দুই রকম ফল বিভ্রান্ত ক্রেতা

57

সাধারণ জনগণের বিশ্বস্ততার তালিকায় শীর্ষেই রয়েছে প্রতিষ্ঠান দু’টি। একটি বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) এবং অপরটি প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার ও ফার্মেসি অনুষদ। কিন্তু এই দুই প্রতিষ্ঠানের জরুরি খাদ্যদ্রব্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল ভিন্ন হওয়ায় চরম বিভ্রান্তিতে পড়ে আতঙ্কে সাধারণ জনগণ।
মঙ্গলবার (২৫ জুন) ঢাবির বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার ও ফার্মেসি অনুষদের গবেষকরা সংবাদ সম্মেলনে জানান, সাত কোম্পানির দুধে বেশি মাত্রায় ক্ষতিকারক এন্টিবায়োটিকসহ ডিটারজেন্ট, ফরমালিন ও অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর।
সেখানে বলা হয়েছিল, দুধের সাতটি নমুনার সবগুলোতেই মানবচিকিৎসায় ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক লেভোফ্লক্সসিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন ও এজিথ্রোমাইসিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এছাড়াও অপাস্তুরিত দুধের একটি নমুনাতে ফরমালিনও মিলেছে। অন্য একটিতে পাওয়া গেছে ডিটারজেন্ট। নির্ধারিত ফ্যাটের মাত্রা ঠিক নেই নমুনাগুলোতে। আর টোটাল ব্যাকটেরিয়া কাউন্ট ও কলিফর্ম কাউন্ট ছিল পাস্তুরিত দুধের সবগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি।
স্টেফাইলোকক্কাস স্পেসিজ শূন্য থাকার কথা থাকলেও তার পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। এ অর্থে দুধগুলো বিএসটিআইয়ের মানোত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব না। পাস্তুরিত দুধের সতটি নমুনা হলো- মিল্কভিটা, আড়ং, ফার্ম ফ্রেশ, প্রাণ, ইগলু, ইগলু চকোলেট ও ইগলু ম্যাংগো।
অথচ একই দিন সন্ধ্যার পর বাজারে মেলা ১৫টি দুধের নমুনা পরীক্ষা করে হাইকোর্টকে জানায় তারা কোনো দুধে ক্ষতিকর কিছু পায়নি। এ নিয়ে চরম বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় সাধারণ মানুষের মধ্যে। বিশেষ করে দুধ প্রধানত শিশুখাদ্য হওয়ায় চিন্তা আরো বেড়ে যায়।
গতকাল বুধবার এ বিষয়ে পুনরায় জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, তারা (বিএসটিআই) তো এন্টোবায়োটিক টেস্ট করেনি। তাদের লিস্টে কিন্তু এন্টিবায়োটিক পরীক্ষাই নেই। তাদের রিপোর্টে কি সমস্যা আছে সেটা তারাই বলবে। কিন্তু আমাদের কাছে এন্টিবায়োটিকটা জরুরি বিষয় হয়ে গেছে সারভাইভালের (বাঁচার) জন্য।
গরুকে বাঁচাতে হলে তাকে এন্টোবায়োটিক দিতে হবে। তার জন্য এন্টাবায়োটিক নির্দিষ্ট করা আছে। কিন্তু মানুষের এন্টিবায়োটিকগুলো প্রাণীর দেহে দেওয়া যাবে না। কিন্তু এটা তারা মানছে না। কোনো কোনো কোম্পানি না মেনে ফিড তৈরি করে। ব্যবসার খাতিরে তারা বাংলাদেশের মানবপ্রজাতিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তারা বলছে এন্টিবায়োটিক মিশিয়ে দিলে ফিডের মধ্যে গরু মোটা হবে, তাজা হবে অসুখ হবে না। এগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এটাই আমাদের বক্তব্য। এটা বন্ধ করা দরকার।
তিনি আরো বলেন, বিএসটিআই পরীক্ষা করুক, দেখুক তারা পায় কিনা। তারা অন্য পরীক্ষা করেছে। এতে তারা কি পেয়েছে না পেয়েছে সেটা তাদের ব্যাপার। আমরা এ বিষয়ে বলতে পারবো না। আমরা আমাদের স্যাম্পল নিয়ে বলতে পারবো। এটা যদি এমন হতো একই স্যাম্পল তারাও পরীক্ষা করেছে আমরাও পরীক্ষা করেছি, কেন ভিন্ন হলো? সেটা একটা বিবেচনার বিষয় হতে পারতো। আমরা স্যাম্পলগুলো কীভাবে পরীক্ষা করেছি, ওনারা কীভাবে করেছে? কোন জায়গা থেকে স্যাম্পল নিয়েছে? এগুলো দেখার বিষয়।
একটি কোম্পানির দুধ সব একই মানের হবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অবশ্য দুধ সব এক হওয়ার কথাও না। গরুর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ান, ইন্ডিয়ান, বাংলদেশের গরু পার্থক্য হবে কিছুটা এটা সত্যি। কিন্ত বিশাল পার্থক্য হওয়ার কথা না। এখানে কোনো রহস্য থাকতে পারে। খবর বাংলানিউজের
ওষুধ বিশেষজ্ঞদের মতে, যে সব উপাদান দুধে উপস্থিতির কথা ঢাবির গবেষকরা বলেছেন সেগুলো মানবদেহের জন্য চরম হুমকি। যেমন এন্টিবায়োটিকগুলো রোগের উপস্থিতি ছাড়া শরীরে প্রবেশ করে তার সঠিক ক্রিয়া সম্পাদন করতে পারে না। ফলে এগুলো খুব শক্তিশালী আকার ধারণ করে রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে ওই এন্টিবায়োটিক সংশি�ষ্ট রোগের আক্রমণ হলে ওষুধটি খেলেও রোগ নিরাময়ে আর কাজ করবে না।
ফলে রোগটি আরো বাড়া ছাড়াও অন্যান্য রোগ সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া আমাদের সবার শরীরেই ব্যাকটেরিয়া (লিভিং মাইক্রোঅর্গানিজম) থাকে যা শরীরের বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। এর সঙ্গে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট অবস্থায় (যখন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে) তখন বাইরে থেকে সংক্রমিত ব্যাকটেরিয়ার (ননলিভিং মাইক্রোঅর্গানিজম) উপস্থিতি ঘটলে কী ঘটতে পারে, শরীরে কী বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে তার কোনো সঠিক নির্দেশনা চিকিৎসা বিজ্ঞানে নেই। যে কোনো মারাত্মক কোনো রোগের সৃষ্টিও হতে পারে। তাই এটি খুব মারাত্মক বিষয় বলে বিশেষজ্ঞদের মতামত। কিংবা এরকম সময় ইমিউন সিস্টেমের (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) কারণে মারত্মক কিছু না ঘটলেও তা দুর্বল হতে থাকে। ফলে যে কোনো রোগের আক্রমণ হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।
এদিকে এমন পরিস্থিতিতেও কোনো মন্তব্য করতে নারাজ সংশ্লিষ্ট বিএসটিআই কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসটিআইয়ের পরিচালক (সিএম) এসএম ইসহাল আলী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি বলছে না বলছে সেটা তাদের বিষয়। সেটা আমাদের মাথাব্যথা নয়। আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলছে, আমাদের যা বলার তা আমি আদালতেই বলছি। এর বাইরে এ বিষয় নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারবো না। কিছু জানতে হলে আদালতে যখন বলবো তখন জেনে নেবেন।
এর আগে মঙ্গলবার (২৫ জুন) ১৪টি কোম্পানির পাস্তুরিত দুধে (১৮টি নমুনা) আশঙ্কাজনক বা ক্ষতিকর কোনো কিছুই পাওয়া যায়নি বলে হাইকোর্টকে জানিয়েছে বাংলাদেশ স্ট্যার্ন্ডাড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই)।
ওদিকে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, বিএসটিআই কোম্পানিগুলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যে কোনো নমুনা দিয়ে যেতে বললে তখন কোম্পানিগুলো ভালোমানের পণ্যই দিয়ে যায়। তাতে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ভালো ফলাফলই আসে। আর ঢাবি সরাসরি বাজার থেকেই দুধ সংগ্রহ করেছে। সেক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গায় এখন পর্যন্ত ঢাবি এগিয়ে আছে।
এমন পরিস্থিতিতে চরম বিভ্রান্তির শিকার হয়ে জনস্বাস্থ্য নিয়ে আতঙ্কিত সাধারণ জনগণ। যারা অবিশ্বাস করতে পারছেন না এই দুটো প্রতিষ্ঠানের একটিকেও, বলছিলেন রাজধানীর মহাখালী এলাকার বাসিন্দা স্বপ্না। তিনি বলেন, ঢাকায় বসে গরুর দুধ সরাসরি পাওয়াটা তো আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো বিষয়। সেক্ষেত্রে বাচ্চাদের জন্য গরুর পাস্তুরিত প্যাকেটজাত দুধই শেষ ভরসা। এখন যেসব কথা গণমাধ্যমে পড়ছি বা দেখছি তাতে তো এটাও খাওয়ানো বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কার উপর নির্ভর করবো। এতদিন বিএসটিআইয়ের কথা বিশ্বাস করেছি। আবার ঢাবির গবেষকদের কথাও তো ফেলনা নয়। এই মুহূর্তে আমি আমার পরিবারে বাজার থেকে কেনা দুধ খাওয়ানো বন্ধ রেখেছি। আমরা এর দ্রæত সমাধান চাই। আমরা নিরাপদ খাদ্য চাই। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কড়া হস্তক্ষেপ চাই।
এছাড়া মঙ্গলবার ঢাবির গবেষকরা দুধ ছাড়াও ফ্রুট ড্রিংকস, সরিষার তেল, সয়াবিন তেল, ঘি, গুঁড়া মশলা, শুকনা মরিচ, হলুদ, পাম অয়েল নিয়েও পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেন। সেখানে এসব পণ্যেও ভেজালের তথ্য উঠে আসে। আর এ কারণে রাজধানীর মুদি দোকানগুলো ঘুরেও লক্ষ্য করা গেছে এর প্রভাব।
এ বিষয়ে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় ইসমাইল নামে এক মুদি দোকানদার বলেন, গতকাল রাত থেকেই দুধসহ এসব পণ্যের বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। মানুষ কিনতে চাইছে না। এগুলো তো মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু। মানুষকে কিনতে হবেই। আতঙ্ক থেকে আজ হয়তো নিচ্ছে না কন্তু কাল তো নিতেই হবে। এমনকি আমাকেও নিতে হবে। যদি আসলেই এরকম ভেজাল থাকে তাহলে আমাদের ক্ষতিগুলো নিয়ে আমরা আসলেই আতঙ্কিত হবো সেটাই খুব স্বাভাবিক। তাই সরকারের উচ্চ মহলের হস্তক্ষেপ চাই এই সমস্যা সমাধানে।