ধর্ষণ: কারণ ও করণীয়

102

দেশে মহামারী করোনা প্রকোপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধর্ষণ। সাম্প্রতিক সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে তরুণী ধর্ষণ, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে সংঘটিত বর্বরতা, চট্টগ্রামে বান্ধবীর বাসায় এসে ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনায় দেশব্যাপী বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। প্রভাবশালী ব্যক্তির বখে যাওয়া সন্তান ও বিকৃত রুচির মানুষেরা ধর্ষণে সম্পৃক্ত। দেশে স¤প্রতি গণধর্ষণের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় এগুলো শুধু যৌনসুখের উদ্দেশ্যে নয় বরং অপরপক্ষকে দমিয়ে রাখতে ক্ষমতার প্রদর্শন হিসাবে করা হয়। বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, সঠিক সময়ে ছেলে-মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে অভিভাকদের উদাসীনতা, তরুণদের মধ্যে মাদক সেবনের প্রবণতা বৃদ্ধি, পর্ন ভিডিওর সহজলভ্যতা, সামাজিক সুরক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়া, তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার, নৈতিক-অবক্ষয়, অবাধ যৌনাচার, রাস্তার পাশে দেয়ালে নগ্ন পোস্টার, ফুটপাতে অশ্লীল ছবি সম্বলিত যৌন উত্তেজক অবৈধ বইয়ের রমরমা ব্যবসা, অশ্লীল ছায়াছবি প্রদর্শন, ইভটিজিং, অপসংস্কৃতির প্রভাব, মোবাইল পর্ণোগ্রাফি ইত্যাদি কারণে আজ যুবসমাজের মধ্যে দিন দিন ধর্ষণ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একজন নারী ধর্ষিতা হওয়া মানে জাতির বিবেক ধর্ষিত হওয়া। একটি সমাজ যত বেশি নারী ও শিশুবান্ধব সে সমাজ ততবেশি উন্নত। সমাজকে নারীবান্ধব করতে হলে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের এই লাগামহীন ঘোড়াকে এখনই নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। নারী নির্যাতনের এই ভাইরাস থেকে সমাজকে মুক্ত করার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে দল-মত নির্বিশেষে ধর্ষকদের দ্রæত বিচার ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা। আসকের হিসেবে প্রতিদিন বাংলাদেশে কমপক্ষে চার জন নারী ধর্ষণের শিকার হন মাত্র শতকরা তিন ভাগ ধর্ষণের মামলায় অপরাধীরা শান্তি পান। ধর্ষণ বন্ধে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শুধু আইন করে নয়, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বন্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে এক হয়ে লড়তে হবে। স্কুলকলেজে পড়ার সময়ই শিক্ষার্থীদের নারী ও পুরুষের সমানাধিকারের বিষয় শেখাতে হবে। প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থায় নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সরকার সর্বোচ্চ শান্তি মৃত্যুদন্ড করেছে, সবচেয়ে বড় কথা হলো বিচার হওয়া। বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, বিচারহীনতার সংস্কৃৃতি, রাজনৈতিক প্রভাব ইত্যাদি কারণে যথাযথ বিচার হচ্ছে না। আবার নতুন ইস্যু চলে আসলে পত্র-পত্রিকার দৃষ্টিও অন্যদিকে ঘুরে যায়। বিচার যদি দ্রæত না হয় এবং সর্বোচ্চ শাস্তি না হয়, তাহলে এই বিধান অর্থহীন হয়ে যাবে। ধর্ষণ এভাবে চলতে থাকলে সামজিক কাঠামো ধ্বংস হওয়া নিশ্চিত। তাই ধর্ষকদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। শিক্ষার প্রতিটি স্তরে নৈতিক শিক্ষার কোর্স বাধ্যতামূলক করতে হবে। অশ্লীল বইয়ের ব্যবসা বন্ধ করতে হবে, যৌন উত্তেজক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ জারি করতে হবে। ছেলে-মেয়েদেরকে যথাসময়ে বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ধর্ষণ একটি মানসিক বিকৃতি। একজন মানুষের মনুষ্যত্ব যখন শূন্যের কোটায় চলে আসে তখনই সে ধর্ষণ নামক একটি পৈচাশিক অপরাধ করে। নারী পুরুষের পরস্পর আকর্ষণ চিরন্তন। একজন ছেলে বা মেয়ে অন্য একজন যৌনাবেদনময়ী ছেলে বা মেয়েকে দেখলে উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। ধর্ষণের জন্য অশ্লীল পোশাক ও ধর্ষকের মানসিকতা উভয়ই দায়ী। তাই সবাইকে শালীন পোশাক পরিধান করার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে। সকলেই যদি শালীন পোশাক পরিধান করে তবে উল্লেখযোগ্য হারে ধর্ষণের মতো এই ঘৃণ্য অপরাধ কমে যাবে। কিছুটা থাকবে কারণ পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকেই খারাপ মানুষের বসবাস আছে। তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির মাধ্যমে দমিয়ে রাখতে হবে। আমরা চাই না কোন মেয়ে ধর্ষণের শিকার হোক, মাথা নিচু করে চলুক, রাস্তায় আতংক নিয়ে চলুক। আমরা চাই সুষ্ঠু ধারার ভিত্তিতে নারী পুরুষের সহ অবস্থান। অবাধ মেলামেশার সুযোগে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে তাই এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সজাগ থাকতে হবে। শরীর জেগে উঠলেই ধর্ষণ হয় না, ধর্ষণ হয় যখন বিবেক মরে যায়। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ না করলে আগ্রাসনের সংস্কৃতি তৈরি হয়, তাই আসুন ধর্ষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলি, সচেতন হই, বিচার চাই।
লেখক : প্রাবন্ধিক