দেয়াঙ পাহাড় ঘিরে চট্টগ্রামের ‘প্রাচীন ইতিহাসের’ সন্ধান মিলেছে : জামাল উদ্দিন

275

পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বন্দর-শহর চট্টগ্রাম। সভ্যতার আলোকে শহর হিসেবে চট্টগ্রাম কতটা প্রাচীন তা এখনও স্পষ্ট হয়। তবে চট্টগ্রামের ইতিহাস যে দশ হাজার বছরেরও পুরোনো হতে পারে তার প্রমাণ পাওয়া যায় মহানগর থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে সীতাকুন্ড পর্বতে পাওয়া ‘কৃপাণ’ থেকে। প্রাচীনকাল থেকে এই নগরীর বিভিন্ন সভ্যতা ও শাসকদের কাছে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৃহত্তর চট্টগ্রামজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানা সভ্যতার ঐতিহাসিক নিদর্শন। প্রাচীন চট্টগ্রামে জনবসতি শুরুর পর থেকে আধুনিক সভ্যতার ইতিহাস পর্যন্ত এ অঞ্চলকে শাসন করেছে বিভিন্ন রাজবংশ। রাজত্বকালে তারা চট্টগ্রামের বিভিন্নস্থানে গড়ে তুলেছিল বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান। কালের আবর্তে ইতিহাসের পাতা থেকে সেসব নির্দশন হারিয়ে গেছে কিংবা অনেককিছুর খোঁজও আজ পর্যন্ত মিলেনি। সে ধরনেরই একটি প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন ‘চট্টগ্রাম পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়।’ প্রাচীন বৌদ্ধ রাজবংশের শাসনকালে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার দেয়াঙ পাহাড়কে কেন্দ্র করেই এক সময় গড়ে উঠেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়টি।
ঐতিহাসিক এই নিদর্শনটির সন্ধানে কাজ করেছেন লেখক ও গবেষক জামাল উদ্দিন। তিনি দীর্ঘ দশ বছর যাবত পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে গবেষণা চালিয়ে সমস্ত তথ্য জোগাড় করে তা নিয়েই লিখেছেন ‘চট্টগ্রাম পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় ও বৌদ্ধ সভ্যতা’ গ্রন্থ। এবার অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে বইটি স্বনামধন্য বলাকা প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
দীর্ঘ চার দশক ধরে লেখালেখি ও গবেষণায় যুক্ত জামাল উদ্দিনের লেখা-সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৬টি। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের ইতিহাসসহ তার লেখা গবেষণামূলক গ্রন্থগুলো বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। জামাল উদ্দিন চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং একুশে বইমেলা কমিটির যুগ্ম-সদস্য সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
‘চট্টগ্রাম পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় ও বৌদ্ধ সভ্যতা’ গ্রন্থ সম্পর্কে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, ২০১০ সালের দিকে একবার ভারত ভ্রমণকালে কলকাতায় প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ত্রিতানন্দ দাসের সাথে দেখা হয়, তার জন্মস্থানও আনোয়ারায়। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কিছু জানি কি-না। আমি না বোধক জবাব দেওয়ার পর তিনি আমাকে আনোয়ারার দেয়াঙ পাহাড় ঘিরে থাকা বৌদ্ধ সভ্যতার ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেন। তিনি বলেন, ‘জিওরি দ্য গ্রেট’ নামে একজন ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ১৯৬০ সালে একটি বই লিখেছেন, সেখানে পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কিছু তথ্য রয়েছে। তখনই আমি মনে মনে ঠিক করি যে এ নিয়ে গবেষণা করবো। আমরা দুইজন মিলে কলকাতার বিভিন্ন লাইব্রেরিতে বইটি খোঁজ করেছি কিন্তু পাইনি। পরে লন্ডনে সেই বইটির সন্ধান পাই। মজার বিষয় হলো আমার নিজের জন্মস্থানই হলো সেই দেয়াঙ পাহাড়ের কাছাকাছি। এই পাহাড়ের আশপাশেই আমরা শৈশবে খেলাধুলা করেছি, পাহাড় ঘিরেই আমার নিজেরও শৈশবের অনেক স্মৃতি রয়েছে। তাই তার কাছে এমন একটি তথ্য পেয়ে গবেষণা শুরু করি। একে একে এ সম্পর্কিত তথ্যগুলো জোগাড় করতে থাকি। তারপর দীর্ঘ গবেষণায় আমি নিশ্চিত হই, দেয়াঙ পাহাড়েই ছিল প্রাচীন চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন ‘চট্টগ্রাম পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়’। সেই গবেষণালব্দ তথ্যের ফসল আজকের এ গ্রন্থটি। বইটি থেকে পাঠকরা চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন।
জামাল উদ্দিন বলেন, বাংলা সাহিত্যের অনেক পুরোনো ইতিহাস আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল, অনেক নিদর্শন সম্পর্কে আমরা জানতামও না। এ ধরনের গবেষণায় আমরা আমাদের অতীত সম্পর্কে জানতে পারছি, নতুন প্রজন্ম এসব জেনে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে, ইতিহাসে সমৃদ্ধ হবে। পন্ডিতেরা বলেন, যে জাতির অতীত যত দীর্ঘ এবং স্বচ্ছ সে জাতি তত বেশি সভ্য। একটা জাতির বা জনগোষ্ঠীর যদি অতীত কৃষ্টি, ঐতিহ্য, জীবন-জীবিকার সংগ্রাম-সংস্কৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকে তাহলে সে জাতি বা জনগোষ্ঠীর ওপর সভ্যতা অতিক্রম করা সম্ভব নয়। সে কারণে গবেষণা করে আমাদের অতীত সম্পর্কে জানতে হবে এবং তা জাগিয়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, আমি আশা করছি, দেয়াঙ পাহাড়েই সরকার আবারও প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন ‘চট্টগ্রাম পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়’ নতুন করে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেবে।
অমর একুশে বইমেলায় বলাকা প্রকাশনের স্টলে বইটি পাওয়া যাবে।