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হবে।