দেশের অর্থনীতি চাপের মুখে

57

বেশ চাপের মুখে পড়েছে অর্থনীতি। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে গতি সঞ্চার হয়েছিল সেটা আর নেই। দিন যত যাচ্ছে অর্থনীতিতে সংকট ততই বাড়ছে।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ছাড়া অর্থনীতির সব সূচকই এখন নেতিবাচক। রপ্তানি বাণিজ্যে ধস নেমেছে। রাজস্ব আদায় কমছে। মূল্যস্ফীতি উর্ধ্বমুখী। চাপে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। আমদানিও কমছে।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিনিয়োগে। প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার বিশাল অংকের খেলাপি ঋণ নিয়ে ডুবতে বসেছে ব্যাংকিং খাত। পতনের ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না পুঁজিবাজার।
বাংলাদেশের অর্থনীতির হালচাল বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এমনটাই বলছিলেন অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। খবর বিডিনিউজের
তিনি বলেন, সত্যিই সংকটের মুখে পড়েছে আমাদের অর্থনীতি। অর্থনীতির স্বাস্থ্য এখন খুবই দুর্বল। গত কয়েক বছরে যতোটা সবল হয়েছিল সেটা আর এখন নেই। দিন যতো যাচ্ছে দুর্বলতা বাড়ছে।
একমাত্র রেমিটেন্স ছাড়া অর্থনীতির অন্য সব সূচকের অবস্থা খারাপ বলে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বিশ্লেষক করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর।
কেনো এমনটা হচ্ছে- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আত্মতুষ্টিতে ভুগেছি। অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যে ওষুধ খাওয়ানো প্রয়োজন ছিল সেটা খাওয়াইনি। অর্থাৎ যে রিফর্মসগুলো (সংস্কার) জোরালোভাবে চালানো উচিৎ ছিল সেটা করিনি। উল্টো কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ব্যাংকিং খাতের অবস্থা আরও খারাপ করেছে।
আর ব্যাংকিং খাতের এই নাজুক অবস্থা অর্থনীতির স্বাস্থ্যকে ‘দুর্বল’ থেকে ‘দুর্বলতর’ করছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
অর্থনীতির হালনাগাদ তথ্য ঘাটতে গিয়ে আহসান মনসুরের বিশ্লেষণের মিল খুঁজে পাওয়া গেছে।
রপ্তানি আয় কমছেই। পণ্য রপ্তানিতে বড় ধাক্কা খেয়েছে বাংলাদেশ। প্রতি মাসেই কমছে এই আয়। সর্বশেষ অক্টোবর মাসে ৩০৭ কোটি ৩২ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। যা গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ১৭ দশমিক ১৯ শতাংশ কম। লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে প্রায় ১২ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) হিসাবে রপ্তানি আয় কমেছে ৭ শতাংশের মতো। লক্ষ্যমাত্রা থেকে কম ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। সার্বিক পরিস্থিতিকে ‘খুবই খারাপ’ উল্লেখ করে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি রুবানা হক আরও ভয়াবহ তথ্য দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, গেলো অক্টোবর মাসের ১ থেকে ২৮ অক্টোবর সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ২২ শতাংশ। অথচ গত বছরের এই ২৮ দিনে ৩৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এ নাজুক অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য খুব শিগগিরই রপ্তানিকারকদের নিয়ে একটি বড় বৈঠক করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন রুবানা হক।
সুখবর নিয়ে অর্থবছর শুরু হলেও দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসেই ধাক্কা খায় রপ্তানি আয়। প্রথম মাস জুলাইয়ে গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে সাড়ে ৮ শতাংশ বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছিল। কিন্তু আগস্ট মাসে গত বছরের আগস্টের চেয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ আয় কম আসে। সেপ্টেম্বরে কমে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ।
তবে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে সুবাতাস বইছে। সদ্য শেষ হওয়া অক্টোবর মাসে ১৬৪ কোটি ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন তারা। এই অংক এক মাসের হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স। আর গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে বেড়েছে ৩২ দশমিক ৩২ শতাংশ। আর এ নিয়ে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি। দুই শতাংশ হারে প্রণোদনা এবং জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধির কারণে রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়েছে বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তবে এক্ষেত্রেও আত্মতুষ্টিতে না ভুগে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
রপ্তানি আয়ে বড় ধাক্কার কারণে ফের ঘাটতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য-ব্যালান্স অফ পেমেন্ট। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অথচ আগস্ট মাস শেষেও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।
গত দুই অর্থবছরে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে বড় ঘাটতি নিয়ে বছর শেষ হয়েছিল। কিন্তু এবার অর্থবছর শুরু হয়েছিল ‘স্বস্তির’ মধ্য দিয়ে ২৪ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত নিয়ে। আগস্ট পর্যন্ত সেই উদ্বৃত্ত ধরে রাখা গিয়েছিল। কিন্তু সেপ্টেম্বর শেষে আবারও ঘাটতি দেখা দিয়েছে এই সূচকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) চলতি হিসারের ভারসাম্যে ৬৭ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ঘাটতি (ঋণাত্মক) দেখা দিয়েছে।
চলতি হিসাবের ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শুরু করেছিল বাংলাদেশ। প্রথম মাস জুলাইয়ে ২৪ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। আগস্ট শেষে উদ্বৃত্ত দাঁড়ায় ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ৫২৫ কোটি ৪০ লাখ ডলারের বড় ঘাটতি (ঋণাত্মক) নিয়ে শেষ হয়েছিল গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল আরও বেশি ৯৫৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
নিয়মিত আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাব উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হল, নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।
বেশ কিছুদিন ধরেই আমদানিতে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তার আগের বছরের চেয়ে আমদানি ব্যয় মাত্র ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ বেড়েছিল। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তা ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ ঋণাত্মক হয়েছে।
অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, এই তিন মাসে শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমেছে ৮ শতাংশ। জ্বালনি তেল আমদানি কমেছে ১৪ শতাংশ। আর শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বৃদ্ধি এবং আমদানি ব্যয় কমার পরও চাপের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়- রিজার্ভ। বৃহস্পতিবার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
২০১৭ সালের গত ২২ জুন অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে বাংলাদেশের রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। এরপর প্রতিবারই আকুর বিল শোধের পর রিজার্ভ নেমে আসে। ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়নি।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ- এই নয়টি দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যে সব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পর পর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।
পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে অক্টোবরে মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। যা ২০১৮ সালের অক্টোবরে ছিল ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস।
অক্টোবরে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ হয়েছে, যা গতবছর অক্টোবরে ছিল ৫ দশমিক ০৮ শতাংশ। তবে খাদ্যবর্হিভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেশ কমেছে; ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশে নেমে এসেছে।

চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রাজস্ব আদায় বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কম ১৭ শতাংশের মতো।
অর্থাৎ গত অর্থবছরের মতো চলতি অর্থবছরেও রাজস্ব আহরণে বড় ঘাটতির দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা নেই। নেই জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধ। বিদ্যুৎ-গ্যাস সমস্যারও উন্নতি হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট নেই।
কিন্তু এ সবের কোনো প্রভাব অর্থনীতির প্রধান সূচক বিনিয়োগে পড়েনি। ‘যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই’ আটকে আছে বিনিয়োগ। বেসরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি সরকারি বিনিয়োগও বাড়েনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে কলকারখানা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমেছে ৮ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ২০ শতাংশের মতো।
সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশে নেমে এসেছে। গত অর্থবছর শেষে যা ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। আর এটাকেই ‘এই মুহূর্তে’ বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা বলে মনে করছেন আহসান এইচ মনসুর।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ এর ঘরে, সেই প্রবৃদ্ধি এই দশ বছরে বেড়ে ৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে। কিন্তু ২০১৯ সালের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে, গত দশ বছরে দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির আনুপাতিক হারে বেড়েছে সামান্যই।
পুঁজিবাজারের অবস্থা আরও করুণ। মূল্যসূচক কমছোই। লেনদেন নেমে এসেছে তলানিতে। ২০১০ সালের ধসের পর নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। উল্টো দিন যতো যাচ্ছে পরিস্থিতি ততোই খরাপের দিকে যাচ্ছে। পুঁজিবাজারে অব্যাহত দর পতনের প্রতিবাদে বুধবার ঢাকার মতিঝিলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এর সামনে বিক্ষোভ করে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির এক চতুর্থাংশের দাম অভিহিত মূল্যের (ফেস ভ্যালু, ১ টাকা) নিচে নেমে এসেছে। বেশ কিছু কোম্পানির দর ৫ টাকার কম।
আহসান মনসুর বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) একটি শক্তিশালী রিপোর্ট দিয়েছে। যা সরকারের কিছুটা হলেও টনক নড়েছে বলে মনে হচ্ছে। আসল জায়গায় আঘাত করেছে আইএমএফ।
আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার প্রবণতার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। প্রভাবশালী, ওপর মহলে ভালো যোগাযোগ আছে এবং ধনী, এমন কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেওয়ার কোনো তাগিদই অনুভব করেন না। এমনকি বাংলাদেশে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও এখন নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান এসব ঋণগ্রাহকেরা।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যা অনেক দিনের। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঋণ কেলেঙ্গারি-অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই ব্যাংকিং খাতের এই দুরাবস্থা হয়েছে বলে মনে করেন আইএমএফের কর্মকর্তা হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।
বাংলাদেশের আর্থিক খাত বিশ্লেষণ করে আইএমএফ বলেছে, এখানে খেলাপি আড়াল করে রাখা আছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি দুর্বল, ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের আচরণ বেপরোয়া। নিয়ম ভাঙলে শাস্তিও পান না তারা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থায় এবং বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে।
আন্তর্জাতিক এই ঋণ সংস্থা ছয় মাস ধরে বাংলাদেশের আর্থিক খাত পর্যালোচনা করে সরকারকে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। সরকারের আমন্ত্রণেই আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা পর্যালোচনা করতে দুই দফায় বাংলাদেশে এসেছিল। প্রথম আসে গত এপ্রিলে, এরপর গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে। পর্যালোচনা শেষে সংস্থাটি ৪৩টি সুপারিশ করেছে। ৬৮ পৃষ্ঠার এই রিপোর্টে দেশের ব্যাংক খাতের নানা অব্যবস্থা ও সংকটের খোলামেলা আলোচনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই একটি তথ্য জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ৬৭৫ জন ঋণগ্রহীতা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে রেখেছেন। ফলে ঋণ খেলাপি হিসেবে তাদের নাম বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) উল্লেখ করা হয় না। এ রকম ঋণের পরিমাণ এখন ৭৯ হাজার ২৪২ কোটি টাকা।
বিভিন্ন সময়ে বিশেষ ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়। সরকারের নির্দেশে বারবার ঋণ পুনঃ তফসিল করার উদাহরণও আছে। ২০১৫ সাল থেকে শুরু হয়েছে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণের পুনর্গঠন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এ রকম বিশেষ নির্দেশিত হিসাবে থাকা ঋণের পরিমাণ ২৭ হাজার ১৯২ কোটি টাকা।
আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে গত জুন পর্যন্ত আরও ২১ হাজার ৩০৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করে দিয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক। এভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হলে দেশে এখন খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা।
আইএমএফ এসব ঋণ অন্তর্ভুক্ত করেই খেলাপি ঋণের হিসাব করতে বলেছে সরকারের কাছে দেওয়া প্রতিবেদনে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, আইএমএফ যা বলছে, তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি না হয়ে দিন দিন শুধু খারাপই হচ্ছে। প্রভাবশালীরা ব্যাংকিং খাতকে তাদের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করছেন। নীতিনির্ধারণী পরিবর্তনও আনছেন। বাজার ব্যবস্থার পরিপন্থী অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সুদহারে ৬ ও ৯ শতাংশ, ২ শতাংশ জমা দিয়ে ঋণ পুনঃ তফসিল করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। গত ১০ বছরে ব্যাংক খাতের জন্য আসলে সহায়ক কোনো ভূমিকাই নেওয়া হয়নি।
আইন পরিবর্তন করে ব্যাংকগুলোকে একক পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আবার একটি পরিবার বেশ কয়টি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানির নামে বড় অঙ্কের ঋণ কয়েকজন গ্রাহকের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতের ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে।