দুর্নীতিমুক্ত সমাজ দেখাতে হবে প্রজন্মকে

41

সমাজের সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিমুক্ত বলে বলা যাবে না। সমাজ ও রাষ্ট্রকে চালাতে হলে একটা শৃঙ্খলাপূর্ণ প্রশাসন দরকার হয়। যে সরকার দেশ পরিচালনা করে সে সরকার প্রশাসনকে সঠিক নিয়মে পরিচালিত করার কথা। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর হতে অদ্যাবধি দেশ পরিচালনায় প্রশাসনিক দপ্তর রয়েছে। এসব দপ্তর দেশের মানুষের নাগরিক, সামাজিক, মানবিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করে থাকে। সবগুলো দপ্তরের কর্মচারি কর্মকর্তা নিজেদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে তারা দায়িত্ব পালন করে। নাগরিক দায়িত্ব আর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে পালনের জন্য রাষ্ট্রীয় এসব কর্মকর্তা কর্মচারিদের বেতন ভাতা, বোনাস ও নানা সুবিধা জনগণের পক্ষে রাষ্ট্র বহন করে থাকে। এসব কর্মকর্তা কর্মচারি জনগণের সেবক। জনগণের কষ্টার্জিত টেক্সের টাকায় তাদের বেতন ভাতা ও নানা সুবিধা দেয়া হয়। প্রতিবছর রাষ্ট্রীয় বাজেটের বিশাল একটি অংশ প্রশাসনের কর্মচারিদের পেছনে ব্যয় করতে হয় রাষ্ট্রকে। এটা না করলে নাগরিক ও জাতীয় শৃঙ্খলা থাকে না, তাই এ খরচ করতে হয়।
প্রশাসন ছাড়া একটা সমাজ, দেশ চলতে পারে না। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে, প্রশাসনকে দোষারোপ করে কথা বলার ইচ্ছা নয়। প্রশাসন জনগণ আর রাষ্ট্রের সমন্বয়ে একটা দেশ ঠিকে থাকে। এখানে কথা হলো আমাদের দেশের সবগুলো সরকারি প্রশাসন কতটুকু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্যে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করছে। প্রশাসন ছাড়া নাগরিক জীবন যাপন অচল। সামাজিক কর্মকাÐ ব্যক্তি পরিবার নানাকাজে প্রশাসনের দ্বারস্থ হতে হয় জনগণকে। দ্বারস্থ হওয়ার জন্যেই প্রশাসন, আর প্রশাসনই নাগরিক সমস্যার সুরাহা করবে। সমস্যাটা সেখানেই জট তৈরি করেছে। প্রশাসনের কাছে একজন নাগরিক তার নানা প্রয়োজনে গেলেই নতুন করে আরেকটি সমস্যা তৈরি হয়, সেটি হলো অতিরিক্ত ঘুষ আর ভোগান্তি।
বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি বেসরকারি স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে প্রশাসনের সবগুলো সেক্টরে সুবিধামতো যার যার মতো করে অনৈতিক ঘুষ গ্রহণ করছে। বাংলাদেশে পাসপোর্ট অফিস ও ভূমি অফিসের কথা অনেকের লেখালেখির মধ্যে বেশি আসলেও আসলে কোনো সেক্টরই এ ঘুষ ও দুর্নীতি থেকে মুক্ত নয়। এ জায়গায় বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর হতে অদ্যাবধি যারা দেশ পরিচালনা করেছে, তাদের ওপর দোষ চাপিয়ে কথা বলার উদ্দেশ্য নয়। দুর্নীতি, ঘুষ প্রথা স্বাধীনতার পর হতে ধীরে ধীরে চলে আসছে। দুর্নীতির মাধ্যমে অতীত সরকারের অনেক রাঘববোয়াল শাস্তি ভোগ করছে। অনেকের পদ পদবী চলে গেছে। সে ধরনের নজিরও বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে বিচার জনগণ দেখে আসছে। তবে এ বিচার ও নজির অপরাধের তুলনায় একেবারে সামান্য।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক সেক্টরে যে পরিমাণ ঘুষ আর দুর্নীতি জগদ্দল পাথরের মতো বাসা বেঁধেছে যেকোনো মূল্যে এ সংস্কৃতি হতে প্রজন্মকে উদ্ধার করতে হবে। বছর তিনেক পূর্বে বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারিদের বেতন ভাতা প্রায় আশি ভাগ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ বেতন বৃদ্ধির অনেক সমালোচনা সুশীল সমাজে হয়েছিল। তবুও রাষ্ট্র সরকারি কর্মচারিদেরকে জনগণের প্রতি সেবা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে বেতন ভাতা বৃদ্ধি করা হয় বলে তখন বলা হয়েছিল। বেতন ভাতা বৃদ্ধির ফলে অপরাপর জনগণের জনজীবনে অস্বস্তি হলেও রাষ্ট্র সেদিকে তাকায় নি। কিন্তু এতো সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে দিয়েও বাস্তবে প্রশাসন থেকে ঘুষ দুর্নীতি আদৌ কি বন্ধ হয়েছে? মোটেও না।
প্রশাসনিক সরকারি একটা চাকরি পেতে হলে পিয়ন থেকে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ পর্যন্ত কয়েক লক্ষ টাকার ঘুষের টাকার লেনদেন হওয়ার সংবাদ এদেশের জনগণ সূর্যের আলোর মতো অবগত আছে। যারা চাকরিতে প্রবেশের সময় ঘুঘ আর দুর্নীতির পন্থায় চাকরি পায়, আর সে শিক্ষায় তারা তাদের কর্মস্থলে ঘুষের লেনদেনে অভ্যস্থ হয়ে উঠে। ঘুষ ছোট চেয়ার থেকে বড় চেয়ার পর্যন্ত সম্প্রসারিত একটি কালচার। এ কালচার এখন সমস্ত অফিস আদালতে জনভোগান্তির অন্যতম কারণ। জনগণ রন্ধ্রে রন্ধ্রে এটা অনুভব করলেও কিন্তু জনগণকে সে ঘুষের মাধ্যমে চলতে হচ্ছে। বলা যায়, সরকারি কোনে দপ্তরে সরকারের প্রয়োজনীয় বৈধ খরচের বাইরে জনগণকে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে কাজ করতে হবে এবং সাথে অহেতুক অযৌক্তিক হয়রানি ভোগ করতে হবে। এটা এখন আমাদের সমাজে প্রচলিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। তাহলে রাষ্ট্রের জনগণের কষ্টার্জিত টেক্সের টাকা দিয়ে রাষ্ট্রীয় কর্মচারিদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করে জনগণের কি লাভে আসল। কোনো লাভই আমি দেখছি না। বরঞ্চ বেতন ভাতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ঘুষের টাকার পরিমাণ বেড়ে গেছে। সরকারি খাজনা থেকে কর্মচারিদের ঘুষের বাজনা অনেক বেশি। বলা যায়, সরকারি খাজনা না দিলেও ঘুষের বাজনা জনগণকে দিতেই হবে। না হয় তার কাজ, তার ফাইল সেটা টেবিলের নিচে পড়ে থাকবে। ফাইল নড়াচড়া করবে না। কোনো সদুত্তরও সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে মিলবে না। আজব এক প্রশাসনের যন্ত্রণা জনগণ সারাক্ষণ এক ভয়ানক অস্থিরতার মধ্যে জীবন পার করছে। আমাদের দেশের পাশে আরো দেশ আছে। সেখানেও নানা কাজকর্মে এদেশের জনগণ গিয়ে থাকে।
পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে পৃথিবীর নানাদেশে এদেশ থেকে যারা ভ্রমণ করে তাদের বক্তব্য হলো, বাংলাদেশের প্রশাসনের মতো এতো লোভী এবং দুর্নীতিবাজ পৃথিবীর কোনো দেশেই দেখি নি। বাংলাদেশের প্রশাসনিক কর্মচারিদের দুর্নীতির সাথে পৃথিবীর কোনো দেশের মিল পাওয়া যাবে না। তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিবুর রহমান, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এদেশকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এজন্যেই কি স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন? কখনো নয়। শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন এবং এ জাতিকে সার্বিকভাবে পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্যেই তিনি এ জাতিকে স্বাধীন করে দিয়েছেন। তাঁর রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে যারা এদেশকে দুর্নীতিগ্রস্থ সমাজে পরিণত করছে তাদের উপর অবশ্যই একদিন খারাপ পরিণতি অপেক্ষা করছে।
দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় ছিলো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। আজকে সে স্বপ্নকে যারা বার বার দুর্নীতির মাধ্যমে ধুলিসাৎ করছে, তাদের এ জাতি কখনো ক্ষমা করবে না। বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী, প্রধানমন্ত্রী বর্তমান সময়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে অভিযান চালাচ্ছে, তার প্রতি দেশের ১৮ কোটি মানুষের অকুন্ঠ সমর্থন রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর নানা বক্তব্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে ইঙ্গিত দিচ্ছেন, ইনশাআল্লাহ এদেশে দুর্নীতি আর ঘুষ বেশিদিন স্থায়িত্ব হবে না। যেখানেই ঘুষ দুর্নীতি সেখানেই অভিযান দেখতে চায় জনগণ। দুর্নীতিবাজ প্রশাসনিক কর্মচারিদের গোপনে তালিকা তৈরি করে তাদের চাকরিচ্যুত করুন। এদেশে চাকরি করার মতো কয়েক কোটি শিক্ষিত বেকার বসে আছে। ঘুষ আর দুর্নীতি ছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের চাকরির ব্যবস্থা করুন।
এলাকায় এলাকায় জেলায় জেলায় আপনি তালিকা তৈরি করে বেকার শিক্ষিত যুবকদের চাকরি দিন। এবং তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে তৈরি করুন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলাদেশ এ জাতিকে আপনি উপহার দিতে পারেন। আপনার সাহসী পদক্ষেপ কর্মসূচি পরিকল্পনা অবশ্যই এ জাতির সার্বিক সফলতা বয়ে আনবে। আপনি ঘুষ দুর্নীতি বন্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর নির্দেশনা প্রদান করুন। জাতি ও প্রজন্ম আপনার সাথেই আছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক