দুদকের কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতার কাঁটা

66

দুর্নীতির লাগাম টানতে গিয়ে দুর্নীতিবিরোধী একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)- এর গলায় যেন দীর্ঘসূত্রতার কাঁটা বিঁধেছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে অভিযান পরিচালনা এবং মামলায় অভিযুক্তদের সাজা নিশ্চিত করাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সাফল্য পেলেও বিদায়ী বছরে তদন্তাধীন মামলার চার্জশিট দাখিল ও বিচারাধীন মামলা নিষ্পত্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে হতাশার বার্তাই দিয়েছে দুদক। নতুন বছরের শুরুতে দুদকের প্রকাশিত বিদায়ী বছরের মামলাসংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
তবে অভিযোগ গ্রহণ থেকে শুরু করে মামলা নিষ্পত্তি পর্যন্ত ধারাবাহিক ধাপগুলোতে বিরাজমান দীর্ঘসূত্রতাজনিত সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার কাজ আরও আগেই শুরু করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন দুদকের লিগ্যাল এন্ড প্রসিকিউশন অনুবিভাগের উপ-পরিচালক (প্রসিকিউশন) সাবরিনা নার্গিস। পূর্বদেশকে তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষের মনে দুদক সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। এক সময় নাগরিকদেরকে দুদক কার্যালয়ে সশরীরে এসে অভিযোগ জানাতে হত। এখন তো দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকেই দুদকের হটলাইনে কল করে বিনাখরচে দুর্নীতির অভিযোগ করা যায়। এটাই সবচেয়ে সহজ ও দ্রæততম ব্যবস্থা। তেমনি বিলুপ্ত ব্যুরোসহ কমিশনের কার্যক্রমের গোড়ার দিকে দুদকের মামলার আসামিদের শাস্তি নিশ্চিতের হার ছিল খুবই কম। ধাপে ধাপে আমরা সেটাকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করেছি। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারসহ নানা ক্ষেত্রে দুদক যেমন তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে, তেমনি আমাদের চলমান কার্যক্রমে দুদক সম্পর্কে মানুষের মনে প্রচলিত ধারণারও পরিবর্তন ঘটছে। হয়তো নানা ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত মাত্রা অর্জন সম্ভব হয়নি। সেক্ষেত্রে, কারণগুলো চিহ্নিত করে প্রতিবন্ধকতা দূর করারও চেষ্টা চলছে। নানা খাতে রাষ্ট্রে প্রচলিত বিধিবিধানের মতই দুর্নীতি দমনেও আমাদেরকে বিদ্যমান আইন ও বিচারব্যবস্থাকে অনুসরণ করতে হয়। তবে, দুদক অভীষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনের পথেই হাঁটছে।’
অবশ্য দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা অনুসরণ করে দুদক বিদায়ী বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে জনগণের আস্থা অর্জনে অভিযান জোরদার করা ও দুর্নীতির উৎস বন্ধে ২৫টি প্রাতিষ্ঠানিক টিমের সুপারিশ বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগী হয়েছে। এছাড়া, এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম চালুর মাধ্যমে ফাঁদ পেতে ঘুষখোর ধরা ও সচেতনতা তৈরিসহ প্রতিরোধের বিভিন্ন কাজে সারাবছরই নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে সংস্থাটি।
পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিদায়ী ২০১৮ সালে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভিযান বৃদ্ধি ও ধারাবাহিকভাবে মামলায় সাজার হার ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও তদন্ত সম্পন্ন করে মামলার চার্জশিট দাখিলের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। তেমনি বিচারব্যবস্থায় বিরাজমান দীর্ঘসূত্রতা থেকেও যথারীতি বেরিয়ে আসা যায়নি। নিম্ন আদালতে যেমন মামলার বিচার নিষ্পত্তির হার কমেছে, তেমনি উচ্চ আদালতে ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যাও নিয়মিত হারে বেড়েছে। বিদায়ী বছরে নি¤œ আদালতে কমিশনের বিচারাধীন মামলা ছিল দুই হাজার আটশ’টি। আর বিলুপ্ত ব্যুরোর মামলা পাঁচশ’ ৯৭ টি। কমিশনের মামলার মধ্যে বিচার চলমান মামলা ছিল দুই হাজার চারশ ৯৪ টি। ব্যুরোর তিনশ’ ৩৮ টি। স্থগিতাদেশের কারণে কমিশনের তিনশ’ ছয়টি এবং ব্যুরোর দুইশ’ ৫৯ টি মামলার বিচার কাজ বন্ধ ছিল। বছর শেষে দেখা গেছে, নি¤œ আদালতে কমিশনের দুইশ’ নয়টি মামলার বিচার নিষ্পত্তি হয়েছে। যার মধ্যে একশ’ ৩১ টিতে আসামির সাজা হয়েছে। অভিযুক্তরা খালাস পেয়েছে ৭৮ টি মামলায়। একইভাবে ব্যুরোর নিষ্পত্তি হওয়া ৪০ টি
মামলার মধ্যে ২০টিতে সাজা ও বাকি ২০টিতে অভিযুক্তরা খালাস পেয়েছে। এই হিসেবে দুদকের মামলায় নিম্ন আদালতে শাস্তির হার দাঁড়িয়েছে ৬০ দশমিক ৬৪ শতাংশে। আর মামলা নিষ্পত্তির হার সাত দশমিক ৩২ শতাংশ। অপরদিকে, হাইকোর্ট ও আপীল বিভাগ মিলিয়ে বিদায়ী বছরে মামলা নিষ্পত্তির হার ৫৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এর মধ্যে কমিশনের পক্ষে নিষ্পত্তি বা সাজা বহাল রাখার হার ৪৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ। চূড়ান্ত পর্যায়ে সর্বমোট একশ’ ৫১ টি মামলায় দুইশ’ ৮৮ জন আসামির সাজা নিশ্চিত করা হয়েছে। জরিমানা ও সম্পদ বাজেয়াপ্তের মাধ্যমে রাষ্ট্রের অনুকূলে আদায় হয়েছে একশ’ ৫৩ কোটি ২৯ লাখ ২৪ হাজার দুইশ’ ৪৩ টাকা।
দুদক সূত্র বলছে, সর্বশেষ গত তিন বছরে ছয়শ’র বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে দুদক। ফাঁদ মামলা পরিচালনা করে ঘুষ নেয়া অর্ধশতাধিক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এছাড়া গত ১২ বছরে (২০০৭-২০১৮) পাঁচ হাজার ৮৯টি দুর্নীতির মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ সময়ে বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর আমলের মামলাসহ পাঁচ হাজার পাঁচশ’ ২০টি মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। আর গত ১০ বছরে (২০০৯-২০১৮) এক হাজার তিনশ’ ২১টি মামলায় আসামিদের সাজা হয়েছে। কমিশনের মামলায় ২০১৭ সালে সাজার পরিমাণ ছিল ৬৮ শতাংশ।
কমেছে অভিযোগ, অনুসন্ধান, মামলা ও চার্জশিট: ২০১৭ সালের তুলনায় বিদায়ী বছরে দুদকের অভিযোগ, মামলা ও চার্জশিটের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কমেছে। ২০১৮বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দুদক নতুন ৩৩ টি মামলা দায়ের এবং একশ’ ২৪ টি মামলার চার্জশিট দাখিল করেছে। ২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দুদকে মামলা ও আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল হয় যথাক্রমে দুইশ’ ২২টি ও তিনশ’ ৫৪টি। যেখানে ওই একই সময়ে গত বছর মামলা ও চার্জশিট দাখিল হয়েছে একশ’ ৮৯টি ও দুইশ’ ৩০টি। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১২ হাজার দুইশ’ ২৭টি অভিযোগ দুদকে জমা হয়। যেখানে ২০১৭ সালে ১৮ হাজার লিখিত অভিযোগ পেয়েছিল। ২০১৮ সালে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল (এফআরটি) বা আসামিদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে মোট একশ’ ২৭টি মামলায়। যেখানে ২০১৭ সালে দুইশ’ ২৫টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছিল। পরিসমাপ্তি বা নথিভুক্তি হয়েছে তিনশ’ ২৭টি অনুসন্ধান। বিদায়ী বছরে কমেছে ফাঁদ মামলা ও গ্রেপ্তারের সংখ্যাও। ২০১৭ সালে দুদক ফাঁদ পেতে সর্বোচ্চ আসামি গ্রেপ্তার করেছিল। ওই সময়ে ফাঁদ পেতে সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তা পর্যায়ের ৩০ জনকে ঘুষসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে সংস্থাটির বিভিন্ন টিম। এর মধ্যে নৌ-পরিবহনের প্রধান প্রকৌশলী, শিক্ষা অফিসার, হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা ও বেশ কয়েকজন ভূমি কর্মকর্তা রয়েছেন। বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন মামলায় ৫৬ জন আসামি গ্রেপ্তার করা হয়। যেখানে তার পূর্ববর্তী বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল একশ’ ৮২ জন। তবে, ২০১৬ সালেই দুদক সর্বাধিক তিনশ’ ৮৮ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছিল।