দ্বিখন্ডিত জম্মু-কাশ্মীর আর রাজ্য নয়

87

বদলে গেল ৬৯ বছরের ইতিহাস। জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিল মোদী সরকার। তুলে দেওয়া হল সংবিধানের ৩৭০ ধারা। ‘বিশেষ মর্যাদা’ হারাল জম্মু কাশ্মীর। উপত্যকায় রইল না আলাদা কোন সংবিধান, আলাদা পতাকা। সেই সঙ্গেই বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের বহু দিনের দাবি মেটাল নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্ব দ্বিতীয় এনডিএ সরকার। এর পাশাপশি জম্মু-কাশ্মীরকে ভেঙে জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ এই দু’টি আলাদা রাজ্যের প্রস্তাব সংসদে পেশ করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ফলে জম্মু-কাশ্মীর যে শুধু বিশেষ মর্যাদা খোয়াল তাই নয়, রাজ্যের স্বীকৃতিও হারনোর পথে। সন্ধ্যায় রাজ্যসভায় পাস হয়ে গিয়েছে এই প্রস্তাব। রাজ্য ভাগের প্রস্তাবের পক্ষে ১২৫টি ভোট পড়েছে। ৬১ জনের ভোট পড়েছে বিপক্ষে। খবর বার্তা সংস্থার
গত রবিবার পর্যন্ত যে জম্মু-কাশ্মীর ছিল ‘বিশেষ মর্যাদা’ প্রাপ্ত রাজ্য। গতকাল সোমবার থেকে সেটাই হয়ে গেল সাধারণ। পটভ‚মিটা অবশ্য তৈরি হচ্ছিল গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে। অমরনাথ যাত্রী এবং পর্যটকদের কাশ্মীর ছাড়ার নির্দেশ, সমান্তরাল ভাবে দফায় দফায় প্রচুর অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের জেরে নানা জল্পনা ভাসছিল উপত্যকায়। উত্তেজনা বাড়ে শনিবার রাতে মেহবুবা মুফতির বাড়িতে সর্বদল বৈঠকের পর। ওই বৈঠকের পরই কাশ্মীরের কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গৃহবন্দি করা হয় রাজ্যের দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা, মেহবুবা মুফতি-সহ অনেক নেতাকেই। তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল ১৪৪ ধারা জারি এবং ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধের ঘোষণা।
সেই উত্তেজনা চরমে উঠতে শুরু করে সোমবার সকাল থেকে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাসভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠক শেষে কেন্দ্রের তরফে জানানো হয়, বেলা ১১টায় রাজ্যসভায় বড় ঘোষণা করতে চলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তখনই বোঝা যায়, সমস্ত জল্পনার অবসান ঘটতে চলেছে। তার পর থেকেই গোটা দেশের নজর কেন্দ্রীভূত হয় রাজ্যসভায়।
অবশেষে রাজ্যসভায় ঘোষণা করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। রাষ্ট্রপতির সই করা নির্দেশনামা পড়ে শোনাতে শুরু করলেন। রাষ্ট্রপতির আদেশবলে জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার বিলোপ ঘটানো হল। প্রত্যাহার করা হল ওই ধারার অধীনেই ৩৫এ ধারাও। ফলে কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারা যে সব বিশেষ সুযোগ সুবিধা ভোগ করতেন, এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই সে সব বাতিল হয়ে গেল।
৩৭০ ধারারই একটি অংশ হাতিয়ার করে সংসদ এড়িয়ে এমন সংস্থান করল শাসক দল, যাতে পদ্ধতিগত ত্রæটির প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকল না বিরোধীদের কাছে। কিন্তু সংসদ এড়িয়ে কী ভাবে রাষ্ট্রপতির নির্দেশ? সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন পড়ল না কেনো?
১৯৫০ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় ৩৭০ ধারায় জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হলেও সেই মর্যাদা স্থায়ী ছিল না, বরং ছিল অস্থায়ী সংস্থান (টেম্পোরারি প্রভিশন)। কিন্তু এই ধারারই ৩ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ইচ্ছে করলে এই ‘বিশেষ মর্যাদা’ তুলে নিতে পারেন। রাষ্ট্রপতির ওই ক্ষমতাকে ব্যবহার করেই কাজ হাসিল করল মোদী সরকার। অর্থাৎ নির্দেশনামায় রাষ্ট্রপতি সই করার পরের মুহূর্ত থেকেই রদ হয়ে গেল ৩৭০ ধারা। এই ধারার অধীনেই ৩৫এ ধারায় ভারতীয় ভ‚খন্ডে থেকেও ভ‚স্বর্গের বাসিন্দারা যে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন, খারিজ হয়ে গেল সেটাও।
এর সঙ্গেই কেন্দ্রের প্রস্তাব, রাজ্যকে ভেঙে জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ এই দু’টি আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠন করা হোক। তবে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে না হলেও রাজ্য ভাগের সিদ্ধান্ত সংসদে পাশ করাতে হবে সরকার পক্ষকে।
কিন্তু এই ঘোষণার পরেই সংসদে তীব্র প্রতিবাদ করে বিরোধী দলগুলি। জম্মু-কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্স, পিডিপি ছাড়াও কংগ্রেস, আরজেডি, টিএমসি, ডিএমকে, সিপিএম সাংসদরা তীব্র প্রতিবাদ করেন। উল্লেখযোগ্য ভাবে সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ওয়াকআউট করে বিজেপির শরিক দল জেডিইউ। অন্যদিকে সিদ্ধান্তের পক্ষে ছিল বিজেডি, ওয়াইএসআরসিপি, শিব সেনা, টিআরএস, টিডিপির মতো দল। তার সঙ্গে বিরোধী শিবিরের মায়াবতীর বিএসপি এবং অরবিন্দ কেজরীবালের আপ সাংসদরাও এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন। ফলে ৩৭০-এর ধাক্কায় সংসদের সমীকরণও উল্টে-পাল্টে গিয়েছে।
সংসদের এই যুদ্ধ জারি রয়েছে বাইরেও। বহু দিন ধরেই বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের অবস্থান ছিল, অখন্ড ভারতে থেকে কাশ্মীরবাসী বিশেষ সুবিধা ভোগ করতে পারে না। এ বছর লোকসভা ভোটে বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহারেও ছিল ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। তাই উচ্ছ্বসিত শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি টুইট করেন, ‘একটা ঐতিহাসিক ভুল সংশোধন হল।’ উল্টো দিকে বিরোধী শিবিরের মেহবুবা মুফতি থেকে গুলাম নবি আজাদ কিংবা পি চিদম্বরম থেকে ডেরেক ওব্রায়েন অধিকাংশের বক্তব্যের সুর, গণতন্ত্রকে হত্যা করল সরকার। এই সিদ্ধান্ত অসাংবিধানিক।
থমথমে উপত্যকা, প্রাক্তন দুই মুখ্যমন্ত্রী গ্রেপ্তার
জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতিসহ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে রাজ্যের আর এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাকে। কাশ্মীরস পিপলস কনফারেন্সের দুই নেতা সাজ্জাদ লোন এবং ইমরান আনসারিকেও বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গত রবিবার মধ্যরাত থেকে গৃহবন্দি ছিলেন তারা।
শ্রীনগরের বাড়ি থেকে মেহবুবাকে সরিয়ে নিকটবর্তী সরকারি গেস্ট হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। সরকারি সিদ্ধান্তকে আদালতে চ্যালেঞ্জ জানাবেন বলে এ দিনই বিবৃতি দেন ওমর আবদুল্লা। তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা সোমবার রাত পর্যন্ত জানা যায়নি। এনিয়ে কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি কেন্দ্রীয় সরকার বা উপত্যকার প্রশাসনের তরফেও।
উপত্যকার জন্য সংরক্ষিত ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারা বিলোপের পক্ষে বহু দিন ধরেই সওয়াল করে আসছিল বিজেপি। এবছর তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারেও তার উল্লেখ ছিল। মে মাসে ক্ষমতায় আসার পরেই সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে উদ্যত হন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা, শুরু থেকেই যার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন উপত্যকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব। ‘আগুন নিয়ে খেলবেন না,’ বলে কেন্দ্রীয় সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন মেহবুবা নিজেও। তার মধ্যেই গত সপ্তাহে আচমকা অমরনাথ যাত্রা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সমস্ত তীর্থযাত্রী এবং পর্যটকদের নির্দেশ দেওয়া হয় কাশ্মীর ছেড়ে চলে যেতে।
এর পাশাপাশি, নিরাপত্তাও আঁটোসাঁটো করা হয় গোটা উপত্যকার। দফায় দফায় আধা সামরিক বাহিনী পাঠানো হয় সেখানে। তার জেরে শনিবার সর্বদলীয় বৈঠক করেন মেহবুবা-ওমররা। গত রবিবার রাতেই গৃহবন্দি করা হয় তাদের। এরপর সোমবার সকালে রাজ্যসভায় ৩৭০ ধারা বিলোপের কথা ঘোষণা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের সম্মতিপত্র নিয়েই সংসদে হাজির হয়েছিলেন তিনি। যা একেবারেই ভারতের গণতান্ত্রিক এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার পরিপন্থী বলে অভিযোগ তোলে কংগ্রেস, তৃণমূল-সহ বিরোধীরা। যদিও অমিত শাহ দাবি করেন, অস্থায়ী ৩৭০ ধারা বিলোপের ক্ষেত্রে কোনও অনিয়ম হয়নি। এতে উপত্যকাবাসীই উপকৃত হবেন।
কেন্দ্রের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিরোধীরা। তার মধ্যেই মেহবুবা মুফতি এবং ওমর আবদুল্লাকে গ্রেপ্তার করা হল। সেই সঙ্গে এ দিন উপত্যকায় আরও আট হাজার আধাসেনা পাঠানো হয়েছে। বন্ধ রয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা। বন্ধ রয়েছে স্কুল, কলেজ এবং অফিসও।
জম্মু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান বিনয় থুসু জানান, আগামী ৬ অগস্ট পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরের সমস্ত পরীক্ষা এবং ভর্তিও স্থগিত রাখা হচ্ছে।
জম্মু-কাশ্মীরের প্ল্যানিং কমিশনের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি রোহিত কানসল জানান, যথেষ্ট পরিমাণে খাবার এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী মজুত করে রাখা হয়েছে। তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের কাছেও। আগামী তিন মাস চাল, গম, মাংস, ডিম এবং জ্বালানির জন্য ভাবতে হবে না উপত্যকাবাসীকে।