দুর্বল হচ্ছে সম্পর্কের বন্ধন

124

মা-বাবা, সন্তান-সন্ততি কিংবা স্বামী-স্ত্রীর মত প্রিয়জনদের সম্পর্কের বন্ধন দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে সন্তানের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় মায়ের কোল যেমন বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, তেমনি মাদকাসক্ত সন্তানের হাত রঞ্জিত হচ্ছে সবচেয়ে আপনজন মা-বাবার রক্তে। ব্যক্তির নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় আর মাদক ও প্রযুক্তিসহ নানা বিষয়ে আসক্তিই পারিবারিক-সামাজিক ও আত্মীয়তার পরম বন্ধনকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে দিচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত নয় মাসে নগরীতে সংঘটিত ডাবল-মার্ডারসহ একাধিক হত্যাকান্ডের নেপথ্যে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় আর আসক্তিই অন্যতম কারণ হিসেবে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
অনৈতিকতার কাছে নৈতিক সম্পর্ক হেরে যাওয়ার সর্বশেষ ভয়ঙ্কর ঘটনাটি ঘটে গত ১৯ অক্টোবর। ওইদিন সকাল সাড়ে ১১টার দিকে খবর পেয়ে নগরীর বন্দর থানার নিমতলা এলাকার শাহ আলম ভবনে যায় পুলিশ। সেখানে নিচতলার একটি বাসায় দুজনের রক্তাক্ত মরদেহ পাওয়া যায়। নিহত দুজন হলেন, গৃহকর্তা গুদাম শ্রমিক মো. আবু তাহের (৩৫) ও তার সাড়ে তিনবছর বয়সী মেয়ে ফাতেমা নুর। তাদের বাড়ি নোয়াখালীর বসুরহাট উপজেলার চরকাঁকড়া গ্রামে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গৃহকর্ত্রী হাছিনা বেগমসহ দুই নিকটাত্মীয়কে নিজেদের হেফাজতে নেয় পুলিশ। পরে হাছিনাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে অপর দুইজনকে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। নিহত আবু তাহেরের বড় ভাই নুর আলম বাদি হয়ে বন্দর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, ঘটনার দিন সকাল সাড়ে আটটার দিকে তাহের নিজের বাসা থেকে বাইরে বের হন। তিনি বেরিয়ে যাবার পর পাশের কক্ষের বাসিন্দা কন্টেনার ডিপোর শ্রমিক-সর্দার মাইন উদ্দিন তার বাসায় ঢোকেন। এরপর মাইন উদ্দিন গৃহকর্ত্রী হাছিনার সাথে অনৈতিক মেলামেশায় লিপ্ত হন। শিশুকন্যা ফাতেমা তা দেখে ফেললে বাবাকে বলে দেয়ার কথা জানায়। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে মাইন উদ্দিন শিশুকন্যা ফাতেমার হাত-পা চেপে ধরেন এবং মা হাছিনা ছুরি দিয়ে নিজের কন্যশিশুকে জবাই করেন। হত্যার পর দুইজন মিলে শিশুকন্যার লাশ খাটের ওপর চাদর মুড়িয়ে রেখে দেন। দুইজন একইকক্ষে বসা অবস্থায় কিছুক্ষণ পর গৃহকর্তা আবু তাহের বাইরে থেকে বাসায় ফেরেন। আর বাসায় ঢোকামাত্রই তাকে ঝাপটে ধরেন মাইন উদ্দিন ও হাছিনা। এরপর গলায় রশি দিয়ে পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করেন। তাহের নিস্তেজ হয়ে পড়লে তার পেট ও মাথায় ছুরিকাঘাতের পাশাপাশি গলা কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। হত্যাকাÐের পর হাছিনা বেগম বাসায় অবস্থান করলেও নোয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে পালিয়ে যান মাইন উদ্দিন।
জিজ্ঞাসাবাদে হাছিনার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওইদিন দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে নোয়াখালী সদর থেকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। পরদিন দুইজনই হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার পর তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়।
নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বা অনৈতিক সম্পর্কের কারণে প্রিয়জন হত্যার মত বীভৎস ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে উল্লেখ করে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আমেনা বেগম পূর্বদেশকে বলেন, মূল্যবোধের চর্চার অভাব আর নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়ার কদর্য রূপ হল এই ডাবল মার্ডার। লোভ-লালসাকে চরিতার্থ করতে গিয়ে মানুষ তার সীমাকে অতিক্রম করে রীতিমত দানবে পরিণত হচ্ছে। অনৈতিকতার চর্চা পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের বন্ধনকে কোথায় নিয়ে
যাচ্ছে তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। এতটা অধঃপতন মেনে নেওয়া যায় না।
অপরদিকে, মাদক ও প্রযুক্তিসহ নানা বিষয়ে আসক্তিও হত্যাকান্ডের মত হৃদয়বিদারক ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। আসক্তরা প্রিয়জনদের গলায় ছুরি চালাতে দ্বিধা করছেন না। ভাঙছে সংসার। এমনকি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হচ্ছে ঘরবাড়ি। বস্তি থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পরিবারে অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সর্বনাশা এসব আসক্তি।
গত নয় মাসে নগরে মাদকাসক্ত ব্যক্তির হাতে ছয়টি খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে গত ১৪ এপ্রিল নগরীর কাজীর দেউড়ি এলাকায় বাবা রঞ্জন বড়ুয়াকে ছুরিকাঘাতে খুনের মামলায় ছেলে রবিন বড়ুয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
রবিনের চাচা সঞ্জয় বড়ুয়া জানান, ছয় বছর ধরে মাদকাসক্ত রবিন টাকার জন্য তার বাবাকে মারধর করতেন। চাহিদামত টাকা না দেয়ায় ছুরিকাঘাতে বাবাকে খুন করেন তিনি।
গত ১৭ এপ্রিল নগরীর চান্দগাঁও খরমপাড়ায় ছোট ভাইয়ের হাতে খুন হন আপন বড় ভাই। ছোট ভাই মুন্না তার বড় ভাইয়ের কাছে দশটি ইয়াবা রাখতে দেন। কিছুক্ষণ পর ইয়াবাগুলো ফেরত চাইলে তা সেবন করার কথা জানান বড় ভাই সাজু। এ নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে ছোটভাই মুন্না ছুরিকাঘাত করেন সাজুকে। ঘটনাস্থলেই খুন হন সাজু।
গত ১০ মে রাত দশটার দিকে কাট্টলীর কালীবাড়ি এলাকায় মাদকাসক্ত যুবক সত্যজিৎ ঘোষের এলোপাতাড়ি দায়ের কোপে সন্ধ্যা রানী নামের তার এক প্রতিবেশী নিহত হন। এসময় আহত শান্তি নন্দী চিকিৎসাধীন অবস্থায় কয়েকদিন পর মারা যান।
গত ১১ মে রাতে বাসায় ঢুকে বাকলিয়া বলিরহাট এলাকায় বুবলি আক্তার নামের এক নারীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ভাই মো. রুবেলকে না পেয়ে বুবলিকে গুলি করা হয়। মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছে রাখতে শাহ আলম নামের এক মাদক ব্যবসায়ী ওই হত্যাকান্ড ঘটান। সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজে শাহ আলমকে দুই হাতে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে রুবেলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। হত্যাকান্ডের পর ওই রাতেই পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান শাহ আলম।
গত ২ মে প্রযুক্তি ও মাদকাসক্ত তরুণ মো. সোহেল কোরবাণীগঞ্জে নিজের মামার বাসায় গিয়ে মামীর কাছে টাকা দবি করেন। টাকা না দেয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে বাসার ভেতরেই মামী রোকসানা আক্তারকে হত্যা করেন। মামাতো ভাই বাসার অদূরে মসজিদে নামাজ আদায় করে ফিরলে দরজা খুলতেই তাকেও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করে ঘর থেকে বেরিয়ে যান সোহেল। রাতে তাকে কর্ণফুলী এলাকার একটি বাসা থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন। রোকসানা খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী আবুল কাশেমের স্ত্রী।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ব বিভাগের অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ কুন্ডু বলেন, মাদকের মত প্রযুক্তি-আসক্তিও ভয়ংকর হতে পারে। এ দুটির সাথে আন্তর্জাতিক, দেশিয় রাজনীতি ও অর্থনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এসবের উৎস ও বিপণনের মত জায়গায় রাষ্ট্রকে যেমন কঠোর হতে হবে, তেমনি ব্যবহারকারী ও তার অভিভাববকদের হতে হবে সতর্ক-সচেতন। যে কোন আসক্তি থেকে নিরাময়ের জন্য সুব্যবস্থা রাখতে হবে। মাদকের মত প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে মানবিকতা ভুলে মানুষও দিন দিন আত্মকেন্দ্রিক ও নিষ্ঠুর হয়ে পড়ছে। মানবিকহীন করে তুলছে পরস্পরকে। প্রযুক্তির অতিমাত্র ব্যবহার মানুষের চিন্তা-চেতনার যে মৌলিকত্ব সেটি নষ্ট করে দিচ্ছে। এমনকি, ভার্চুয়ালিটি কিছু মানুষকে বাস্তবতাবিমুখ করে হিংস্র ও রক্ষণাত্মক বানিয়ে ফেলছে। এতে আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। মুক্তবুদ্ধি ও শিল্প সংস্কৃতির চর্চা হোঁচট খাচ্ছে। যোগ্যতা অনুযায়ী অপরকে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে মানুষ।