দোষ করে উৎপাদক সাজা পায় বিক্রেতা

77

পণ্য উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারীদের ভুলের খেসারত দিচ্ছে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান সুপার শপগুলো। আইন অমান্য করে পলিথিন দিয়ে পণ্য প্যাকেটজাত করছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, অথচ ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা করা হচ্ছে সুপার শপগুলোকে। শুধু তা-ই নয়, যেসব পণ্যের ক্ষেত্রে বিএসটিআই’র লাইসেন্স বাধ্যতামূলক, সঠিক সময়ে তা হালনাগাদ করাও উৎপাদকের দায়িত্ব। কিন্তু তা না করায় বেশিরভাগ সময়ই এই জরিমানা গুনতে হয় সুপার শপগুলোকেই।
এ প্রসঙ্গে বিএসটিআই’র পরিচালক (সিএম) সাজ্জাদুল বারি বলেন, ‘যেসব পণ্যের ক্ষেত্রে বিএসটিআই’র লাইসেন্স নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেসব পণ্য লাইসেন্স ছাড়া বাজারজাত করলে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে আমরা সিলগালা করে দেই এবং প্রতিষ্ঠানের মালিককে আর্থিক দন্ড ও জেল-জরিমানা করা হয়। তবে বিএসটিআই’র লাইসেন্স নেই এমন প্রতিষ্ঠানের পণ্য যারা বিক্রি করেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত ইচ্ছে করলে তাদেরও শাস্তি দিতে পারেন’।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুপার শপগুলোর পাশাপাশি উৎপাদক প্রতিষ্ঠানেও নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা হওয়া জরুরি। কারণ, উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ভুলের খেসারত দিতে গিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়া ছাড়া সুপার শপগুলোর সুনামও নষ্ট হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে মীনা বাজারের লিগ্যাল ম্যানেজার মো. রাজীব আলম বলেন, ‘আইনের সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানির কারখানা বা উৎপাদন পর্যায়ে বা মোড়কজাতকরণ স্থানে যথাযথভাবে পরিচালিত হলে সুপার শপগুলোকে অহেতুক জরিমানা গুনতে হবে না’। তিনি মনে করেন, বিক্রয়স্থলের পাশাপাশি উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান নিয়মিত পরিচালনা করা হলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই আইন মেনে চলতে বাধ্য হবে।
এছাড়াও পণ্য উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর মনিটরিং জোরদার করার পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার অনুরোধও জানিয়েছেন সুপার শপগুলোর মালিকরা। শপগুলোর পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে সরকারের কয়েকটি দফতরে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
পাট অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কারখানা বা মোড়কজাতকরণ স্থানে পরিচালিত হলে পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০-এর প্রকৃত লক্ষ্য অর্জন এবং এর বাস্তবসম্মত বাস্তবায়ন দৃশ্যমান হবে। এতে আরও বলা হয়েছে, যেসব কোম্পানির পণ্যে পাটজাত মোড়ক ব্যবহার করা হয়নি, সেসব কোম্পানিকে বারবার এ বিষয়ে অবগত করার পরও সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো এখন পর্যন্ত কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, সুনির্দিষ্ট পণ্যগুলো সংশ্লিষ্ট কোম্পানি কর্তৃক উৎপাদিত, মোড়কজাত ও সরবরাহ করা হয়ে থাকে এবং তারাই পাটজাত মোড়কের পরিবর্তে কৃত্রিম মোড়ক ব্যবহার করছেন। পাটজাত মোড়ক ছাড়া সুনির্দিষ্ট পণ্য বিক্রয়ে সুপার শপগুলো আগ্রহ না দেখালেও পাইকারি ও খুচরা বাজারে সেসব পণ্য ক্রয়-বিক্রয় অব্যাহত রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আগোরা সুপার শপের কর্মকর্তা সবুর খান বলেন, ‘যদি উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা আইন মেনে পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করে, তাহলেই সুপার শপগুলোকে জরিমানা গুনতে হয় না’।তিনি বলেন, ‘নির্দিষ্ট কয়েকটি পণ্যে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক হওয়ার পরও উৎপাদকরা পাটের ব্যাগ ব্যবহার করছেন না’।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করে পাট অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পণ্য বিক্রয়কারী ছাড়াও আমদানিকারক, মোড়কজাতকারী ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকেও ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০’ যথাযথভাবে মানার জন্য বলা হয়েছে’। তিনি বলেন, ‘এই আইন শতভাগ বাস্তবায়নের জন্য আমরা উৎপাদক, আমদানিকারক, মোড়কজাতকারী ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকা সংগ্রহ করছি। সারা দেশের জেলা-উপজেলা অফিসকে সেভাবে নির্দেশনা দেওয়া আছে’।
এদিকে পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০ বাস্তবায়নের জন্য দেশের জেলা ও উপজেলা অফিসগুলোর উদ্দেশ্যে একটি আদেশ জারি করেছেন পাট অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. শামছুল আলম। এতে প্রতি মাসে এর বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করার জন্য নির্ধারিত ১৯ পণ্যের উৎপাদক, আমদানিকারক ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকা হালনাগাদ করে পাট অধিদফতরে নিয়মিত মাসিক প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, প্রতি মাসের ২ তারিখের মধ্যে (ধান, চাল, গম, ভুট্টা, চিনি, মরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডাল, ধনিয়া, আলু, আটা, ময়দা, তুষ-খুদ-কুঁড়া, সার, পোলট্রি ফিড ও ফিশফিড) উৎপাদক, আমদানিকারক ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকা হালনাগাদ করে পাঠাতে হবে।
সূত্র বলছে, সুনির্দিষ্ট কয়েকটি পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক হলেও বেশ কিছু উৎপাদক প্রতিষ্ঠান এ সংক্রান্ত আইন মানছে না। সুপার শপগুলোর পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানকে যথাযথভাবে আইন মানার জন্য বলা হলেও তারা পাটের পরিবর্তে অবৈধ পলিথিন দিয়েই পণ্য প্যাকেটজাত করছে। আর ভ্রাম্যমাণ আদালত এসে জরিমানা করছেন সুপার শপগুলোকে।
দেখা গেছে, একটি উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই’র নির্ধারিত মান বা পণ্যের পরিচিতি সংক্রান্ত সংখ্যা যথাযথভাবে ব্যবহার করেনি। অথচ এর জন্যও জরিমানা গুনতে হয়েছে রাজধানীর একটি সুপার শপকে। যদিও আবার মোড়কজাত (লেবেলিং) করার সময় মোড়কজাত আইন অমান্য করে বাংলা ভাষাকে অবহেলা করেছে একটি উৎপাদক প্রতিষ্ঠান। এর দায়ে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার এক সুপার শপকে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
উল্লেখ্য, ওজন ও পরিমাপ মানদন্ড আইনে পণ্য মোড়কজাত সম্পর্কে কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, যদি পণ্যসামগ্রী মোড়কজাতকরণের নিবন্ধন সনদপত্র না থাকে এবং মোড়কের উপরিভাগের প্যানেলে বাংলা ভাষায় (বাংলা ভাষার অক্ষরের আকৃতিকে অধিক প্রাধান্য দিয়ে) আইনে বর্ণিত অন্যান্য তথ্যসহ সব ঘোষণা বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে সংযোজিত না থাকে, তাহলে কোনো ব্যক্তি কোনো মোড়কজাত পণ্য তৈরি, উৎপাদন বা বিক্রয় করতে পারবেন না বা মোড়কজাত বা বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারবেন না।
নিয়ম অনুযায়ী, উৎপাদক প্রতিষ্ঠান পণ্য তৈরির সময়ই পণ্যের পরিচিতি (বিএসটিআই’র নির্ধারিত মান) লেবেলিং করবে। কিন্তু বিএসটিআই’র নির্ধারিত মান লেখার বা কাগজে বসানোর সময় প্রায়ই ভুল করেন তারা। যদিও নিরাপদ খাদ্য আইনে বলা আছ, ‘প্যাকেটকৃত কোনো খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণের মোড়কে লিপিবদ্ধ তথ্যাবলি পরিবর্তন করে বা মুছে কোনো খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ বিক্রয় করতে পারবেন না’। তবে মোড়কজাতকরণের এ প্রক্রিয়া সম্পর্কে উৎপাদকের কোনো মাথাব্যথাই নেই বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রসঙ্গত, ব্যস্ত নগর জীবনে এখন পণ্য কেনাকাটার জন্য মানুষের পছন্দের জায়গা সুপার শপ। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এসব শপে একবারে অনেকরকম পণ্য পাওয়া যায়। একই ছাদের নিচে কাঁচাবাজার, মুদিপণ্য, প্রসাধন, মুখরোচক খাবার, মাছ, মাংস, কাঁচা ও শুকনো ফল, শিশুদের খাবার ও প্রসাধনী, এমনকি হাঁড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর সব উপকরণই পাওয়া যায়। সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষীর পাশাপাশি প্রত্যেকটি সুপার শপে সিসিটিভি ক্যামেরাসহ এয়ারকন্ডিশনের ব্যবস্থাও রয়েছে।
২০০১ সালে ধানমন্ডিতে আগোরা’র একটি স্টোরের মধ্য দিয়ে দেশে পথচলা শুরু করে রিটেইল চেইন ইন্ডাস্ট্রি। শুরুর দিকে এগুলো উচ্চবিত্তের কেনাকাটার স্থান হিসেবে বিবেচিত হতো। তবে এখন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোও নৈমিত্তিক কেনাকাটা ও বাজারের জন্য ভিড় করছে আগোরা, মীনা বাজার, স্বপ্ন’র মতো সুপার শপগুলোতে।