নগরীতে চলছে ৫ হাজার ‘গ্রাম সিএনজি ট্যাক্সি’

289

মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় চলছে চট্টগ্রাম জেলায় অনুমোদিত সিএনজি ট্যাক্সি। যেগুলো সাধারণ মানুষের কাছে ‘গ্রাম সিএনজি ট্যাক্সি’ হিসেবে পরিচিত। স্থানীয় নেতা ও পুলিশকে ম্যানেজ করেই এসব গাড়ি চলাচল করছে, যার নেতৃত্বে রয়েছে বিভিন্ন সিন্ডিকেট। অন্যদিকে মহানগরীতে অনুমোদনপ্রাপ্ত গাড়িগুলোও নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ মালিক সমিতির।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রামে আঞ্চলিক ট্রান্সপোর্ট কমিটির নিয়মানুযায়ী মহানগরী এলাকায় সিএনজি ট্যাক্সি চলাচলের নির্দেশনা রয়েছে ১৩ হাজার। কিন্তু অতিরিক্ত পাঁচ হাজারেরও বেশি সিএনজি ট্যাক্সি চলাচল করছে যা সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। মহানগরীতে যেসব ট্যাক্সিগুলো চলাচল করে সেগুলোর নাম্বার হচ্ছে চট্ট মেট্রো থ। কিন্তু তার বাইরেও নগরীর বিভিন্ন সড়কে দেখা গেলো ‘চট্টগ্রাম থ’ এবং ‘চট্টগ্রাম দ’ শ্রেণির ট্যাক্সি। যার মধ্যে ‘চট্টগ্রাম থ’ গাড়ি চলাচল করবে চট্টগ্রাম জেলা এলাকায় আবার ‘চট্টগ্রাম দ’ ট্যাক্সিগুলো ব্যক্তিগত। যা কখনো ভাড়ায় চালিত হতে পারে না। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে এসব গাড়ি শহরের আনাচে কানাচে কিভাবে চলে? তার ইন্ধন দিচ্ছে কে, বিআরটিএ নাকি পুলিশ, প্রশ্ন জনমনে।
আবার ২০০০ সালে নিবন্ধন বাতিল হওয়া টু স্ট্রোকের (বেবি ট্যাক্সি) গাড়ির নম্বরগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে এসব ট্যাক্সিগুলোতে। যার তদারকি করছে না কেউ। ফোর স্ট্রোকের গাড়িগুলোতে ওই নম্বর ব্যবহার করা যাবে না। আবার আদালত থেকে যেসব গাড়ি স্ক্র্যাপের জন্য বিক্রি করা হয় সেসব গাড়িও কোর্ট থেকে নিলামকৃত বলে মহানগরীতে চলাচল করা হচ্ছে।
সরেজমিনে নগরীর নগরীর টাইগারপাস এলাকা থেকে তিনটি রুটে অবৈধভাবে গ্রাম সিরিয়ালের ট্যাক্সি অটোরিকশা চলাচল করতে দেখা গেছে। এসব রুটগুলো হলো- টাইগারপাস থেকে ওয়ার্লেস, পাহাড়তলী পুলিশ বিট, ঝাউতলা। এসব ট্যাক্সি আমবাগান এলাকায়ও স্টেশন তৈরি করে তবে সেটার নির্দিষ্ট কোন রুট নেই। অন্যান্য রুটের গাড়ি সেখানে অবস্থান করতে পারে। টাইগারপাস মোড়ের একাধিক ট্যাক্সি চালকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, টাইগারপাস থেকে ওয়ার্লেস মোড় পর্যন্ত ৫৪টি, টাইগারপাস থেকে পাহাড়তলী পুলিশ বিট পর্যন্ত ৫২টি এবং টাইগারপাস থেকে ঝাউতলা পর্যন্ত ৫৩টি অবৈধ গ্রাম ট্যাক্সি অটোরিকশা চলাচল করে।
আরও জানা যায়, অবৈধভাবে এসব ট্যাক্সি অটোরিকশা নগর দাপিয়ে বেড়ানোর পেছনে কয়েকটি সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে। এদের মধ্যে পুলিশ, ক্ষমতাসীন দলের নেতা এবং ভুয়া সাংবাদিকরাও জড়িত রয়েছে বলে জানা গেছে। টাইগারপাস থেকে তিনটি রুটে চলাচল করা এসব ট্যাক্সি অটোরিকশা চালকদের কয়েকধাপে টাকা দিতে হয় বলে জানা যায়।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে কয়েকজন সিএনজি ট্যাক্সি চালক বলেন, প্রথমে লাইনে সংযুক্ত করতেই ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা লাগে। তার পাশাপাশি লাইন খরচ, টিআই খরচ, থানা খরচ নামে তাদের থেকে টাকা তোলা হয়। তবে ‘থানা খরচ’ ট্যাক্সির মালিকদের থেকে নেওয়া হয়। যদি টাকা দেওয়া না হয় ট্যাক্সি আটক করা হয়। আটককৃত ট্যাক্সি আবার পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছাড়িয়ে আনতে হয়। প্রতিদিন চালকরা টাইগারপাস লাইনম্যানকে ৫০ টাকা এবং তিনটি রুটের স্থানীয় লাইনম্যানকে ১০ টাকা করে দিতে হয়। এই টাকাগুলো থেকে বিভিন্ন জায়গায় পাঠান লাইনম্যানরা। তাছাড়াও ট্যাক্সি মালিকদের সিন্ডিকেট হতে প্রতিমাসে প্রতিটি ট্যাক্সির জন্য ৫০০ টাকা থানা খরচ দিতে হয়, কেউ কেউ বলছেন থানা খরচ ১ হাজার টাকা।
নগরীর টাইগারপাস এলাকায় এই তিনটি রুটের লাইনম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন মনা নামের এক ব্যক্তি। নির্দিষ্ট কোন অফিস না থাকলেও টাইগারপাসে অবৈধভাবে গড়ে উঠা একটি জুতার দোকানে নিয়মিত বসে এসব তদারকি করেন তিনি। সেখানে গিয়ে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। দোকানের মালিক কাউসারের কাছে মনা অথবা এই লাইনের দায়িত্বে থাকা যে কারো ব্যবহৃত মুঠোফোন নাম্বার চাওয়া হলেও সেটি দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি। কথা বলার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, এখান থেকে পুলিশ টাকা নিয়ে যায়। আমি এই দোকানে সবসময় থাকি আপনিও আসবেন কথা বলবো। সুবিধা-অসুবিধা বলবেন-আমরা দেখবো।
স্থানীয় শহিদ নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমরা নগরে বসবাস করলেও গ্রাম ট্যাক্সিগুলো টাইগারপাসের পশ্চিমদিক পুরোটা দখল করে আছে। এখানে প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ গাড়ি চলাচল করে। আর এসব ট্যাক্সির জন্য টাইগারপাস থেকে সাগরিকা পর্যন্ত চলাচলকারী গাড়িগুলোকে ভোগান্তি পোহাতে হয়।
তিনি আরও বলেন, টাইগারপাস এলাকার এসব ট্যাক্সি চালকদের নিয়ন্ত্রণ করেন কবির হোসেন এবং বাবুল। এখানে সমিতির কথা উল্লেখ করা হলেও মূলত স্বীকৃত কোন সমিতি বা কমিটি নেই, সবই একটা সিন্ডিকেট।
কোথায় কোথায় টাকা দেন প্রশ্নে বলেন, টাইগার পাস ট্রাফিক বক্সের সোহাগকে পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। যখন যেভাবে ম্যানেজ করা যায়। আর টিআই, এসি এবং থানা পুলিশকে তো অনেক বেশি দেয়া লাগে। তা নাহলে গাড়ি চলাচলই করতে দিবে না।
এভাবে শুধু টাইগার পাস, আমবাগান নয়। নগরের বায়েজিদ, হিলভিউ আবাসিক, অক্সিজেন, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, কাপ্তাই রাস্তার মাথাসহ নানা রুটে পারমিট ছাড়াই প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি গ্রাম সিএনজি ট্যাক্সি চলাচল করছে। প্রত্যেকেই নিজস্ব বানানো রুট ব্যবহার করে আর বিভিন্ন মহলে টাকা প্রদান করে। এতে নগরীর রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত সিএনজি ট্যাক্সির চালকরা পথে বসতে বসেছে।
অক্সিজেন এলাকার মোহাম্মদ কবির বলেন, সরকার নতুন করে কোন ট্যাক্সির নিবন্ধন না দেওয়ায় নগরীতে প্রায় ৬ হাজার ড্রাইভার বেকার রয়েছে। এসব ড্রাইভারের অনেকে আবার গ্রাম ট্যাক্সি চালায়। আবার নগরীতে অবৈধভাবে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চললেও প্রশাসন কারোরই বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এমনটা হচ্ছে।
অথচ এসব গাড়ির বিরুদ্ধে সিএমপি ট্রাফিক কমিশনার বরাবর বারবার অভিযোগ করে আসছেন চট্টগ্রাম মহানগরী অটোরিক্সা বেবিট্যাক্সি মালিক সমিতি। তারা অভিযোগে বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীতে জেলা এলাকার অসংখ্য সিএনজি অটোরিক্সা ট্রাফিক সার্জেন্ট ও টিআই সাহেবদের মাসিক টোকেনের মাধ্যমে নগরীতে অবাধে চলাচল করছে, পাশাপাশি বিভিন্ন ভুয়া নম্বরে প্রাইভেট সিএনটি ট্যাক্সি ও কোর্ট থেকে নিলামকৃত ট্যাক্সিও বিভিন্ন টোকেনের মাধ্যমে বিভিন্ন পয়েন্টে স্টেশন করে চলাচল করছে। যেমন মুরাদপুর, অক্সিজেন, নতুনব্রিজ, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, টাইগার পাস সংলগ্ন স্থানসমূহে অবস্থান নিয়ে চলাচল করছে। কিন্তু চট্ট মেট্রোতে রেজিস্ট্রেশন পাওয়া সিএনজি ট্যাক্সিসমূহ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে মামলা দেয়া থেকে শুরু করে নানা হয়রানি করা হয়, এককথায় টো করে দেয়া হয়। এই ধরনের নির্যাতন ও হয়রানি অচিরেই বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি অবৈধ সিএনজি ট্যাক্সি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় সমিতির পক্ষ থেকে কঠোর কর্মসূচি দেয়া ছাড়া অন্যকোন পথ থাকবে না।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম মহানগরী অটোরিক্সা বেবিট্যাক্সি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক টিটু চৌধুরী বলেন, আমরা এ নিয়ে কয়েকবার সিএমপি কমিশনার বরাবর অভিযোগ করে আসলেও কোন ফল পাইনি। ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে যখন অভিযোগ করেছিলাম তখন উনারা বলেছিলেন- নির্বাচনটা যাক তারপরে ব্যবস্থা নিবো। কিন্তু নির্বাচন গেলেও উনারা কোন কিছুই করেননি।
একই সংগঠনের সভাপতি হায়দার আজম চৌধুরী বলেন, আমরা বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেট বরাবরও একটি অভিযোগ করেছিলাম। উনারা তাৎক্ষণিক বেশ কিছু গাড়ি জব্দ করে রেখেছেন এবং উনাদের অভিযানে এসব গাড়ির ব্যাপারে ছাড় দেয়া হয় না। বিআরটিএ অফিসেও এখন অনেক গাড়ি জব্দ আছে। জায়গার সংকটের কারণেও উনারা কিছু করতে পারছেন না। তাই আমার বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেটদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। উনারা যথেষ্ট ভূমিকা পালন করছেন।
এ ব্যাপারে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মোস্তাক আহমেদ পূর্বদেশকে বলেন, আমি চট্টগ্রাম সিএনজি ট্যাক্সি যে চলাচল করছে সে ব্যাপারে কোন অভিযোগ পাইনি। সবেমাত্র যোগদান করেছি। যদি আপনার কথা সত্য হয়ে থাকে তাহলে সংশ্লিষ্ট সকলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে কেউ ছাড় পাবে না।