দোলাচলে বিএনপি

37

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে বিএনপি জোট অংশগ্রহণ না করে আওয়ামীলীগ তথা চৌদ্দদলকে একচ্ছত্র সুযোগ করে দেয়। তাতে সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামীলীগ। বস্তুতঃ বিএনপি জোট নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পর থেকে দলের স্বাভাবিক কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসে। তাছাড়া আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও কর্মকান্ডের কারণে মামলা ও হয়রানির শিকার হয়ে বেশির ভাগ নেতা আত্মগোপনে। অনেকেই কারাবরণ করতে বাধ্য হন। সারাদেশ ব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধরপাকড়ের কারণে কর্মী সমর্থকেরা ভিত হয়ে পড়ে। নিজেকে নিরাপদ রাখার চেষ্টায় অধিকাংশ নেতা কর্মী দল থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকে। সেই থেকে মূলতঃ সিনিয়র নেতৃবৃন্দের ঢাকামুখী অবস্থান গড়ে ওঠে। সংগতকারণে এলাকার কর্মী সমর্থকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অতঃপর দল কেন্দ্রীয় অফিস থেকে মাঝেমাঝে বিবৃতি এবং সাংবাদিক সম্মেলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
তৎকালীন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বিএনপি এবং আওয়ামীলীগ পাশাপাশি অবস্থান নিয়ে গণতন্ত্র মুক্তি আন্দোলন বেগবান করে। সেই কথা কারও অজানা নয়। পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তিন-তিন বার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে বিএনপি তথা বিশ দলীয় জোট। সরকারে হোক বা বিরোধী দলে হোক, বিএনপির অবস্থান ছিল অটুট। যেকোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের বিপরীতে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। সেক্ষেত্রে বিএনপি এবং আওয়ামীলীগ একে অন্যের পরিপূরক। এই দেশের গণমানুষের চাওয়া পাওয়া এবং উন্নয়নের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিএনপি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে তৎপর ছিল। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বর্তমানে কারাগারে আছেন। অভিভাবকহীন বিএনপি দলের করনীয় ঠিক করতে না পেরে অর্থাৎ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে ব্যর্থ হওয়ায় দল ক্রমশঃ ঝিমিয়ে পড়ে। একপর্যায়ে বিএনপি সব কর্মকান্ড স্থগিত করে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে তৎপর হয়ে ওঠে এবং আইনি লড়াইয়ে সামিল হয়। তাতে ষোল মাসের অধিক সময় গড়িয়ে যায়। বিজ্ঞ আইনজীবীরা ক্ষীণ আশা নিয়ে পথ চলে। প্রতিবেশী আনু মিয়া বলেছেন, জেল-জুলুম নেতা-নেত্রীদের জন্য। বঙ্গবন্ধুও বছরের পর বছর জেল খেটেছেন। মর্ফিজ কাকা এই কথা মানতে নারাজ। বঙ্গবন্ধু রাজবন্দী ছিলেন। বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। আইনি লড়াই কবে শেষ হবে, কখন খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে, তাই নিয়ে জনগণের একাংশ খুবই উদ্বিগ্ন। তাছাড়া উক্ত বিষয়ে বেগম খালেদা জিয়া নিজেই সিনিয়র নেতাদের উপর ক্ষুব্ধ। সেজন্য সিনিয়র নেতাদের সাক্ষাত দেওয়ার ব্যাপারে তিনি অনীহা প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয়জন একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার রূপকার হিসেবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে লন্ডনে নির্বাসনে দিন কাটাচ্ছেন। পরবর্তী নেতৃত্বে সিনিয়রদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে কর্মী-সমর্থক তথা দেশের মানুষকে আন্দোলিত করতে ব্যর্থ হয়। আন্দোলন সংগ্রামের পূর্বশর্ত হচ্ছে নেতা নিজেকে সামনের সারিতে সক্রিয় রাখা এবং সফলতা-ব্যর্থতা কার্যক্ষেত্রে প্রমাণ করা। বিএনপি থেকে একাদ্বশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদদের সংসদে যোগদান প্রসঙ্গে গায়েবী সিদ্বান্ত মহাসচিব জনাব ফকরুল ইসলাম আলমগীর মেনে নিলেও জ্যেষ্ঠ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহম্মদ মানতে পারেননি। জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তার প্রমাণ মিলে। ইতোমধ্যে ছাত্রদলের কাউন্সিলকে ঘিরে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিগত কয়েকদিন তা চলতে থাকে। যা সামাল দেওয়া নেতাদের জন্য কষ্ট হয়ে পড়ে। ০৩ জুন বিএনপি এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ছাত্রদলের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বিলুপ্ত করে কাউন্সিলে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে ২০০০ সাল পরবর্তী এসএসসি উত্তীর্ণ হওয়ার শর্ত আরোপ করে এবং তাতে ঘটে বিপত্তি । ছাত্রদল নেতাদের একাংশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং বিএনপি কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। অঙ্গসংগঠন ছাত্রদলের পক্ষ থেকে উক্তরূপ আচরণ কার্যতঃ এক অশনিসংকেত।
সম্প্রতি বিএনপি নেত্রী ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার নাম গণমাধ্যমে এবং সংবাদ মাধ্যমে বেশি করে প্রচারিত হতে থাকে। আসলে তিনি একজন ভাগ্যবতী মহিলা। সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দুই নেত্রীকে পিছনে ফেলে নিজেকে যোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিএনপির মনোনীত সাংসদ হিসেবে অতি সম্প্রতি তিনি স্পীকারের কাছে শপথ বাক্য পাঠ করেন। সংসদে তেজোদ্দিপ্ত বক্তব্য রেখে সবার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছেন। আমার ধারণা, তাঁহার সাবলীল বক্তব্যে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে, তবে তা দলীয় চিন্তাবোধে যেন না হয়। তাঁহার একটি কথা জনগণকে বিভ্রান্ত করেছেন নিঃসন্দেহে। প্রথমদিনে বক্তব্যের শুরুতে তিনি একাদ্বশ সংসদকে অনির্বাচিত এবং অবৈধ সংসদ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। অথচ তিনি সেই মহান সংসদে বিধানসম্মতভাবে একজন সাংসদ এবং বিএনপির পতাকাবাহী মনোনীত একজন প্রতিনিধি। নিজেকে বৈধ দাবী করে অবৈধ সংসদে বক্তব্য দেওয়া জাতির কাছে হয়েছে হাস্যকর এবং তা গুরুত্বহীন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। একজন যোগ্য নেত্রীর কাছ থেকে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বক্তব্য শুনতে জনগণ প্রত্যাশা করে। অনেকের মতে, সংসদে প্রথমবার এসেছেন মর্মে তিনি অন্য সাংসদদের একটু বাজিয়ে নিচ্ছেন।
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাসহ বিএনপির ছয়জন সংসদ সদস্যের সাথে যদি বিএনপি মহাসচিব য্গোদান করতেন, তাহলে সংসদের দৃশ্যপট পাল্টে যেত। তিনি যখন সংসদে দাঁড়িয়ে কথা বলতেন, তখন সরকারি দল থেকে শুরু করে সবাই এক বাক্যে তাঁহার বক্তব্য শোনার জন্য আগ্রহী হতেন। প্রকারান্তরে দেশ উপকৃত হত এবং সরকারের অনিচ্ছাকৃত ভুলসমূহ শোধরানো যেত। দূর্ভাগ্য, তিনি অজানা রহস্যের বেড়াজাল ভেদ করে সাংসদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেননি। তিনি নিজ এলাকা থেকে নির্বাচিত হননি। বগুড়া-৬ আসন থেকে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁহার শুন্য আসনে উপ নির্বাচন করে জনাব জিএম সিরাজ বিএনপির টিকেটে বিজয়ী হয়েছেন। এক্ষেত্রে কারও কৃতিত্ব গুরুত্ব পায়নি। বেগম খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তাই একমাত্র সবকিছুর দাবিদার। জনাব হারুন অর রশিদ, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাসহ অন্যান্য বিএনপি সাংসদকে সংসদে যোগদানের জন্য সাধুবাদ জানাই। দেশের মানুষের পক্ষে এবং দেশকে নিয়ে সংসদে প্রাণবন্ত আলাপের প্রত্যাশা করি।
ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেন বলেছেন, গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য আন্দোলন করতে হবে। নাগরিক ঐক্যের আহব্বায়ক জনাব মাহমুদুর রহমান মান্না প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আক্ষেপ করে বলেছেন- রাস্তায় নামতে হবে, তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে এই সরকারের পতন ঘটাতে হবে। বিশদলীয় জোটের অন্যতম শরিকদল এলডিপি প্রধান সম্প্রতি জাতীয় মুক্তিমঞ্চের ডাক দিয়েছেন। তাঁহার ভাষ্যমতে, ১৯৭১ সালের জামাত এবং ২০১৯ সালের জামাত এক নয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহম্মদের অভিমত, আইনি লড়াই করে বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে আনতে হবে। ইতোমধ্যে জনাব ফখরুল ইসলাম আলমগীর আন্দোলনের জন্য প্যাকেজ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। যা পরবর্তীতে যথারীতি কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। সম্প্রতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকির দল ঐক্যফ্রন্টকে বাই বাই জানিয়েছেন। সারসংক্ষেপ ঐক্যফ্রন্ট বলেন এবং বিশদলীয় জোট বলেন, সবকটি বিএনপিনির্ভর দল। পর্যবেক্ষকদের মতে, বর্তমানে আন্দোলনে বিএনপির সক্ষমতা কতটুকু, তা খতিয়ে দেখা দরকার। উল্লেখ্য, বিএনপির কিছু নেতা শুধুমাত্র ক্ষমতা কেন্দ্রিক রাজনীতি করেন। আন্দোলনের কথা শুনলে বিভিন্ন অযুহাত দেখিয়ে সময় পার করে দেন। শুধু তাই নয়, গত নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যের দৌড়ে দলের অনেক ত্যাগী নেতা বাদ পড়েছেন। তাঁহারাও দল থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন। কোনো অবস্থাতেই ২০১৩-১৪ সালের পুনরাবৃত্তি যেন না হয়। বিএনপিকে অবশ্যই কৌশলী হতে হবে। তাছাড়া সরকার মাঠে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে বলা যায়।
বর্তমান পেক্ষাপটে নেতৃত্বশুন্য বিএনপির অভ্যন্তরে নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। নেতা-কর্মীদের উপর বিশেষ করে ছাত্রদলের একাংশের উপর শীর্ষ নেতৃবৃন্দের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। বেগম জিয়ার অনুপস্থিতি বিএনপিকে এক চরম সংকটের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। চেয়ারপারসনের কারাবন্দী সময়ে অর্থাৎ ষোল মাসের মধ্যে দলের পক্ষ থেকে কার্যতঃ একটি কর্মসূচিও পালন করতে পারেনি। দলের নেতা-কর্মীদের চাঙা রাখতে হলে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি অপরিহার্য। আগত সপ্তম জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে বেগম জিয়ার অনুপস্থিতি নেতা-কর্মীদের মাঝে এক বেদনাদায়ক দৃশ্যের অবতারনা করবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক