ধেয়ে আসছে ‘ফণী’

134

বৈশাখের একেবারে গোড়া থেকেই দেশজুড়ে ক্রমান্বয়ে তাপদাহের বিস্তৃতির পর সবচেয়ে উষ্ণতম মে মাসের শুরুতে পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ দেশের উপকূলের আরও কাছাকাছি সরে এসেছে। আজ শুক্রবার সকাল দশটার পর পুঞ্জীভূত শক্তিসমেত ভারতের ওড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আছড়ে পড়বে মৌসুমের প্রথম শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়টি। সেখানে তান্ডবলীলা চালিয়ে শক্তিক্ষয়ের পর খানিকটা দুর্বল হয়েই আজ সন্ধ্যা নাগাদ দেশের খুলনা ও তৎসংলগ্ন উপকূলে ছোবল মারতে পারে ভারত মহাসাগর হয়ে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে ফণা তোলা ঘূর্ণিঝড় ফণী। রাতভর দেশের উপকূলে অবস্থান করার পর শনিবার সকালে স্থলভাগেই তার বিলুপ্তি ঘটবে।
ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে, দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ফণী ওড়িষ্যা রাজ্য উপকূলে আছড়ে পড়ার সময় ঘণ্টায় প্রায় ২০৫ কিলোমিটার গতি থাকবে এই ঘূর্ণিঝড়ের।
গত চার দশকেরও (৪৩ বছর) বেশি সময়, অর্থাৎ ১৯৭৬ সালের পর ভারত মহাসাগরে এত শক্তিশালী ঝড়ের মুখোমুখি হয়নি দেশটি। ঘূর্ণিঝড় ফণী গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে তামিলনাড়ুর বিশাখাপত্তনমের পূর্ব উপকূল থেকে ৬০০ কিলোমিটার ও উপকূল ঘেঁষা পুরী শহর থেকে ৮০০ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। ১৯৭৬ সালের (গত ৪৩ বছরে) পর এখন পর্যন্ত এপ্রিলে বঙ্গোপসাগরে যত ঘূর্ণিঝড় হয়েছে, তার কোনোটি কখনই এত শক্তিশালী আকার ধারণ করেনি। ঘূর্ণিঝড় ফণীর বিষয়ে সতর্কতা জারি করে রেখেছে ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর। ওড়িষ্যায় এরই মধ্যে হলুদ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ও অন্ধ্র প্রদেশের উত্তর উপকূল দিয়েও বয়ে যেতে পারে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ফণী। এ ঘূর্ণিঝড়কে সামাল দিতে এরই মধ্যে অন্ধ্র প্রদেশ, ওড়িষ্যা, তামিলনাড়ু ও পশ্চিমবঙ্গের জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এক হাজার ৮৬ কোটি রুপি আগাম বরাদ্দ দিয়েছে।
দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ খোন্দকার হাফিজুর রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে নয়টায় আবহাওয়ার ৩২ নম্বর বিশেষ বুলেটিনে উল্লেখ করেন, পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ বৃহস্পতিবার রাত নয়টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৯০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৮৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৭২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ৭৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরও ঘণীভূত ও উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে আজ শুক্রবার বিকাল নাগাদ ভারতের ওডিশা উপকূল অতিক্রম করতে পারে এবং পরবর্তীতে ওড়িষ্যা-পশ্চিমবঙ্গ উপকূল হয়ে সন্ধ্যা নাগাদ খুলনা ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এলাকায় পৌঁছাতে পারে। খুলনা ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আজ শুক্রবার সকাল নাগাদ অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ এর অগ্রবর্তী অংশের প্রভাব শুরু হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটার এর মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ১৮০ কিলোমিটার যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটে সাগর খুবই উত্তাল রয়েছে। মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে সাত নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ সাত নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ছয়) নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, ফেনী, চাঁদপুর এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ছয় নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। কক্সবাজার সমূদ্র বন্দরকে চার নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারী সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় এবং অমাবস্যার প্রভাবে উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, ভোলা,পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল
স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪-৫ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রমকালে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা জেলা সমূহ এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণসহ ঘন্টায় ৯০ থেকে ১১০ কিলোমিটার বেগে দম্কা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থান সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
দেশের আবহাওয়াবিদরা ধারণা করছেন, ঘূর্ণিঝড় ফণী কিছুটা দুর্বল হয়ে গেলেও ঘন্টায় প্রায় একশ’ ৮০ থেকে দুইশ’ ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাতাসের গড় গতিবেগ নিয়ে আছড়ে পড়তে পারে। তাতে জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা রয়েছে। থাকতে পারে। এমন শক্তির ঘূর্ণিঝড়ের ছোবলে উপকূলে নজিরবিহীন ক্ষয়ক্ষতির আশংকা রয়েছে। তবে, মে মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষদিকে ঘূর্ণিঝড়ের বিদায়ের পর শুরু হতে যাওয়া পবিত্র রমজানে রোজাদারদের অস্বস্তির অন্যতম কারণ হয়ে উঠতে পারে তাপদাহ। পুর্বাভাসেই এমন ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। পুরো মে মাসজুড়েই দেশের অধিকাংশ এলাকায় দাপট থাকবে তাপদাহের। মাসের শেষের দিকে দেশের উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে একটি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং অন্যান্য স্থানে এক থেকে দুটি মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দুটি নিম্নচাপ সৃষ্টির আলামত রয়েছে, যার একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে।