দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ৮শ’ শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন অনিশ্চিত

50

আছে শিক্ষক, আছে শিক্ষার্থী, অপ্রতুল হলেও আছে অবকাঠামোগত সুবিধা। শুধু নেই, শিক্ষকদের বেতন ও ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তির ব্যবস্থা। এ নিয়ে চরম হতাশাগ্রস্ত শিক্ষকেরা বিদ্যালয় ছেড়ে চলে গেলে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বান্দরবানের লামা উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকার চারটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৮০০ শতাধিক শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন। নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত দূর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের শিশুদের জন্য এ চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া আশপাশ পাঁচ কিলোমিটারের এলাকার মধ্যে আর কোন বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। প্রতি বছর সরকারিভাবে বিনামূল্যের বই ছাড়া আর কোন সুযোগ সুবিধাই পাচ্ছে এ বিদ্যালয়গুলো। এ অবস্থা থেকে উত্তোরনে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপির হস্তক্ষেপ কামনা করেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও তিন ইউনিয়নবাসী। সূত্রে জানা যায়, উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বিদ্যালয়বিহীন পাড়া ও গ্রামের কোমলমতি ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতের জন্য স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ও অধিবাসীরা নিজেদের অর্থায়নে চারটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০১ সালে লামা পৌরসভার নুনারঝিরি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২০০০ সালে লামা সদর ইউনিয়নের মিরিঞ্জা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৯৯৮ সালে সরই ইউনিয়নের ধুইল্যা পাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ২০১১ সালে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের কমিউনিটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। যেসব এলাকায় বিদ্যালয়গুলোর অবস্থান, সেসব এলাকার মানুষগুলো একেবারেই হতদরিদ্র। তারা দিনে এনে, দিনে খান বললেই চলে। এ চারটি বিদ্যালয়ে বর্তমানে ৮০০ শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী লেখপড়া করছে। এসব বিদ্যালয়ে আবার ১৬ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাও কর্মরত আছেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিনা বেতনে এ শিক্ষকরা পাঠদান করে আসছেন। বছরের পর বছর স্বেচ্ছাশ্রম দিতে গিয়ে বর্তমানে মানবেতর দিন যাপন করছেন শিক্ষক পরিবারগুলো। মিরিঞ্জা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র মেন্নাই মুরুং জানান, আমার বাবা গরীব। জুম চাষ করে কোন মতে সংসার চালান। অন্য বিদ্যালয়ের যারা পড়ালেখা তারা সবাই উপবৃত্তি পায়। আমরা পাইনা। তাই মাঝে মধ্যে লেখাপড়া খরচ চালাতে বাবার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। উপবৃত্তি পেলে পড়ালেখা চালাতে সুবিধা হত। একই কথা জানায় ধুইল্যাপাড়া বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির ছাত্র নুরুল হাকিম, ছাত্রী কুলসুমা আক্তার। অভিভাবক আলী হোসেন, আবদুল মালেক, সমছুল ইসলাম ও মো. সৈয়দ বলেন, শিক্ষকরা আর বিনা বেতনে ছেলে মেয়েদের পড়াতে চাচ্ছেনা। তারা চলে গেলে ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়ে কাজে লাগিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবেনা। সরকারী বিদ্যালয়ের মত সব সুযোগ সুবিধা আমাদের বিদ্যালয়েও দেওয়ার জন্য পার্বত্য মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি ও সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি। ধুইল্যাপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জসিম উদ্দিন, সহকারী শিক্ষক নাছিমা আক্তার ও শমসু আলম বলেন, বিদ্যালয়গুলি সরকারি না হওয়ায় আমরা যেমন মানবেতর জীবন যাপন করছি, তেমনি ছাত্র-ছাত্রীরাও দিন দিন ঝরে পড়ছে। এমতাবস্থায় সরকারি বা বেসরকারি সহযোগিতা ফেলে বিদ্যালয় গুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের যেমন ঝরে পড়া রোধ হবে, তেমনি শিক্ষকেরাও মানবেতর জীবন-যাপন থেকে মুক্তি পাবেন। কমিউনিটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক আব্দুস সোবাহান জানান, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সম্পূর্ণ বিনা বেতনে শিক্ষার্থীদের মাঝে পাঠদান দিয়ে যাচ্ছি। অথচ সরকারি কোন সুযোগ-সুবিধা বিদ্যালয়গুলো পাচ্ছে না। মেরেঞ্জা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল হামিদ বলেন, আমরা বছরের পর বছর দূর্গম পাহাড়ী এলাকার কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছি। অথচ আমাদের বিদ্যালয়গুলো আজও পর্যন্ত সরকারি করণের আওতায় আসেনি। নুনারঝিরি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সৈয়দা শাহনাজ পারভীন জানান, রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে বিনামূল্যে নিয়মিত পাঠদান দিতে গিয়ে আমরা মানবেতর জীবন-যাপন করছি। অথচ আমরা সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি না। তাই আমরা শিক্ষাবান্ধব সরকারের কাছে সহযোগিতা কামনা করছি। ধুইল্যা পাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সদস্য ইদ্রিস কোম্পানি জানান, এলাকার বিদ্যালয়গুলো সরকারি সহযোগিতা পেলে মানোন্নয়ন দিন দিন বৃদ্ধি পাবে এবং টিকে থাকবে। তা না হলে কোমলমতি শিক্ষার্থীগুলোর শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। কারণ এসব এলাকার মানুষগুলো হত দরিদ্র। তাদের পক্ষে ছেলে মেয়েকে উপজেলা সদর দূরে থাক, ইউনিয়ন সদরে রেখেও পড়ালেখা করার মত সামর্থ নেই। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা না পাওয়ায় ৮শ শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন অনিশ্চিতের সত্যতা স্বীকার করে লামা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা তপন কুমার চৌধুরী জানায়, জাতীয়করণের তালিকা থেকে বাদ পাড়া চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিইসি পরীক্ষায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করে শতভাগ পাশও করছে। বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণ করা খুবই দরকার। এ বিষয়ে লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুর-এ-জান্নাত রুমি জানান, পিছিয়ে পড়া পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর ছেলে-মেয়ের শিক্ষা নিশ্চিত করণের জন্য এ চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন।