দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা সংস্কার করতে প্রয়োজন কমিশন গঠন

41

শাহাবুদ্দীন খালেদ চৌধুরী

এ দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে অবহেলা এবং নিয়ম বহির্ভূতভাবে পরিচালনা করার সময় আর নেই। বিভিন্ন ঝুঁকিতে ব্যাংকিং খাত ভীষণ দুর্বল এবং নাজুক হয়ে পড়েছে। খেলাপী ঋণের কারণে গত ১০ বৎসরে ব্যাংকের মুনাফা প্রায় এক তৃতীয়াংশ কমে গেছে। আমানত কমে যাওয়ায় এবং খেলাপী ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা হারাতে বসেছে। এসবের ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থাটাই ধ্বংস হতে বসেছে। দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে আর দেশের অর্থনীতি সচল থাকবে সেরকম কোন ব্যবস্থা অর্থনীতিতে বের হয় নাই। যাঁরা ব্যাংকগুলির উদ্যোক্তা তাঁদের কাছ থেকেও ব্যাংকগুলি উদ্যোক্তাসুলভ আচরণ পায় নাই। কাজেই আমাদের দেশের ব্যাংকগুলি সৃষ্টির প্রথম থেকেই উদোক্তাদের কাছ থেকে সদাচরণ না পাওয়াতে দেশের সম্পূর্ণ ব্যাংক ব্যবস্থাটাই ঝুঁকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিজ ব্যাংক ও অন্য ব্যাংক থেকে পরিচালকেরা ঋণ নিয়েছে প্রায় পৌনে ২ লাখ কোটি টাকা। হিসাব করলে দেখা যায় এই ঋণের পরিমাণ হলো সারা দেশের মোট ব্যাংক ঋণের ১২ শতাংশের বেশি। ব্যাংকের পরিচালক হতে প্রতিজনকে ২০ কোটি টাকার বেশি দিতে হয় নাই। ২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে নামে বে-নামে শত শত কোটি টাকার ঋণ নিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা বের করেছেন। ব্যাংক পরিচালকদের মধ্যে সর্বোচ্চ ঋণ নিয়েছেন ৩০০ জনের মতো পরিচালক। এক জন পরিচালক হতে বিনিয়োগ করেছেন ২০ কোটি টাকা। তাহলে ৩০০ জন পরিচালককে ৬ হাজার কোটি টাকা পরিচালক হওয়ার জন্য ব্যাংকে জমা দিতে হয়েছে। কিন্তু ঋণের নামে তাঁরা ব্যাংক থেকে বের করে নিয়েছেন প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা। এরপর ঋণ পুন তফসীলের সিলের মাধ্যমে বছরের পর বছর ঋণ নবায়ন করা হচ্ছে কোন রকম ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই।
পরিচালকদের প্রথম প্রথম নিজ ব্যাংক থেকেই ঋণ নিতেন। তারপর বৎসরের পর বৎসর ধরে এ ঋণ শোধ করতেন না। যখন খেলাপী হয়ে যেত তখন বে-নামে ঋণ নিয়ে ঐ ঋণ শোধ করতেন এমনও নজির রয়েছে । পরিচালকেরা পরিচালনা পর্ষদরে সভা করে নিজেরাই অর্থনৈতিকভাবে নিজেরদের সুদ মওকুফ করে নিতেন। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক এই অর্থনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করতে কড়াকড়ি আরোপ করে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক আরও নির্দেশ দেয় যেকোন পরিচালক তার মোট শেয়ারের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নিজ ব্যাংক থেকে নিতে পারবে না। আসল কথা হলো যত ব্যবস্থায় গ্রহণ করা হউক না কেন প্রকৃত পক্ষে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ না করলে এইভাবেই চলবে এবং এক সময় ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। আসলে শুধু বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এই দুরবস্থা চলছে তা নয়। ভারতের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আমাদের থেকে অনেকগুণ বেশি অব্যবস্থা বলছে। শত শত কোটি টাকা বিভিন্ন কৌশলে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
যাই হউক, আমাদের বর্তমান অর্থমন্ত্রী মোস্তাফা কামাল সাহেব শুধু উচ্চ শিক্ষিত নন, তিনি আমাদের দেশের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত একজন শিল্পপতি এবং দীর্ঘ ব্যবসায়িক জীবনে ঋণ খেলাপী হতেও শোনা যায় নাই। অর্থমন্ত্রী হিসাবে তাঁর সফলতার ব্যাপারে বিদেশিদের মতো দেশবাসীও আশাবাদী। তিনি ইতি মধ্যেই ঘোষণা করেছেন, তিনি সার্বিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সমস্ত ত্রুটি, বিচ্যুতি দূর করে সঠিক পথে চলার জন্য কি কি পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা নিতে হবে সেই দিক নির্দেশনা দেওয়ার জন্য তিনি অচিরেই একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করার ইঙ্গিত দিয়েছে। অর্থমন্ত্রীর সঠিক পস্থা উপলব্ধির জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তিনি অভিজ্ঞ মানুষ হিসাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিবেন তাতে দেশবাসির পূর্ণ আস্থা রয়েছে। তবে আজকে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যেই দুরবস্থা চলছে ইহাকে এই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যাঁরা দায়ী তাঁরা অত্যন্ত শক্তিশালী। তবে এইবার ইনশাআল্লাহ্ সফলতার অতি প্রবল। কারণ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এই অশুভ চক্রের বিরুদ্ধে সারা দেশের একটি গণসচেতনতার সৃষ্টি হয়েছে। ২০১২ সালের হলমার্ক সোনালী ব্যাংকের বড় বড় কর্মকর্তাদের যোগসাজসে ব্যাংক ঋণের নামে যে ব্যাংক ডাকাতি করেছিল তখন সংবাদ মাধ্যমসহ দেশের অর্থনীতিবিদ এবং সৎ ব্যবসায়ী নেতাদের একটি বিরাট অংশ জোর দাবি তুলেছিলেন একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করে সম্পূর্ণ তদন্ত শেষে কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যাংকিং ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর জন্য। কিন্তু তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী তখন এই ব্যাপারে আশ্বাস দিলেও পরে হয়তো তার বয়সের ভারে তা ভুলে বসেছিলেন। কিন্তু বর্তমান অর্থমন্ত্রী নিজেই একজন শিল্পপতি, শিল্প গড়তে গিয়ে শিল্পপতির জীবনে কত দ্বৈব দূর্বিপাকের মোকাবিলা করতে হয় তাঁর সবই জানা থাকার কথা। কাজেই ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে অর্থনীতির কি ক্ষতি হবে অনেকের চাইতে অর্থমন্ত্রী ভাল বুঝবেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর বুঝা উচিৎ যে মূল্যবান সময় দ্রæত চলে যাচ্ছে। সেহেতু এই কাছে সময় ক্ষেপন করা কিছুতেই উচিৎ হবে না।
আসলে খেলাপী ঋণের অশুভ পরিণতি সহ্য করার শক্তি দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার আর অবশিষ্ট নেই। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত হিসাবে দেখা যায় দেশের সর্বমোট ব্যাংক ঋণের ১২ শতাংশই খেলাপী হয়ে গেছে।
ব্যাংক ঋণ নিয়ে বর্তমানে কোর্টে যেসব মামলা চলছে সেই ঋণ গুলির হিসাব ১২ শতাংশ হিসাবের মধ্যে নেই। এইগুলিসহ হিসাব করলে এই অংক দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামি দিনগুলিতে আমাদের অর্থনীতির জন্য কোন সু-খবরের আশা করা আপাতত যাচ্ছে না। আমাদের রপ্তানি আয় গত ফেব্রæয়ারি মাস থেকেই কমতে শুরু করেছে। গত ফেব্রæয়ারি মাসে আমাদের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ছিল ৩.৭২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু গার্মেন্টস পণ্য কম রপ্তানি হওয়াতে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৩.৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। রপ্তানীর পরিমাণ যে সামনে আরও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমবে তাতে কোন সন্দেহ করার অবকাশ নেই।
যাই হোক, বর্তমানে দেশে সর্বমোট খেলাপী ঋণের ৫১ শতাংশ রয়েছে সরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির কাছে। ৪৭ শতাংশ রয়েছে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির কাছে যেগুলি ব্যক্তি মালিকানায় আছে। আমাদেরকে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সঠিক পরিবর্তন আনতে হলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা কি কি সংস্কারমূলক পরিবর্তন আনতে তার দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য অচিরেই আমাদেরকে উপযুক্ত সদস্যবৃন্দ নিয়ে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করতে হবে।
(ক) কমিশনের কাছে বর্তমান ব্যাংকিং ব্যবস্থা সুনির্দিষ্ট সমস্যাগুলি উল্লেখ করে সেই সবের সমাধানগুলি বের করার দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে।
(খ) কমিশনকে তদন্তে বের করতে হবে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এই দুরবস্থার জন্য কারা দায়ী, বিশেষ কোন প্রতিষ্ঠানগুলো দায়ী এবং কিভাবে দায়ী।
গ) কমিশনকে বিস্তারিতভাবে এই দুরবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য ব্যাংকের প্রসাশনিক ব্যবস্থাসহ অন্যান্য দিক দিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কারের দিকনির্দেশনা দিতে হবে। কমিশনকে তাঁদের কাজ সম্পাদন করার জন্য বড় জোর ৬ মাসের বেশি সময় দেওয়া যাবে না। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাথে জড়িত সব শ্রেণীর মানুষের সাথে ব্যাপক আলোচনা করা কমিশনের প্রধান দায়িত্ব হিসাবে থাকবে। সবচাইতে জরুরি হলো কমিশন এমন ব্যক্তিকে নিয়ে গঠন করা উচিৎ, যারা ব্যাংকিং বিষয়ে অতীব অভিজ্ঞ, সৎ এবং যাদের এই ব্যাপারে দক্ষতা রয়েছে।
কমিশনকে স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা পরিপূর্ণভাবে বজায় রেখে কাজ করার অবাধ সুযোগ দিতে হবে। সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো সরকারকে এই সব ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। কোন অবস্থাতেই এই ব্যাপারে কায়েমী স্বার্থবাদীদের আশ্রয়, প্রশ্রয় না দেওয়ার নীতিতে অটল থাকতে হবে। বিশ্বে যুগে যুগে অনেক অর্থনীতির লেজে গোবরে অবস্থা হয়েছে। শুধু অর্থনৈতিক কারণ বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে।
যাই হোক আমাদের মনে রাখতে হবে যে, যতদিন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে চলবে, ততদিন ব্যাংকিং সেক্টরে শৃংখলার অভাব থাকবেই।
লেখক : কলামিস্ট