দ্রুত বিচারের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে

30

গত ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসায় সংঘটিত চাঞ্চল্যকর নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে গত ২৪ অক্টোবর বৃহস্পতিবার। ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশীদ এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাসহ ১৬ আসামিরই মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়া হয়েছে। মাত্র ছয়মাসের ব্যবধানে বিচার ট্রাইব্যুনালের ৬১ কার্যদিবসে এ রায় ঘোষণা হল। দেশের অনেকগুলো চাঞ্চল্যকর ঘটনার দ্রুত বিচারের ক্ষেত্রে এ রায়টি শুধু শেষে নয়; আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসিত হয়েছে। বিশ্বের নামকরা গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বের সাথে এ সংবাদটি পরিবেশন করেছে। এ রায়ে প্রমাণ করে যে, কর্তৃপক্ষ চাইলে যেকোন অপরাধের বিচার দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করা সম্ভব। এর ফলে বিচারপ্রার্থীর যেমন ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়, একইভাবে সমাজে অপরাধ প্রবণতাও হ্রাস পাবে।
স্মরণ করা যেতে পারে, সোনাগাজী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা তার মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী রাফিকে নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে যৌন হয়রানি করেছিলেন। এ ঘটনায় রাফির মা বাদী হয়ে এ বছরের ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে মামলা তুলে নিতে বিভিন্নভাবে রাফির পরিবারকে হুমকি দেয়া হয়। মামলা দায়েরের ৯ দিন পর রাফি আলিম পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে মাদ্রাসায় গেলে বোরকা পরিহিত কয়েকজন তাকে পাশের বহুতল ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ করে। রাফি এতে রাজি না হওয়ায় তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয় তারা। পুরো শরীর দগ্ধ হওয়া রাফি প্রায় একসপ্তাহ মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ঘটনায় রাফির বড় ভাই বাদী হয়ে ৪ এপ্রিল সোনাগাজী মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। অভিযুক্ত ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছিল। তাদের সবার বিরুদ্ধেই ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, রাফি হত্যাকান্ডের বিচার দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ হওয়ায় দেশবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। এ হত্যাকান্ড ছিল ব্যাপক আলোচিত একটি ঘটনা। ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত মাদ্রাসার এক অধ্যক্ষ তার ছাত্রীর শ্লীলতাহানি ঘটাতে পারে এবং জেলে বসে স্বয়ং অধ্যক্ষের পরিকল্পনায় সেই ছাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যা করা হতে পারে- এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না দেশবাসী। রাফির মৃত্যুর পরপরই দেশজুড়ে ঘৃণা-ক্ষোভ-প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং এ হত্যাকান্ডের দ্রুত বিচার দাবি করা হয় সমাজের সর্বমহল থেকেই। স্বস্তির বিষয় এই যে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে এ হত্যাকান্ডের রায় ঘোষিত হল। বিচারহীনতা কিংবা বিচারের দীর্ঘসূত্রতার যে সংস্কৃতি বিরাজ করছে দেশে, এই রায় তার এক বড় ব্যতিক্রম। তবে মনে রাখতে হবে, এ রায় বিচারিক আদালতের প্রথম ধাপ মাত্র। সঙ্গত কারণে দেশবাসী আশা করে এই রায় হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্টও দ্রæত পেরিয়ে যাবে এবং অনতিবিলম্বেই দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর হবে। এ দৃষ্টান্ত দেশবাসীসহ আন্তর্জাতিক মহলও দেখতে চায়। রাফি হত্যাকান্ড ও এর বিচার কতগুলো বিষয় স্পষ্ট করেছে। প্রথমত, রাফি তার অধ্যক্ষের যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে নিজেকে একজন প্রতিবাদী নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার এই প্রতিবাদী ভূমিকা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে নারী সমাজকে অনুপ্রাণিত করবে। এ কথাটি আদালত তাঁর রায়ের শুরুতে উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয়ত, রাফি হত্যাকে আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। গণমাধ্যম ও সচেতন মানুষের কল্যাণে সেই চেষ্টা সফল হয়নি। এটাও এক বড় শিক্ষা যে, সাধারণ মানুষ সচেতন হলে এবং গণমাধ্যম সত্যটি প্রকাশ করলে প্রভাবশালীরা যা খুশি তা করতে পারে না, পারে না সত্যকে মিথ্যা বানাতে। তৃতীয়ত, অতি দ্রুততার সঙ্গে রাফি হত্যার বিচার হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশে সংঘটিত অন্যান্য অপরাধ, বিশেষত চাঞ্চল্যকর হত্যাকাÐগুলোর বিচার প্রক্রিয়াও দ্রুত শেষ করার একটা তাগিদ তৈরি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বুয়েটের আবরার ও কুমিল্লার তনু হত্যাকান্ডের কথা বলা যায়। আমরা চাই, এই মামলারও বিচার প্রক্রিয়া দ্রুততম সময়ের মধ্যেই শেষ হোক। বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার সংস্কৃতির অবসান হোক- এটাই প্রত্যাশা।