দেশে যেভাবে মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে করোনা

32

দেশে করোনায় এখন পর্যন্ত মারা গেছে ৩৭০ জন। আর সারাবিশ্বে সোমবার পর্যন্ত এ সংখ্যা তিন লাখ ১৬ হাজার ২৭৭। যুক্তরাজ্যের চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে বিবিসি একটি প্রতিবেদনে বলেছে, করোনা আক্রান্ত ৩০ শতাংশ রোগীর মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা দেখা গেছে। চিকিৎসকদের আশঙ্কা, রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা অধিক হারে মৃত্যুর একটি কারণ হতে পারে। যুক্তরাজ্যের চিকিৎসকদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন দেশের বিশেষজ্ঞরাও। তাদের মতে, রক্ত জমাট বাঁধার কারণে করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে।
বিবিসির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্চ মাসে অধিক হারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ করে চিকিৎসকরা পর্যালোচনা করে দেখেছেন, তাদের মধ্যে উচ্চহারে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা আছে। যা অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। এছাড়া শতাধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রক্ত জট শ্বাসতন্ত্রের আশেপাশেও দেখেছেন তারা। পাশাপাশি করোনাভাইরাস পায়ের গভীর রক্তনালির রক্তজট তৈরি করেছে যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় থ্রম্বোসিস বলা হয়। এটি অনেক ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রতিবেদনে লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালের থ্রম্বোসিস বিভাগের প্রফেসর রুপেন আর্জ্যের বরাত
দিয়ে বলা হয়, বিগত কয়েক সপ্তাহের ব্যাপক তথ্য বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, থ্রম্বোসিস একটি বড় সমস্যা। তার মতে, ইউরোপে প্রকাশিত তথ্যে যে ৩০ শতাংশের কথা বলা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি বাস্তবে হতে পারে। প্রফেসর আর্জ্যের মতে, রক্ত জমাট বাঁধার কারণে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়।
থ্রম্বোসিস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বেভারলি হান্টের মতে, পুরু রক্ত স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ। এই কারণে করোনায় মৃত্যুর হারও বেশি। দেশের বিশেষজ্ঞরা এর সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেছেন, সাধারণ নিউমোনিয়া আক্রান্তদের রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা নেই। করোনার বিশেষত্ব এখানেই।
ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাসকুলার সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও অ্যাসোসিয়েট কনসালটেন্ট ডা. সাকলায়েন রাসেল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যারা করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন তারা মূলত তিনটি কারণে মারা যাচ্ছেন। নিউমোনিয়া, রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার কারণে স্ট্রোক হচ্ছে, কিডনি বিকল হচ্ছে, অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হচ্ছে। তিন নম্বর কারণ, এটি হার্টের প্রদাহ সৃষ্টি করে হার্টফেল করছে। এখন পর্যন্ত এই তিনটি কারণ পাওয়া গেছে। এই কারণগুলো ঠেকানোর জন্য এখনকার গাইডলাইন অনুযায়ী অতো ভেন্টিলেটরের দিকে যাওয়া যাবে না। কারণ ভেন্টিলেটর দেওয়ার পরে দেখা গেছে, খুব কম সংখ্যক রোগী সুস্থ হয়েছে। ভেন্টিলেটর যে বাঁচিয়ে দিচ্ছে, তা নয়। সেই কারণে একদিকে যেমন ফুসফুসের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে বলেছে, এর সঙ্গে রক্ত যাতে জমাট না বাঁধে সেটার জন্যও একটি ইনজেকশন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে গাইডলাইনে। এছাড়া অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে যে ব্যবস্থাপনা সেটি রোগীকে দিতে বলা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া এখন বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত।’
তিনি আরও বলেন, ‘রক্তনালির মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধার যে প্রবণতা সেটা করোনা আক্রান্ত রোগীর মধ্যে আছে। যারা সাধারণত ধূমপায়ী, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ, কিডনির সমস্যা যাদের আছে তাদের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা আরও বেড়ে যাচ্ছে। সাধারণ নিউমোনিয়া আক্রান্তদের রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা নেই, করোনার বিশেষত্ব এই জায়গাতেই। শরীরের যেখানে চিকন রক্তনালি আছে সেইসব জায়গায় জমাট বাঁধে, শুধু ফুসফুসেই না।’
বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. আজিজুর রহমান বলেন, ‘করোনাভাইরাসের রক্ত জমাট বাঁধানোর একটা প্রবণতা আছে। রক্ত জমাট বাঁধা শুরু করলে প্রথমে বিকল হয় কিডনি। রক্ত যখন জমাট বাঁধে শরীরে ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়। এই ধরনের রোগীদের আমরা গাইডলাইন অনুসারে বলি সিভিয়ার কোভিড স্টেজ।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে যারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে তাদের মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা আমরা পেয়েছি। থ্রম্বোসিসের কারণে করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। এটাকে করোনার একটি করুণ পরিণতি বলা যায়। ব্লাড ক্লট হয়ে যাবে যখন তখন অন্যান্য অঙ্গ বাঁচানো সম্ভব হয় না। ব্লাড ক্লট করলে আমাদের গাইডলাইনে একটি ইঞ্জেকশনের কথা বলা আছে, ইনোক্সাপেরিন। সেটি কিন্তু আবার মৃদু সংক্রমণ যাদের তাদের জন্য না। মাঝারি সংক্রমণ যখন হবে, নিউমোনিয়ার একটি ভাব পাওয়া যাবে, তখন আর দেরি করা যাবে না। শরীরে যখন রক্ত জমাট বাঁধে তখন বাইরের দিকে ছোপ ছোপ লাল বর্ণের র‌্যাশের মতো দেখা যায়। যখন ফুসফুস বিকল হয়, রক্ত জমাট বাঁধে, এটা একজন ব্যক্তির সবচেয়ে খারাপ অবনতির ক্ষেত্রে হয়। ব্লাড ক্লট হলে সবার আগে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এরপর হার্ট অ্যাটাক, ব্রেইনে হলে স্ট্রোক হতে পারে।’