ধর্মীয় অপব্যাখ্যা রোধে সরকারকে কঠোর হতে হবে

172

‘একটি দেশ, একটি জাতিকে এগিয়ে নিতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া জরুরি’। এ কথাটি নতুন নয়; বরং ইসলামের মহান প্রবর্তক মহানবী হজরত মুহাম্মদ (দ.) নিজে বলে গেছেন এবং স্বীয় জীবনে বাস্তবায়নও করেছেন। এরপর পারস্য বিজেতা নেপোলিয়ন বোনাপার্টও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর একটি সভ্য জাতি গঠনে নারী শিক্ষার বিষয়টি প্রধান কর্তব্য মনে করেছেন। আধুনিক যুগের সূচনাতেই সাধারণ মুসলমানদের যে মানস গঠন তাতে ধর্মান্ধতা ত্যাগ করে ধর্মভীরুতাকে গ্রহণ এবং নারী বিদ্বেষের স্থলে নারী শিক্ষা ও তাদের মর্যাদাপূর্ণ অধিকার সংরক্ষণের প্রতি মনোযোগ লক্ষ্য করা যায়। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রাপ্ত স্বাধীন সার্বভৌম এ বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রেও নারীদের অবদান পুরুষদের চেয়ে কম নয়। বিষয়টি সরকার অনুধাবন করতে পেরে দেশে নারী শিক্ষার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এ খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধিসহ প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে আসছে।
সরকারের গত ১০ বছরের নিরন্তর প্রচেষ্টায় বর্তমানে দেশে নারী শিক্ষার হার ৫০ দশমিক ৫৪ শতাংশের উপরে উন্নীত হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে একজন নারীও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থাকবে না। শিক্ষায় নারীর অগ্রযাত্রা সমাজ ও জাতিকে আলোকিত করবে এবং দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা রাখবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, নারী শিক্ষার এ বিশাল হারটির অধিকাংশই দখল করে আছে মুসলিম নারীরা। যারা দেশ জাতি ও সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে অবদান রাখছে বা রাখবে। এ পর্যায়ে এসে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ধর্মের নামে নারী শিক্ষা বিরোধী বক্তব্য রাখলে তা কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এমনকি ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষও তা গ্রহণ করবে না। বরং এ ধরনের বক্তব্যকে অধিকাংশ ইসলামি পন্ডিত ধর্মের অপব্যাখ্যা মনে করে থাকেন। সম্প্রতি স্কুল-কলেজে মেয়েদের না পড়াতে এবং পড়ালেও সর্বোচ্চ চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর ওয়াদা নিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের সূত্রে জানা যায়, গত শুক্রবার জুমা নামাজের পর চট্টগ্রামের আল জমিআতুল আহলিয়া দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিল ও দস্তারবন্দি সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন। এমনকি ১৫ হাজারের অধিক মুসলমানের কাছ থেকে তিনি এ বিষয়ে ওয়াদাও নিয়েছেন বলে বিভিন্ন অনলাইন প্রতিবেদনে ভিডিওসহ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়।
হেফাজতে ইসলামীর আমির মাওলানা শফি অবশ্যই এর আগেও নারী বিদ্বেষী বক্তব্যের জন্য ব্যাপক সমালোচিত হন। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। অবশ্যই শনিবার হেফাজতের আমিরের দপ্তর থেকে বিবৃতি দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত আল্লামা শফির বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেয়া হয়। তাতে তিনি গণমাধ্যমে প্রকাশিত তার কথিত বক্তব্যকে অস্বীকার করে দাবি করেছেন, গণমাধ্যমে তার বক্তব্য খন্ডিত আকারে প্রকাশিত হয়েছে। অতীতেও আমরা দেখেছি, আল্লামা শফি নারী বিদ্বেষী বক্তব্য দেয়ার পর দেশব্যাপী নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হলে বিবৃতি দিয়ে তা অস্বীকার করা হয়। ইসলাম আল্লাহর মনোনীত শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এটি সার্বজনীন ও প্রগতিশীল পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থাও। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (দ.) আরবে আবির্ভূত হওয়ার পর সমাজের অনাচার, নারী নির্যাতন, ব্যভিচার ও কুশিক্ষা দেখে ব্যথিত হন। ফলে তিনি প্রথম আত্মীয়তার বন্ধন ঘটালেন একজন আরবের অন্যতম শিক্ষিত, উদ্যোক্তা ও বিদ্যোৎসাহী মহীয়সীর সাথে। তাঁর দ্বিতীয় সম্পর্কটিও ছিল একজন শিক্ষিত নারীর সাথে যিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক ও লেখক ছিলেন।
মহানবীর প্রথম সন্তান নারী হজরত ফাতেমা (রা.) ইসলামী বিশ্বে নারী জগতের অহঙ্কার। নবীজি তাঁকেও যাবতীয় আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা দান করেছেন। এমনকি যে পিতা কন্যাদের সুন্দররূপে তারবিয়াত দেয় এবং পুত্রদের তাদের ওপর প্রাধান্য না দেয়, রাসূলে কারিম (দ.) তার জন্য জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। রাসূলে কারিম (দ.) সেদিন সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্তের অবতারণা করেছিলেন এবং নারী শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, যেদিন তিনি ক্রীতদাসীকে শিক্ষাদানের ব্যাপারে মুসলিম সমাজকে উৎসাহিত করেন। অথচ তাদের ব্যাপারে কেউ কোনো দিন চিন্তাও করত না।
দেশের মানুষ সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার যুগে আল্লামা শফির এ ধরনের বক্তব্যে অবশ্যই হতাশ হয়েছে। ধর্ম নিয়ে বারবার তার এসব বক্তব্যকে অনেকে ধর্মের অপব্যাখ্যা মনে করছেন। আমরা আশা করি, সরকার এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখবে। ধর্মীয় যেকোন বিষয়ে কেউ যেন অপব্যাখ্যা দিয়ে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে- এর প্রতি কঠোর মনোযোগী হতে হবে।