দুদিন আগেও সব ছিল এখন তারা উদ্বাস্তু!

10

ওয়াপদার ওপর খুলে রাখা ঘরের একটি চালের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ৮৩ বছরের বৃদ্ধ আব্দুল আজিজ। যমুনার ভাঙন থেকে এই চালটিই কোনোমতে বাঁচিয়ে আনতে পেরেছিলেন তার ছেলেরা। চালটিকে পাহাড়া দিচ্ছেন তিনি।
ওয়াপদার ওপর একপাশে বসে রয়েছেন কমেলা বেগম, ফতেমা খাতুন, বিউটি খাতুনসহ কয়েকটি পরিবারের গৃহবধূরা। অদূরে বাঁধের ঢালে আছেন সুমি খাতুন, আঙ্গুগুরি বেগমসহ আরও কয়েকজন নারী। যমুনার গ্রাস থেকে কোনোমতে বাঁচিয়ে ফেরানো অবশিষ্ট আসবাবপত্র পাহাড়ায় রয়েছেন তারা। আব্দুল আজিজ, আব্দুল মজিদ, রাজ্জাক ভূঁইয়া, রফিকুল ইসলাম, আব্দুল কুদ্দুস, দেলশাদ আলীসহ শত শত পরিবারের নারীরা ওয়পদা বাঁধে দাঁড়িয়ে বা বসে রয়েছেন। এসব পরিবারের পুরুষরা ব্যস্ত রয়েছেন আসবাবপত্র গোছাতে।
বাঁধের ওপর আশ্রয়হীন মানুষগুলো ব্যস্ত রয়েছেন নানা কাজে। কেউ বা ঘরের চাল মাথায় করে বা ভ্যানে করে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, কেউবা চৌকি/আলমিরা সরাচ্ছেন, আবার কেউ বা বিভিন্ন আসববাপত্র মাথায় নিয়ে হেঁটে চলছেন পরবর্তী আশ্রয়স্থলে। আর ভাঙনে স্বর্বস্ব হারানো মানুষগুলো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে এসব দেখছেন, থেমে থেমে আহাজারিও করছেন।
শনিবার (২৫ জুলাই) দিনভর সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ছোনগাছা ইউনিয়নের পাঁচঠাকুরী ওয়াপদা বাঁধ এলাকার চিত্র ছিল ঠিক এমনটাই। সকাল থেকে বিকেল গড়িয়ে গেলেও এদের অনেকেরই জোটেনি আহার। আবার অনেকেই আত্মীয়-স্বজনদের আনা খাবার খেয়েছেন। অথচ চব্বিশ ঘণ্টা আগেও এদের বাড়ি ছিল-ঘর ছিল, গোয়ালে গরু, ছাগল, হাস-মুরগি ছিল। এখন তারা উদ্বাস্তু। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাদের পরবর্তী আশ্রয় কোথায় হবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। খবর বাংলানিউজ
ভাঙন কবলিত ছাড়াও হাজারও মানুষের সমাগম দেখা যায় ওয়াপদা বাঁধে। করোনার ভয় উপেক্ষা করে বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে আসা মানুষ নদীভাঙনে অসহায় হয়ে পড়া মানুষগুলোকে সমবেদনা জানানোর ভাষাও খুঁজে পাচ্ছে না।
কথা হয় ভাঙনে স্বর্বস্ব হারানো বৃদ্ধ আব্দুল আজিজের সঙ্গে। তিনি বলেন, আট শতক জমির ওপর বাড়ি ছিল, ঘর ছিল, গরু-ছাগল, গাছপালা ছিল। দু-তিন ঘণ্টার ব্যবধানে সব নদীগর্ভে চলে গেছে।
জহুরুল ইসলাম বলেন, কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ৬ হাজার মুরগিসহ খামারটি গিলে নিল রাক্ষস যমুনা। সেইসঙ্গে বাড়িঘর সবই চলে গেল। এখন আমি নিঃস্ব, উদ্বাস্তু। আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া বললেন, একটি বড় ট্রাংক, আর কিছু কাপড়চোপর ছাড়া কিছুই সরাতে পারিনি। ওমর আলীর অবস্থাও একই।
ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, শুক্রবার সকাল থেকে হঠাৎ করেই যমুনায় ভাঙন শুরু হয়। একের পর এক ভাঙতে থাকে বাড়ি। ঘর, গাছপালা ভেঙে ধসে যেতে থাকে। স্বজনদের জীবন নিয়ে কোনোমতে বাড়িঘর-সম্পত্তি ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ে যায় পরিবারগুলো। যমুনার সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছেন, এটাও অনেকের ভাগ্য বলেই মনে হয়।
ভাঙনের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতিকে দায়ী করে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো বলেন, অনেক আগে থেকেই সিমলা স্পারে ধস দেখা দেয়। তখন থেকেই জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিলে এই ভাঙন দেখা দিতো না, আমরাও নিঃস্ব হতাম না।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য তারিকুল ইসলাম জানান, প্রায় ৭০টি পরিবারের মানুষ বাড়িঘর সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। এসব পরিবার এখন উদ্বাস্তুর মতো ওয়াপদার ওপরে রয়েছে। নতুন আশ্রয়ের সন্ধান করছেন তারা। এছাড়াও আড়াইশর ওপরে মানুষ ঘরবাড়ি সরিয়ে নিতে পেরেছেন। তাদের বসতভিটাও নদীগর্ভে চলে গেছে।
ছোনগাছা ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল আলম বলেন, শুক্রবার দুপুর থেকে হঠাৎ করে শুরু হয় ভাঙন। এ রকম নদী ভাঙন আগে কখনও দেখিনি। মুহুর্তের মধ্যেই শতাধিক বাড়ি-ঘর, মসজিদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। বাঁধের ওপর আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলোর মধ্যে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, সিমলা স্পার দেবে যাওয়ায় যমুনার ¯্রােত ঘুরে সরাসরি বাঁধে আঘাত হানে। এ কারণে হঠাৎই ভাঙন শুরু হয়। এতে বেশকিছু পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।