দেশে না এলেও ঝুঁকি দেখছেন বিশেষজ্ঞরা

143

চীন থেকে আসা দুই হাজার জনকে পরীক্ষা করে করোনা ভাইরাস শনাক্ত করা না গেলেও বাংলাদেশ ঝুঁকিতে রয়েছে বলে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
নতুন ধরনের একটি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে চীনে ইতোমধ্যে অর্ধশত মানুষ মারা গেছে। আক্রান্ত হয়েছে কয়েক হাজার। খবর বিডিনিউজের
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশেরও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গাঢ় বলে ব্যবসায়ী ও নাগরিকদের বেশ আসা-যাওয়া রয়েছে। বাংলাদেশে অনেক প্রকল্পে চীনা নাগরিকরা কাজ করছেন। এছাড়া ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে একবার ভাইরাস চলে এলে দ্রুতই তা বহু মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই জনসচেতনতা বাড়ানো তাগিদও দিচ্ছেন তারা।
চীনে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর গত ২১ জানুয়ারি চীন থেকে আসা বিমানযাত্রীদের পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সরকার।
গতকাল রবিবার পর্যন্ত ২ হাজার ১৯০ জনকে পরীক্ষা করা হলেও কারও শরীরে করোনা ভাইরাস পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল ও পাকিস্তানে নতুন ধরনের এই ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। আক্রান্ত সন্দেহে ভারতের কেরালা ও মহারাষ্ট্রে শতাধিক মানুষকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায়ও আক্রান্ত ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে।
চায়না ইস্টার্ন, চায়না সাউদার্ন, ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স চীন থেকে সরাসরি ঢাকায় যাত্রী পরিবহন করে। আর ড্রাগন এয়ারলাইন্স সরাসরি যাত্রী পরিবহন করে হংকং থেকে।
এই চারটি এয়ারলাইন্সের ২ হাজার ১৯০ জন যাত্রীর শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে বলে বিমানবন্দরে কর্মরত স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. শাহারিয়ার সাজ্জাদ জানান। তিনি বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত কারও শরীরে এ রোগের কোনো লক্ষণ পাইনি।
চীন থেকে আসা বিমানযাত্রীদের বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্রিনিংয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্যের একটি কার্ড পূরণ করতে হচ্ছে।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক এএইচএম তৌহিদ-উল-আহসান এর আগে জানিয়েছিলেন, থার্মাল স্ক্যানারে পরীক্ষায় কোনো যাত্রীর শরীরের তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি পাওয়া গেলে তাকে প্রথমে বিমানবন্দরের পর্যবেক্ষণ কক্ষে রাখা হবে। পরে তাকে প্রয়োজনে কুর্মিটোলা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হবে।
ভাইরাস সংক্রমণের বিভিন্ন লক্ষণ সম্পর্কে বিমানবন্দরে ডিজিটাল ফরমেটে তথ্য দেওয়া হয়েছে।
সরকারের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেছেন, চীন থেকে জ্বর না নিয়ে এলেও আসার ১৪ দিনের মধ্যে যদি কারও জ্বর আসে, তবে যেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
গত ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে করোনাভাইরাস পরিবারের নতুন এই ভাইরাসটির প্রথম দেখা মেলে। চীনা কর্মকর্তারা বলছেন, উহানের বন্যপ্রাণী ও সামুদ্রিক খাবারের বাজারে কোনো দূষিত প্রাণী থেকেই ভাইরাসটি ছড়িয়েছে।
চীনা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে সঞ্চারিত হয়। এতে আক্রান্ত হলে সর্দিজ্বর হয়, সেই সঙ্গে মাথা ব্যথা, কাশি, শরীরের অস্বস্তি বোধ হয়। ফ্লোরা বলেন, করোনা শ্বাসতন্ত্রের রোগ। এটার প্রধান লক্ষণ জ্বর। সঙ্গে সর্দি, কাশি, গলাব্যথা থাকে।
গবেষকরা বলছেন, আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে তো বটেই, হাঁচি-কাশি থেকে বায়ুর মাধ্যমেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। এই ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে হাত সাবান দিয়ে ধোয়ার পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা। হাত না ধুয়ে চোখ, নাক ও মুখে তা না দিতে বলা হচ্ছে। আক্রান্তদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। আক্রান্ত হলে জ্বর ও ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে প্রচুর তরল পানের পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, সর্দি, কাশি, জ্বর, মাথাব্যথা, গলাব্যথা, শরীর ব্যথা এই রোগের লক্ষণ। কারও কারও নিউমোনিয়া হয়, ডায়রিয়াও হয়।
তিনি বলেন, এধরনের ভাইরাস শ্বাসতন্ত্রে আক্রমণ করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকলে কিছুদিন পর এমনিতেই সেরে যায়। কিন্তু জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি যেমন ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্র বা ফুসফুসের পুরোনো রোগীদের ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন এটি মোড় নিতে পারে নিউমোনিয়া, রেসপাইরেটরি ফেইলিউর বা কিডনি অকার্যকারিতার দিকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগ এই রোগের বিষয়ে কিছু সতর্কতা দিয়েছে। মার্স করোনাভাইরাসের বিপরীতে অ্যান্টিভাইরাস আবিষ্কৃত হয়নি। এখনেও আবিষ্কৃত হয়নি কার্যকর টিকাও। এই ভাইরাস প্রতিরোধ করতে চাই ব্যাপক জনসচেতনতা ও ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বোধ।
এ ধরনের ভাইরাস যানবাহনের হাতল, দরজার নব, টেলিফোন রিসিভার ইত্যাদি সাধারণ বস্তু থেকেও ছড়াতে পারে। তাই বাইরে থেকে এসে অবশ্যই সাবান পানি দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে। যারা হাসপাতাল বা ল্যাবরেটরিতে কাজ করেন, তারা হাত পরিষ্কার করতে অ্যালকোহল স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে পারেন।
যেখানে-সেখানে প্রকাশ্যে থুতু-কফ ফেলা বন্ধ করতে হবে। হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় টিস্যু ব্যবহার করতে হবে, যা অবশ্যই একবার ব্যবহারের পরই ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে। হাত দিয়ে নাক মুখ চোখ স্পর্শ যত কম করা যায়, ততই ভালো।
বিদেশ থেকে আগত কোনো ব্যক্তি কাশিজ্বরে আক্রান্ত হলে অন্তত ১৪ দিন তাকে বাড়িতে একটি ঘরে আলাদা থাকতে দিতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশের কারণে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেশি বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার।
তিনি বলেন, যে কোনো ভাইরাস কোথাও একবার ঢুকলে তা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে সব সময়ই একটা ঝুঁকি থাকে। আমাদের দেশে ঝুঁকি আরও বেশি, কারণ আমাদের দেশ জনবহুল। এছাড়া মানুষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে কম, রাস্তাঘাটে থুতু-কফ ফেলে।
প্রাণিবিদ্যার এই অধ্যাপক বলেন, ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশে বিরাজমান তাপমাত্রা-বাতাসের আর্দ্রতা উপযোগী। বিভিন্ন প্রাণির মাধ্যমেও রোগটি ছড়াতে পারে। প্রাণীদের কোনো সীমানা নেই। এ কারণে এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যেতে পারে। ভারত থেকে যদি সীমান্ত পেরিয়ে আসে তাহলে কেউ আটকাতে পারবে না। এখন খেজুরের রসের সময়। বাদুরের মাধ্যমে খেজুরের রসের সঙ্গে জীবাণু মিশে যেতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে আতঙ্ক ছড়ানো মার্স করোনা ভাইরাসের সঙ্গে চীনের নতুন করোনা ভাইরাসটির মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। ২০১২ সালে প্রথম সৌদি আরবে সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর তার নাম দেওয়া হয় মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম বা সংক্ষেপে মার্স। আবু ধাবি থেকে আসা এক বাংলাদেশির এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেছিল এর আগে।
বিএসএমএমইউর মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, করোনা ভাইরাস প্রাণীদেহ থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। এর মধ্যে একটির নাম মার্স বা মিডল ইস্ট রেসপাইরেটরি সিনড্রোম, আরেকটা সার্স বা সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপাইরেটরি সিনড্রোম।
তিনি বলেন, মার্স হয় উট থেকে, সার্স বিড়াল-বাদুরসহ বিভিন্ন প্রাণী থেকে আসতে পারে। এসব প্রাণীর সংস্পর্শে এসে মানুষের মধ্যে রোগটি ছড়ায়। আগে মনে করা হত, শুধু অন্য প্রাণীর মাধ্যমে রোগটি হয়। পরে দেখা গেছে মানুষের মাধ্যমেও রোগটি ছড়ায়।
এই ভাইরাসের এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি বলে প্রতিরোধকেই জরুরি মনে করে তিনি বলেন, যেহেতু রোগটি চীনে হচ্ছে, এ কারণে এখন চীনে না যাওয়াই ভালো।