দেশের স্বাস্থ্যখাতের উজ্জ্বল নক্ষত্র ডা. মোস্তাফিজুর

82

রঞ্জন প্রসাদ দাশগুপ্ত

আমরা প্রায়ই কোন বিশেষ ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে তাঁকে নিয়ে অনেক লেখালিখি করি এবং তার কর্ম ও জীবন নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু ঐ ব্যক্তির জীবদ্দশায় তার কর্ম ও জীবন নিয়ে আলোচনা করি খুবই কম। যার ফলশ্রæতিতে আমরা ঐ ব্যক্তির কর্ম ও গুণের কদর যথাযথভাবে করতে পারি না বলেই দেশে গুণী ব্যক্তির আগমন বা জন্ম হয় কম।
গত ১ জুলাই না ফেরার দেশে চলে গেলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তা ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান। অথচ এমন একজন নীতির মানুষ, নীতির উদ্যোক্তাকে আমরা জীবদ্দশায় খুব কম লোকই জেনেছি। কিন্তু কেন? আমরা কি এসব মানুষদেরকে তার জীবদ্দশায় একটু সম্মান বা তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রশংসা করতে পারি না?
আমাদের দেশে এমন অনেকজন আছেন যারা বিভিন্ন সেক্টরে অবদান রেখে চলেছেন দেশের জন্য। তারই এক জীবন্ত উদাহরণ স্বাস্থ্যখাতের অন্যতম উদ্যোক্তা, সততার মূর্তপ্রতীক, ব্যবসায়ী সমাজের উজ্জ্বল নক্ষত্র পপুলার গ্রæপের কর্ণধার ডা. মোস্তাফিজুর রহমান।
ডা. মোস্তাফিজুর রহমানের জন্ম বগুড়া জেলায়। পিতা মরহুম মুনীর উদ্দীন আহমেদ। ১৯৭৮ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হতে এমবিসিএস পাশ করার পর উক্ত মেডিকেল কলেজে ‘মেডিকেল অফিসার’ হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ‘ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্ট’ হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা মেডিকেলে ছিলেন। ১৯৮৩ সালে ঢাকার এলিফেন্ট রোডে ছোট পরিসরে পপুলারের যাত্রা শুরু করেন সিংগেল এক্সরে মেশিন, সেমিঅটো-ম্যানুয়েল প্যাথলজি মেশিন দিয়ে। আত্মবিশ্বাস ছিল একদিন পপুলার ডায়াগনস্টিক দেশের সেরা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরিণত হবে। আজ তা বাস্তবে রূপ নিল।
অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তাঁর নিজের মেধা, স্বকীয়তা, নৈতিকতা ও শ্রম দিয়ে গড়ে তুলেছেন ধানমন্ডিস্থ হেড অফিস সহ ২১টি ব্রাঞ্চ, যা দেশের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে আছে। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। সেই সময়ে অর্থ প্রতিপত্তির বিশালতা না থাকলেও তাঁর মনে ছিলো অদম্য পাহাড়সম স্বপ্ন। তিনি প্রায়ই আমাদের বলতেন- শুরু থেকে তাঁর চিন্তা ভাবনা ছিল স্বাস্থ্যখাতে এমন কিছু করা, যাতে দেশের মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা না যায় অথবা উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়ে দেশের রেভিনিউ চলে না যায়। তাই তিনি বিশ্বের সব নামকরা বিখ্যাত কোম্পানীর মেশিনাদি দিয়ে উন্নতমানের ডায়াগনস্টিক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
সৃষ্টি যার নেশা তাকে কি কখনো দমানো যায়?
