নগরীতে দুই মাসে ২০ হত্যাকান্ড

57

নগরীতে একের পর এক হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে। বন্ধুর হাতে বন্ধু, ছেলের হাতে পিতা, স্বজনের হাতে স্বজন খুন হচ্ছে। গত দুইমাসে ২০টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। অজ্ঞাত মরদেহ মিলেছে ১০টি। অধিকাংশ হত্যাকান্ডের মোটিভও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে দক্ষিণ কাট্টলীতে কিশোর গ্যাং স্টারের কোন্দলে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে এক তরুণকে। অনুসন্ধানে জানা যায়, সাম্প্রতিককালে খুনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। তুচ্ছ ঘটনায়ও খুন হচ্ছে। কিশোর গ্যাংও খুনে জড়িয়ে পড়ছে। কথা কাটাকাটির জের ধরে পাহাড়তলী থানাধীন দক্ষিণ কাট্টলীতে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওই তরুণ নগরীর পাহাড়তলী এলাকার একটি কিশোর অপরাধী গ্যাংয়ের সদস্য বলে জানিয়েছে পুলিশ। নিহতের নাম মোবারক হোসেন (২০)। সে দক্ষিণ কাট্টলী মুরগী ফার্ম এলাকার মোশারফ হোসেনের ছেলে। এ ঘটনায় দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হল মো. রুবেল (১৮) ও মো. হৃদয় (১৭)।
পুলিশ জানায়, রাত সাড়ে ১২টার দিকে সিডিএ সাগরিকা গরুর বাজারের বিপরীতে বসে গল্প করছিল মোবারক, রুবেল, হৃদয়সহ আরও কয়েকজন তরুণ। একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হলে এক পর্যায়ে রুবেলকে চড় দেয় মোবারক। চড় খেয়ে রুবেল সেখান থেকে চলে যায় এবং আরও কিছু বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসে মোবারককে মারধর করে। এক পর্যায়ে বাঁশ দিয়ে মোবারককে আঘাত করলে সে মাটিতে পড়ে যায়। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পাহাড়তলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঈনুর রহমান জানান, ভিকটিম ও হত্যাকারীরা সবাই একই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। তারা বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে চুরি-ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজ করে।
গত ১৫ জুলাই চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা বি-বøকের ৩ নম্বর রোডে সিডিএ স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ নুরুল আলমের বাসা থেকে উম্মে হাবিবা (২২) নামে এক গৃহকর্মীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই গৃহকর্মীকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে পুলিশের কাছে দাবি করেছেন সিডিএ স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ নুরুল আলম। তবে পুলিশ রহস্যজনক মৃত্যু বলে তদন্ত করে যাচ্ছে। ১৩ জুলাই পতেঙ্গা এলাকা থেকে অজ্ঞাতনামা এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মরদেহে একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
গত ১০ জুলাই ডবলমুরিং থানাধীন ব্যাপারী পাড়া এলাকার একটি বাসা থেকে তরুণীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তার নাম তানজিনা আক্তার তামান্না (২০)। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করা হলে পুলিশ তদন্ত করছে। একই দিন সকাল ১০টায় বায়েজিদ বোস্তামি থানার আমিন কলোনি এলাকায় দোকানের ওয়াইফাই কানেকশন নিয়ে ঝগড়াকে কেন্দ্র করে ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছে আবুল কালাম (২৫) নামে এক দোকানদার। নিহত আবুল কালাম কুমিল্লার আবদুর রহমানের ছেলে। তিনি বায়েজিদের আমিন কলোনি এলাকায় একটি বিকাশ-ফ্ল্যাক্সি লোডের দোকান পরিচালনা করতেন।
পুলিশ জানায়, ৯ জুলাই রাতে আবুল কালামের সঙ্গে পাশের দোকানদার মামুনের দোকানের ওয়াইফাই কানেকশন নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বুধবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মামুন তার ভাই ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসে তার উপর হামলা চালায়। ছুরিকাঘাতে তার মৃত্যু হয়।
৭ জুলাই হালিশহর বি-বøক থেকে উদ্ধার করা হয় আবদুর রহিম নামে এক ব্যক্তির মরদেহ। তাকে কে বা কারা হত্যা করে রাস্তার পাশে ফেলে যায় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
৬ জুলাই চান্দগাঁও থানার মোহরা রেললাইন এলাকায় এক তরুণীকে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়। রেললাইনের উপর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে তার সৎ বাবা মেয়েটিকে খুন করেছে বলে রেলওয়ে থানা পুলিশ জানতে পেরেছে।
৪ জুলাই চান্দগাঁও রাস্তার মোড় থেকে উদ্ধার করা হয় এক বৃদ্ধের মরদেহ। তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে বলে পুলিশের ধারণা।
সিএমপি কমিশনার মো. মাহবুবুর রহমান ক্রাইম কনফারেন্সে বলেছেন, যে কোন মূল্যে নগরীর আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে হবে। কোনভাবেই যাতে কেউ আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে। অপরাধীদের ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। খুনসহ গুরুত্বপূর্ণ মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার পূর্বক আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে। তিনি বলেন, অনেক চাঞ্চল্যকর খুনের রহস্য পুলিশ উদঘাটন করেছে। আসামিও গ্রেপ্তার করেছে।
এর আগে ৩০ জুন পাঁচলাইশ থানাধীন ষোলশহর এলাকার একটি ভাড়া বাসা থেকে মা ও মেয়ের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মসজিদ গলিতে অবস্থিত একটি কাঁচা বসতঘর থেকে মরদেহ দু’টি উদ্ধার করা হয়। নিহতরা হলেন ল²ী রানী সরকার (২২) ও তার দুই বছরের শিশু কন্যা অনন্যা রানী সরকার।
পাঁচলাইশ থানার ওসি আবুল কাশেম ভূঁইয়া জানান, সকালে স্ত্রী এবং মেয়েকে বাসায় রেখে কাজে বেরিয়ে পড়েন ল²ী রানীর স্বামী নন্দন সরকার। বিকেলে বাসায় ফিরে দু’জনের কারও সাড়া-শব্দ না পেয়ে দরজা ভেঙে বাসার ভেতরে ঢুকেন তিনি। এসময় স্ত্রী ও মেয়ের মরদেহ ছাদের সঙ্গে রশি পেঁচিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান নন্দন। তাদের খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন নন্দন সরকার।
২৯ জুন পূর্ব নাসিরাবাদ ভূঁইয়া গলির একটি বাসা থেকে শাহেদুল আলম (৩০) নামে এক যুবকের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ যুবককে কে বা কারা খুন করেছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।
২৮ জুন ওয়াসা মোড় এলাকার জমিয়তুল ফালাহ জামে মসজিদ সংলগ্ন আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের নিচ থেকে আনুমানিক ৪০ বছর বয়সী অজ্ঞাত এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই নারীকে দুর্বৃত্তরা হত্যা করে থাকতে পারে বলে পুলিশের ধারণা।
২৭ জুন সাগরিকা টোল রোড এলাকা থেকে নিখোঁজ আবুল হোসেন (৪৫) নামে এক চালকের মরদেহ উদ্ধার করে পাহাড়তলী থানা পুলিশ। তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ২৫ জুন সকাল সাড়ে ১১টার দিকে অফিসে যাওয়ার কথা বলে গাড়ির চাবি নিয়ে লালখান বাজার এলাকার বাসা থেকে বের হন আবুল। ওইদিন দুপুর দেড়টা থেকে তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
২৫ জুন পুরাতন চান্দগাঁও এলাকা থেকে রাকিব (২৪) নামে এক কাভার্ড ভ্যান চালকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশের ধারণা, সোমবার রাতের কোনো এক সময়ে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।
২৪ জুন বায়েজিদ বোস্তামি থানা এলাকা থেকে কবিতা রানী (২২) নামে এক নারী পুলিশ কনস্টেবলের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। চক্রেসো কানন আবাসিক এলাকার সোলেমান ম্যানশনের ২য় তলা থেকে মরদেহটি উদ্ধার করা হয়্। তার মৃত্যু রহস্যজনক বলে পুলিশ জানিয়েছে।
২৩ জুন ইপিজেড থানাধীন বন্দরটিলা এলাকা থেকে সঞ্জয় ধর (৪৬) নামে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই এলাকার মনিশ্রী জুয়েলার্স নামের জুয়েলারি দোকান থেকে মরদেহটি উদ্ধার করে ইপিজেড থানা পুলিশ। সঞ্জয় ধরের বাড়ি কক্সবাজারের রামু উপজেলায় হলেও ব্যবসা সূত্রে থাকতেন বন্দরটিলা এলাকায়। তিনি রামুর ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের মৃত সুধারাম ধরের ছেলে। তার পেটের দুইপাশে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। পুলিশ ধারণা করছে, টাকার লেনদেন সংক্রান্ত ঘটনায় সঞ্জয়কে হত্যা করা হয়েছে। যাওয়ার সময় সিসিটিভি খুলে নিয়ে যায় হত্যাকারীরা।
২০ জুন ইপিজেড থানাধীন মাইলের মাথা এলাকায় মো. মোবারক (২৫) নামের এক যুবককে ছুরিকাঘাতে খুন করে সন্ত্রাসীরা। পুলিশ জানায়, তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে।
৬ জুন চকবাজার থানাধীন ডিসি রোডের চাঁনমিয়া মসজিদ সংলগ্ন এলাকার একটি বাসা থেকে বিউটি আক্তার (২৬) নামে এক গৃহবধর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর গৃহবধূর স্বামী গোলাম কিবরিয়া রিপনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বিউটি আক্তারের বাড়ি কুমিল্লায়। তিনি স্বামীসহ ডিসি রোডে ভাড়া বাসায় থাকতেন। বিউটি আক্তারের আড়াই বছর বয়সী এক ছেলে সন্তান রয়েছে। বিউটির স্বামী গোলাম কিবরিয়া রিপন পেশায় গাড়িচালক বলে জানিয়েছে পুলিশ।
জানা যায়, অধিকাংশ খুনের রহস্য এখনো উদঘাটন হয়নি। আসামিও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। বিশেষ করে অজ্ঞাতনামা মরদেহের রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ।