দ্যা থার্ড বেল

166

মুঠোফোনের শব্দ কাঁপিয়ে দিচ্ছিল সাজঘর। সে দিকে অবশ্য খেয়াল নেই, রূপসজ্জায় ব্যস্ত নিবেদিতা। সবাই ভীষণ বিরক্ত। ‘নিবেদিতা, রিসিভ করো, না হয় সাইলেন্ট করো, মাথা ধরছে!’ নিবেদিতা দুঃখ প্রকাশ করে মুঠোফোনটা নীরব করতেই যাচ্ছিল। বাসা থেকে এতগুলো কল! শো এর ঘন্টা খানিক আগে থেকেই কারও কল রিসিভ করে না- মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। শো শেষ করেই কল ব্যাক করার কথা ভাবছিল, কিন্তু একটা বার্তায়… পাথর হয়েই গিয়েছিল। এর মধ্যে কার যেন কাজল দরকার পড়লো, ‘নিবেদিতা, কাজলটা একটু দে তো। নিবেদিতা!’ এই প্রাণ সঞ্চার হলো পাথরের প্রতিমায়।
মুঠোফোনটা বন্ধ করে ব্যাগের চেইন বন্ধ করেই ব্যাগখানা ছুড়ে ফেললো। এমন আচরণ সবারই বিরক্তি কুড়োচ্ছিল, ‘কি ধরনের অভদ্রতা এ! নতুন এসেই…।’ নিবেদিতা ঠোঁট বাকালো, ‘কাজল লাগবে দিদি? এই তো!’ সাজঘরের দরজাটা সজোরে আঘাত করে বেরিয়ে গেল, হঠাৎ এতটা শব্দাঘাত সহ্য করার প্রস্তুতি ছিল না কারও- হাত ফস্কে কারও কাজল লেপ্টে গেল। তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হলো, ‘অভদ্র মেয়ে একটা! ম্যানার জানে না! আজকে শো-টা শেষ হতে দাও শুধু।’
শো-এর আগে। সবাই সবার হাত ধরে জোরে জোরে দম নিচ্ছিল। নিবেদিতা সবাইকে অনুকরণ করছে। যেন তার কিছুই জানা নেই।
বেল পড়লো। দর্শক কানায় কানায় পূর্ণ। এবার নিবেদিতার এন্ট্রি। এই দৃশ্যে তাকে কাঁদতে হয়। সব সময় সে ভান করে। মানুষ অভিনয় করে কাঁদে কি করে? চোখে জল আসে কি করে? বিস্ময় লাগে নিবেদিতার। নিবেদিতা খানিক্ষণের জন্য দর্শকদের চোখের দিকে তাকিয়ে আটকে আছে। কি যেন করতে হবে- ও হ্যাঁ একটা সংলাপ আছে, সেটা বলে কাঁদতে হবে। সংলাপটাই মাথায় আসছে না। কথা ছিল নিবেদিতার কান্না শুনে অন্য চরিত্র প্রবেশ করবে। নিবেদিতা ভাবলেশ শুন্য দাঁড়িয়ে থাকায় অন্য চরিত্র সংকেত না মেনেই প্রবেশ করলো, ‘কিরে, কাঁদছিস কেন?’ হো হো করে হেসে উঠলো দর্শক সব। নিবেদিতা বললো, ‘মা আর নেই।’ এরপর… ঝড়ো হাওয়ায় দুলতে থাকা বৃক্ষ হঠাৎ ভেঙ্গে পড়লে যেমন স্তব্দতা তৈরি হয়, ঠিক তেমন কিছু ঘটলো। নতুন এক নিবেদিতাকে আবিস্কার করলো সবাই।
করতালিতে মুখরিত প্রেক্ষাগৃহ। সবাই নিবেদিতার অভিনয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কিন্তু সত্যিকারের অভিনয়টুকু কেউ ধরতে পারে নি।
নিবেদিতা মেকআপ তুলছে। চরিত্রের বেশভূষা ত্যাগ করেছে, অনেক আগেই; তবুও চরিত্র থেকে বের হতে পারে নি। কারও নজর এড়ালো না বিষয়টি, ‘নিবেদিতা, নাটক শেষ! এখন তো চরিত্র থেকে বের হয়ে আসতে পারো!’
নিবেদিতার এতক্ষণে হাসি পেল, ভাবলো, দর্শক কি বোকা! সত্যিকারের কান্না আর অভিনয়ের মধ্যে কোন তফাৎ করতে পারে না (?) দীর্ঘশ্বাসে ব্যাগের চেইনটা খুলে মুঠোফোন সচল করে। একের পর এক বার্তায় ভারী হয়ে গেছে মুঠোফোনটি। কত বার্তা! কতজন পাঠিয়েছে! কতভাবে! আজ নিবেদিতা নাটকের চরিত্রের সাথে একাত্ম হয়ে গেছে অবচেতনেই…………..