২০০২ সালে তিনি পপুলার ফার্মাসিউটিক্যাল এর যাত্রা শুরু করেন অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে। ২০০৬ সালে শুরু করেন পপুলার অফথ্যালমিক লিমিটেড (ঊুব ফরারংরড়হ), ২০০৭ সালে শুরু করেন দেশের একমাত্র ঋঋঝ ঞবপযহড়ষড়মু-তে ওহভঁংরড়হং উবারংরড়হ পপুলার ইনফিউশন লিমিটেড। ২০০৮ সালে শুরু করেন পপুলার এগোভেট লিমিটেড নামে আরো একটি কোম্পানী। ২০০৯ সালে পপুলার স্পেশালাইজড হসপিটাল লিমিটেড এবং সর্বোপরি ২০১০ সালে শুরু করেন পপুলার মেডিকেল কলেজ এর কার্যক্রম। তিনি যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই ‘সোনা’ ফলিয়েছেন, দেশের কর্মসংস্থানে রেখেছেন বিশাল অবদান। এখন পর্যন্ত সম্ভবত ১২ হাজার কর্মী আছেন তাঁর গ্রæপে। আর এর সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছেন আরো লাখখানেক মানুষ।
স্বাস্থ্যখাতে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। একটা বিষয়ে না বললেই নয়- দেশের অনেক ব্যবসায়ী আছেন যারা বিভিন্ন সেক্টরে তাঁদের ব্যবসা প্রসার করেছেন। কিন্তু ডা. মোস্তাফিজুর রহমান শুধুমাত্র স্বাস্থ্য সেক্টরে তাঁর ব্যবসা বৃদ্ধি করেছেন, অন্য কোন খাতে নয়। আমার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁর সান্নিধ্যে ৭-৮ বছর কাজ শেখার। খুব কাছ থেকে তাঁকে আমি দেখেছি, তিনি অনেক বড় মাপের মানবিক ব্যক্তি। তাঁর কর্মীদের সবসময় খোঁজ-খবর নিতেন। তিনি বলতেন, তাঁর ব্রাঞ্চের এক একজন ‘ব্রাঞ্চ ম্যানেজার’ এক একটি পপুলারের শাখা এমডি। তিনি কখনো নিজেকে মালিক পরিচয় দিতেন না। সব সময় বলতেন, তিনি পপুলারের একজন একনিষ্ঠ খাদেম। পপুলার আমার নয়, আমাদের সকলের। কোম্পানিতে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পপুলারের অগ্রযাত্রার মূল চালিকা শক্তি। তিনি প্রায় সময় ম্যানেজারদের মিটিংয়ে বলতেন, মালিক শব্দটা আধুনিক ব্যবসার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। আমি যদি মালিক বলি বা এ শব্দ ব্যবহার করি তাহলে তুমি বা তোমাদের (কর্মীরা) সবাইকে উল্টোদিকে ঠেলে দিচ্ছি। সে জন্যই তিনি ক্ষমতায়নের কথা বলেন। মালিক, শ্রমিক বা কর্মচারী এভাবে ভাবলে চলবে না। আমার মনে আছে ২০০৮ সালে যখন পপুলার ফার্মাসিউটিক্যাল ‘জড়ধফ ংযড়’ি শুরু করেছিল তখন তিনি বলেছিলেন- আমার শেয়ার আছে, মালিকানা আছে, কিন্তু তোমরা যারা কাজ করছ, সবাই আমার সহকর্মী। ডেলিভারী ম্যান থেকে শুরু করে ডিরেক্টর পর্যন্ত সবাই মিলেমিশে পপুলার ফার্মার ইতিহাসের অংশীদার। আমরা সবাই সহকর্মী। তিনি বলতেন, যখন তুমি ‘মালিক’ শব্দটা ব্যবহার করবে তখন তুমি আর ‘টিমওয়ার্ক’ পাবে না। আজ সত্যিই পপুলার ফার্মাসিউটিক্যাল একটি ইতিহাস সৃষ্টি করে চলেছে প্রতিনিয়ত। যেকোন পর্যায়ের কর্মীকে তিনি তাঁর কাজের প্রতিদান দেয়ার চেষ্টা করেন। কোন ব্রাঞ্চ ম্যনেজার ওহহড়াধঃরাব কোন কাজ করলে সাথে সাথেই প্রশংসা করেন এবং অন্য ম্যানেজারদেরকে শেয়ার করেন। আর নতুন কোন প্রস্তাব তাঁর পছন্দ হলে সাথে সাথে বলেন ‘উড়হব’। স্যারের সেই চমৎকার ‘উড়হব’ উক্তিটি আজো আমার কানে বাজে। আজো আমার কাজে প্রেরণা জোগায়।
ডা. মোস্তাফিজুর রহমান স্যারকে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালে সিআইপি মর্যাদা দেন। আমি জেনেছি, ডা. মোস্তাফিজুর রহমান স্যার কখনো স্থায়ী সম্পদে আগ্রহী নন, তিনি চান প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে। আর সেই প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজটি করেছেন অত্যন্ত সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে। অর্থ নয় তিনি বেশি চান তাঁর প্রতিষ্ঠানের সুনাম। তাই নীতি ও নৈতিকতার সঙ্গে কখনো আপস করেন না। এসব ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী সমাজের মধ্যে উজ্জ্বল একটি নাম ডা. মোস্তাফিজুর রহমান। ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ও পপুলার একে অপরের সমার্থক হয়ে আছেন। পপুলার ফার্মার ঔষধ আজ বিশ্বের ২৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে, দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা ছাড়াও বিদেশ থেকে অনেক সুনামও বয়ে আনছেন।
নিজের মূল্যবোধের আলোকে দৈনন্দিন জীবন-যাপন করেন তিনি। পরিবারের প্রতি যতœশীল, বন্ধুবৎসল, দৃঢ়চেতা মনোভাব সবদিক দিয়ে তিনি অসাধারণ। দুই পুত্র ও এক কন্যাকে লেখাপড়া শিখিয়ে একজন সফল বাবা হিসেবে নিজেকে দাবি করতেই পারেন। পরিবার তথা প্রতিষ্ঠানের সহকর্মীদের প্রতি খুবই যতœশীল একজন মানুষ। ২০১২ সালের যখন আমার মেঝো ছেলে মৃত্যুশয্যায় হাসপাতালে ছিল, সে সময়ে স্যারের আর্থিক এবং মানসিক সাহায্য আমাকে আবার নতুন করে কাজ করার যে শক্তি জুগিয়েছে, তা জীবনেও ভুলার নয়। নিজের আত্মীয়-স্বজনদের জন্য পড়াশুনা থেকে শুরু করে অনেক ব্যাপারে দু’হাত খুলে সাহায্য করে যাচ্ছেন যা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই তাঁর হাতেগড়া পপুলার গ্রæপের প্রত্যেক কর্মীদের মনে তাঁর মোটিভেশন, ন্যায়পরায়ণতা, সততা এবং প্রজ্ঞা সহ বহুগুণের মূর্তপ্রতীক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান। ডা. মোস্তাফিজুর রহমান স্যারের দেখানো পথে তাঁর শিক্ষা সঞ্চারিত হচ্ছে সব কর্মীদের অন্তরে। আর সেই শিক্ষার ধারক হয়ে পপুলারের সব কর্মীরা স্যারের স্বপ্ন ও অনন্ত ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবে অদম্য গতিতে- এ আমার বিশ্বাস।
চিকিৎসা খাতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রকে আমাদের মাঝে অনন্তকাল ধরে আনন্দময় পরিবেশে সুস্থ সবল রাখুন পরম করুণাময় মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে করজোড়ে এ প্রার্থনা। স্যারের প্রতি-

‘চরণ ধরিতে দিয়োগো আমারে
নিয়োনা নিয়োনা সরায়ে
জীবন মরণ সুখ-দুঃখ দিয়ে
বক্ষে ধরিব জড়ায়ে।’
লেখক : স্বাস্থ্যকর্মী ও সমাজকর্মী