ধর্ষণের পাগলা ঘোড়া

294

যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে
সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে;
যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড়
পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।

বাংলা দ্বিতীয়পত্রের ভাব-সম্প্রসারণে রবীঠাকুরের দুই-উপমা কাব্যের এই অমেয় পঙ্কতিমালার মর্ম কৈশোরেই আমাদের অংকুরিত বিবেকের পত্রপল্লবে যে বোধটা খোদাই করতে চেয়েছিল, আজ যৌবনে এসে তার বাস্তবিক চিত্রটাই দৃশ্যমান যেন অক্ষিপটের সম্মুখে!
একটা জাতি কবে জীবন হারায়?
যখন হারিয়ে যায় তার স্বকীয়তা, তার নিজস্ব গতিশীলতা আর সংস্কৃতি। ফলশ্রুতিতে সহজাত সংস্কৃতি আর আদর্শচ্যুত প্রজন্মের রুধিতে সংক্রমণ ঘটে অবৈধ সংস্কার আর চেতনার, প্রতিটি বিবেকে গড়ে উঠে ঈপ্রিতের জলসাঘর, স্বার্থান্বেষী কালোধোঁয়ায় আচ্ছাদিত থাকে সমাজের নির্মল আকাশ, অস্বাভাবিক মৃত্যু ললাটে লিখে নিয়ে জন্মায় প্রতিটি শিশু, চারিদিকে রব উঠে – অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা কিংবা চিকিৎসা নয়, আগে আমাদের নিরাপত্তা চাই; জীবনের নিরাপত্তা, বিত্তের নিরাপত্তা, নারীর সম্ভ্রমের নিরাপত্তা!
দৃশ্যগুলো ঠাকুরমার ঝুলি থেকে উদ্ধৃত কোন প্রেক্ষাপট কিংবা অলীক চিন্তন নয়, আমাদেরই সমাজ, আমাদেরই আবহমান বাংলার আজকের বীভৎস রূপ! আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা কিংবা সামাজিক কাঠামোর ক্রোনিক অসাড়তারই ফল। ঠিক যেভাবে দেশে হঠাৎ করেই আশংকাজনকহারে বেড়ে গিয়েছে অনৈতিক সম্পর্কজনিত হত্যা আর ধর্ষণ! বাদ পড়ছেনা ছয় সাত বছরের বাচ্চা মেয়ে, এমনকি ছয়মাসের কোলের শিশুটিও!
বিভিন্ন জাতীয় সংবাদপত্র ও নারী অধিকার সংগঠনের প্রতিবেদনে জানা যায় ২০১৬ – ১৭ তে দেশে শিশুসহ নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে প্রায়ই ১০৫০ টি, আর ২০১৯ এ এসে গত ৬ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে হাজারের কাছাকাছি, এমনকি জুলাইয়ের প্রথম এক সপ্তাহেই ঘটেছে ৪১ শিশু ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য ঘটনা! সম্প্রতি জাতিসংঘের একটি রিপোর্টেও বলা হয়েছে – বাংলাদেশসহ ছয়টি এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশের পুরুষদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন ধর্ষক? ব্যাপারটি আমাদের পুরুষসমাজের জন্যে যেমনি বিব্রতকর তেমনি একজন বাবা, একজন ভাই, একজন সন্তান কিংবা একজন স্বামী হিসেবেও উদ্বেগজনক! আমাদেরই হাতে সভ্য সমাজটা হঠাৎ করেই অসভ্যদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়ে যাচ্ছে!
– কি হতে পারে এর কারণ?
ধর্ষণের জন্য বরাবরই রক্ষণশীল আলেম সমাজ দেন পোশাকের দোষ আর অতিশয় নারীবাদীরা দেয় পুরুষতন্ত্রের! অথচ ধর্ষণ কেবল একটি নির্দিষ্ট জৈব উপাত্তের ফল নয় বরং সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মনন ক্রমাগত লোপ পাওয়া, এককালীন আবহমান বাঙালির শৈশব-কৈশোরের চিরাচরিত বিনোদনের মাধ্যমসমূহ – দলবেঁধে মাছ ধরা, গাঁয়ের উঠোনে পাটখড়ি দিয়ে ঘর বানিয়ে বনভোজন, বঊ চিঁ,কানামাছি, কাবাডি, ঘুড়ি উড়ানো, যাত্রাপালা, নৌকা বাইচ, কবি গানের আসর ইত্যাদি সামাজিক নানা বিনোদন মাধ্যম বর্তমান প্রজন্ম হতে আশংকাজনকভাবে বিলুপ্তি, স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা, বাবা-মার অতি আহ্লাদী মনোভাব সন্তানকে সামাজিক হিসেবে গড়ে উঠার ব্যত্যয় ঘটানো, অসৎ সঙ্গ, নাটক-সিনেমায় (বিশেষত ওপার বাংলার মুভিতে) অবাধ খোলামেলা দৃশ্য ও কথোপকথন, বিভিন্ন আঞ্চলিক ক্যাবল অপারেটর এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন পেইজ কিংবা ওয়েবসাইটের অযাচিত অশ্লীল ও যৌন উত্তেজক দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যার সমষ্টিগত কারণই আজকের এই ধর্ষণ আর অবৈধ সম্পর্কজনিত হত্যার লাগামহীন রেকর্ড! আর এই লাগামহীন পাগলাঘোড়া প্রতিনিয়ত বোস্টাপ হচ্ছে ন্যায়বিচারের অভাব আর আইনব্যবস্থার গাফেলতির কারণে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে গত পাঁচ বছরে ৩ হাজার ৫৮৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে একই সময়ে ধর্ষণসংক্রান্ত মামলা হয়েছে ১৯ হাজারের বেশি; গড়ে প্রতিদিন ১১টি মামলা হচ্ছে। কিন্তু সেই তুলনায় ধর্ষণ মামলায় আসামিদের শাস্তির আওতায় আনার হার নিতান্তই কম। একটি জাতীয় পত্রিকার তথ্যমতে কেবল ঢাকা জেলার পাঁচটি নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে প্রায় ১৫ বছরে (২০০২-১৬) আসা ধর্ষণসংক্রান্ত পাঁচ হাজারের মতো মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মাত্র ৩ শতাংশের সাজা হয়েছে। আর এই নড়বড়ে হেলিত বিচার ব্যবস্থাই প্রভাবান্বিত করছে, আরো বেশি লাগামহীন করছে ধর্ষণের পাগলা ঘোড়াকে।
তবে আমি মনে করি এখনো সুযোগ আছে এই ঘোড়ার উপর সওয়ার হয়ে লাগাম টেনে ধরার,
শুধু পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রয়োগ করা জরুরি এই বিষয়গুলো –
১. হয় পাশ্চাত্য দেশগুলোর মতো অবাধ ও যত্রতত্র যৌনাচারকে অনুমোদন দিয়ে দিন, কেননা মনুষ্য সহজাত প্রবৃত্তিই এমন যে সহজলভ্য জিনিসের প্রতি ধীরেধীরে মোহ কেটে যায়, স্বেচ্ছায় যখন যৌনলিপ্সু পশুমন হাতের নাগালে সব পেয়ে যায় তবে ধর্ষণ করার চিন্তা করে কে?
২. অথবা ধর্মীয় অনুশাসন পরিপূর্ণভাবে চালু করুন, পর্দার বিধান বাধ্যতামূলকের
পাশাপাশি ধর্ষণের জন্য প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত ও রজম (পাথর নিক্ষেপে হত্যা) আইন প্রণোয়ন করুন। কেননা, সব চলবে পাশ্চাত্য নিয়মে আর আইন খোঁজবো আরবের আদালতে, এতটা মধ্যপন্থা অবলম্বন করে কোন দেশ ও জাতি চলতে পারেনা। ঠিক যে কারণে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অবস্থা আরও নাজুক হচ্ছে দিনকেদিন।
৩. নির্দিষ্ট বয়সের আগে কিশোর- কিশোরীদের স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট এক্সেস প্রদান বন্ধ করণ।
৪. স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট আসক্ত ঘরকুনো ছেলে মেয়েকে সামাজিক হতে উদ্বুদ্ধকরণ, সবার সাথে মেলামেশা ও আউটডোর খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্টকরণ।
৫. দেশীয় অশ্লীল কন্টেন্টে ভরা নাটক-সিনেমাসহ
কলকাতা মুভি, ভারতীয় মুভি ও সিরিয়াল ও বিদেশি স্যাটেলাইট চ্যানেল যেসবে ঘনিষ্ঠ দৃশ্য প্রতিনিয়ত টেলিকাস্ট হয় সেসব ব্যান করণ।
৬. ক্রাইম পেট্রোল নামক অপরাধপ্রবণতামূলক ভারতীয় রিয়্যালিটি শো বন্ধকরণ। কেননা এতে এতো নিঁখুত ক্রাইমের বর্ননা দেয়া হয়, যাতে অপরাধীরা আরও অনুপ্রেরণা ও প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে।
৭. যৌন উত্তেজক আইটেম সং বন্ধকরণ।
৮. ইউটিউব নিয়ন্ত্রণ।
৯. পর্ণ সাইট পরিপূর্ণভাবে বন্ধকরণ, যদিও তা ইতোমধ্যে কিছুটা বাস্তবায়িত হয়েছে যা আশাজনক।
১০। ফার্মেসী ও রাস্তাঘাটে যত্রতত্র, বেসরকারী কেবল অপারেটর এবং ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা বেপরোয়া ও অবাধ যৌন উত্তেজক ড্রাগসের বিজ্ঞাপন ও বিপণন করছে তা বন্ধ করে তাদের আইনের আওতায় আনা।
১১. ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে বাধ্যতামূলক ১৮-২২ বছরের মধ্যে বিয়ের প্রথা চালুকরণ, প্রয়োজনে সম্পূরক হিসেবে বেকারভাতা প্রদান।
১২. পর্দার বিধান ও ধর্ষণের শাস্তি সম্পর্কে আলেমসমাজ সহ প্রতিটি ধর্মের দাঈগণ ছেলে-মেয়ে উভয়কেই প্রতিনিয়ত ধর্মীয় উপাসনালয় সহ প্রতিটি মাহফিল,সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে আলোচনা করুন।
১৩. বিচার ও তদন্তবিভাগকে ত্বরান্বিতকরণ ও যেকোন ক্রাইমের দ্রæত বিচার নিশ্চিতকরণ।
১৪. বিভিন্ন ঘএঙ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং এলাকার শিক্ষিত সমাজের মাধ্যমে শিক্ষাঅধিকার বঞ্চিত পরিবারসমূহে পারিবারিক ও সামাজিক কাউন্সিলিং এবং নৈতিক ও মূল্যবোধের শিক্ষা প্রদান।
আসুন নিজের পরিবার, নিজের কৃষ্টি, নিজের প্রজন্ম, নিজের সমাজ তথাপি নিজের দেশকে এভাবে চোখের সামনে ধ্বংস হতে না দিই; অনাচার, ব্যভিচারের উন্মাদ লাগামহীন ঘোড়াটিকে বন্দী করি বদ্ধ আস্তাবলে। প্রতিটি বিবেক যদি নিজের নফস, নিজের মনের কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধেই আগে যুদ্ধ করি, তবে জীর্ণ লোকাচার নয় বিস্তীর্ণ সৌহার্দবোধ ও নয়নাভিরাম স¤প্রীতিতে ভরে উঠবে আমাদের এ সমাজ!

লেখক : সমাজকর্মী