দুর্যোগের এপ্রিলেই ঘূর্ণিঝড়-তাপদাহ

64

বাংলার খ্যাতিমান গীতিকবি শ্যামল গুপ্ত প্রেয়সীর চোখে বিপুল হাসি লুকায়িত রয়েছে ভেবে গানে লিখেছিলেন, ‘যে আঁখিতে এত হাসি লুকানো…’। কিন্তু চৈত্রের মাঝামাঝি এসে বিরাজমান প্রকৃতিতে ‘আঁখি’ নামে যে পূর্ণাঙ্গ বৃষ্টিবলয় সওয়ার হয়েছে তার দাপট কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তার আলামত ইতোমধ্যেই প্রত্যক্ষ করেছেন দেশের মানুষ। বছরের প্রথম এই পূর্ণাঙ্গ বৃষ্টিবলয় চট্টগ্রামসহ দেশের প্রতিটি অঞ্চলে কমবেশি বৃষ্টি নামিয়েছে। কালবৈশাখীর বজ্রঝড় ও শিলাবৃষ্টির ভয়াল রূপ দেখিয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ কয়েকটি অঞ্চলে। কেড়ে নিয়েছে তাজাপ্রাণ, উপ্ড়ে ফেলেছে গাছ-পালা, উড়িয়ে নিয়েছে ঘরের চালা। ক্ষতি করেছে আবাদি ফসলের।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, বিদ্যমান এই বৃষ্টিবলয়ের ‘চোখ রাঙানি’ আরও অন্তত দু-তিনদিন অব্যাহত থাকতে পারে। মাঝখানে ক্ষণিকের বিরতি দিয়ে কমবেশি সক্রিয় থাকতে পারে আগামী আট এপ্রিল পর্যন্ত। তা না হয় গেল! কিন্তু, আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি মেনে এপ্রিল মাসকে তো মহাদুর্যোগের তালিকায় ঠাঁই দেয়া হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী দুর্যোগের ঘনঘটা অব্যাহত থাকে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যেই বজ্রপাত, ভূমিধস ও ঝড়-জলোচ্ছ¡াসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের নানা ধরনে নাকাল হতে হয় দেশের সাধারণ মানুষকে। সেই দুর্যোগের এপ্রিলেই এবার হাল্কা থেকে মাঝারি ধরনের আরও অন্তত তিনটি কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যাওয়ার আলামত দেখছেন আবহাওয়াবিদরা। একইসাথে দেশের কোথাও কোথাও ভারি বৃষ্টিপাত এবং শিলাবৃষ্টির লক্ষণও তারা অনুভব করছেন। এছাড়া, পুরো মাসজুড়ে সাগরে দুটি নি¤œচাপ সৃষ্টি হতে পারে। যার একটি রূপ নিতে পারে ঘূর্ণিঝড়ে। এছাড়া, বিরূপ আবহাওয়ার এপ্রিলে চড়তে থাকবে পারদ। মাসের শেষে তা সর্বোচ্চ ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘর পেরিয়ে যেতে পারে। যার জেরে দেশের মধ্যাঞ্চলে একটি তাপদাহ বয়ে যাওয়ার শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন তারা। প্রসঙ্গত, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ ও গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণকারী বেসরকারি সংস্থাগুলো এবারের বৃষ্টিবলয়ের নাম রেখেছে ‘আঁখি’।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মো. আবুল কালাম মল্লিক পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমাদের দেশে এপ্রিল মাসে আবহাওয়া বিরূপ থাকে এবং তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়। কয়েকবছর ধরে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড হচ্ছে এপ্রিলে। এবছরও তা অব্যাহত থাকতে পারে। বৃষ্টিপাত ছাড়াও এ সময় সমুদ্রে দু-একটি নিম্নচাপের সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। এই মাসে দেশের উত্তর মধ্যাঞ্চলের ওপর দিয়ে দাবদাহ বয়ে যেতে পারে। কোথাও কোথাও এ দাবদাহের প্রভাবে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠে যেতে পারে।’
অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত রবিবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকেই দেশের অধিকাংশ জেলায় ভারী বৃষ্টি হয়েছে। গতকাল সোমবারও তা অব্যাহত ছিল। গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি ৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে কুমিল্লায়। সবচেয়ে কম এক মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে খুলনার কুমারখালীতে। এছাড়া, সমুদ্রবন্দরগুলোতে জারি করা দুই নম্বর নৌ-হুঁশিয়ারি সঙ্কেতের সময়কাল আজ মঙ্গলবার সকাল নয়টায় শেষ হচ্ছে। গত রবিবার আঘাত হানা কালবৈশাখী ঝড়ের সময় ঘণ্টায় বাতাসের গতিবেগ ছিল ৭৪ কিলোমিটার। প্রতিঘণ্টায় বাতাসের গতিবেগ ৬০ কিলোমিটারের উপরে থাকলে সেটি কালবৈশাখী ঝড় হিসেবে বিবেচনা করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ওই ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি, বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টি হয়েছে। ঢাকায় ৩৮ মিলিমিটার, ময়মনসিংহে ১৭ মিলিমিটার, চট্টগ্রামে ২৬ মিলিমিটার, সিলেটে ১৪ মিলিমিটার, রাজশাহীতে ২৫ মিলিমিটার, রংপুরে ৩৮ মিলিমিটার, খুলনায় ১৪ মিলিমিটার এবং বরিশালে ১১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে ওয়েবসাইটে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘন্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ী দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। আবহাওয়ার সিনপটিক অবস্থা বা দৃশ্যপটে বলা হয়েছে, পশ্চিমা লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে।
এর আগে অধিদপ্তরের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, এপ্রিলে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দুটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়ে তার মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। তবে, গতবছর একই সময়ে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসেই ওঠানামা করেছে। উল্লেখ্য, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের আবহাওয়াবিদরা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রাকে তীব্র তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মাঝারি এবং ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদু তাপপ্রবাহ হিসেবে গণনা করেন।