দেশের স্বার্থে কর্ণফুলীকে বাঁচাতে হবে

44

রাজকুমারির কানের ফুল হারানোর বিষাদ-বেদনায় যে চোখের জল বিসর্জনে নদীর নাম কর্ণফুলী হয়েছে বলে প্রবাদ আছে, আজ চট্টগ্রামবাসীর বিষাদ-বেদনা তার চেয়ে হাজারো গুণ বেড়ে গেছে। কারণ ইতিহাস, ঐতিহ্য সর্বোপরি দেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ কর্ণফুলী আজ নিজের অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। সেই সাথে আশঙ্কা করা হচ্ছে দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি বন্দরের অস্তিÍত্ব নিয়ে। এ আশঙ্কা প্রায় দুই দশক ধরে তীব্র হতে থাকলেও কর্ণফুলী ও বন্দরের দেখাশোনার দায়িত্বে যারা তাদের তেমন টনক নড়ছে বলে মনে হয়না। ফলে চট্টগ্রামবাসীর ক্ষোভ আর দুঃখ নানা মাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে। এতেও ঘুম না ভাঙলে কর্ণফুলী ও বন্দর রক্ষার তীব্র আন্দোলনের কথা বলছেন কর্ণফুলী নিয়ে সামাজিক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনা করেন-এমন কয়েকজন। তবে মাঝেমধ্যে আশার আলো ঝলক মারেনা তা নয়, গত বছর বন্দর, জেলা প্রশাসক, সিডিএ ও সিটি কর্পোরেশন কোমর বেঁধে নেমেছিল কর্ণফুলী নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে, চালিয়েছিলেন ব্যাপক উচ্ছেদ অভিযানও। এসময় অনেকের সমালোচনা ও সন্দেহকে দূরীভুত করতে ভূমিমন্ত্রী গর্জে উঠেছিলেন এই বলে ‘কর্ণফুলীকে দখলমুক্ত করার এ উচ্ছেদ অভিযান কোন শক্তিই রুখতে পারবেনা’। কিন্তু আমরা দিনের পরে দেখলাম রুখবার যারা তাদের শক্তি ক্ষমতাশীলদের চেয়ে বেশি! উল্লেখিত অভিযান অবশ্যই উচ্চ আদালতের নির্দেশেই হয়েছিল, বলা যায়, প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো বাধ্য হয়েছিলেন। অভিযানের যে ছন্দপতন ঘটেছিল, এরপর আর আলোর মুখ দেখেনি। অভিযোগ রয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষের লিজের কারণে এ অভিযান থমকে পড়ে। এখন যে অভিযোগ উচ্ছেদকৃত অংশে আবারও স্বার্থান্বেষী মহল স্থাপনা তৈরি করার প্রয়াস চালাচ্ছে , অন্যদিকে বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। যদি তাই হয়, তাহলে ধরে নেয়া যায় ‘ঘরের শত্রæ বিভীষণ’। সম্প্রতি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ অব্যাহত দখল ও দূষণের হাত থেকে কর্ণফুলী নদীকে বাঁচাতে মাঝিদের সাথে নিয়ে যে সাম্পান র‌্যালি করেছে, তাতে নেতৃবৃন্দ যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা প্রণিধানযোগ্য। কারণ এ বক্তব্যগুলো স্বয়ং সরকারি দলের নেতাদের। বিশেষ করে সদ্যবিদায়ী মেয়র আ.জ. নাছির উদ্দিন যে কথাগুলো বলেছেন, তাতে আমাদের ধারণা, কর্ণফুলীর এ মরণযাত্রার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারেনা। তিনি বলেন, ‘লুসাই পর্বতই কর্ণফুলী নদীর উৎস। সেখান থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। এই কর্ণফুলী নদীর তীরেই বিশ্বের অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক বন্দর গড়ে উঠেছে প্রায় ২০০০ বছর আগে। এই বন্দর জাতীয় অর্থনীতির হৃদপিÐ। অথচ যেই নদীটির তীরে চট্টগ্রাম বন্দর গড়ে উঠেছে তাকে চেতন বা অবচেতন মনে প্রতিদিন হত্যা করে চলেছি। তিনি আরো বলেন, প্লাস্টিক ও পলিথিন আগ্রাসনে এবং নানা ধরনের অপচনশীল বর্জ্যে কর্ণফুলী নদীর প্রায় ২০ ফিট গভীরতা কমে গেছে। ২০ ফিটের এই পলেস্তারের কারণেই নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং চালানো দুরূহ হয়ে পড়েছে। এছাড়াও কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী প্রায় ৮০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে অন্তত ৩০০টিরও বেশি কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এই শিল্প ও কলকারখানাগুলোর দূষিত তরল বর্জ্য এই নদীতেই ফেলা হচ্ছে। তাই এই নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। মৎস বিচরণের পরিবেশ নেই বললেই চলে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ সিস্টেম কর্ণফুলী নদীমুখী হবে কেন ? আরো একটি প্রশ্ন কর্ণফুলী নদীতে নিয়মিত ড্রেজিং করা সম্ভব না হওয়ায় চট্টগ্রামে খাল, নালা, নর্দমা থেকে পানি নদীতে যেতে পারলেও এই নদীর ধারণ ক্ষমতা নেই কেন? তাই জোয়ারের পানিসহ বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা লেগেই থাকে। তিনি আরো বলেন, এই কর্ণফুলী নদীকে বাঁচাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে চট্টগ্রাম বন্দর। তিনি আরো বলেন, কর্ণফুলী শুধু একটি নদী নয় জাতীয় অর্থনৈতিক প্রাণপ্রবাহ। কর্ণফুলী বাঁচাতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা। কর্ণফুলীর নদীতে যাতে অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠতে না পারে, নদী ভরাট করে নদী দখল না হয় এবং আমরা কেউ যেন সামান্য পরিমাণও কর্ণফুলী নদীকে দূষিত না করি তাহলে কর্ণফুলী নদী রক্ষা উদ্যোগ অনেকাংশে সফল হবে’। মেয়র দায়িত্ব থাকাকালীন এ ব্যাপারে কতটুকু কাজ করেছেন, তা এ মুহূর্তে বলার অবকাশ না থাকলেও তিনি যে সত্যটি বলেছেন এর সাথে আমরা একমত। আমরা মনে করি, কর্ণফুলী প্রাকৃতিক সৃষ্টি। একে রক্ষা করার দায় বন্দরের যেমন রয়েছে এ নদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদেরও সচেতন হতে হবে। সুতরাং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও বন্দর কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসলে কর্ণফুলী বাঁচবে। কর্ণফুলী বাঁচলে দেশ বাঁচবে।