দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে দেশে ফিরলেন ক্রিকেটাররা

46

শেষ টেস্টের দ্বিতীয় দিনের জন্য পরিকল্পনা কষে এখন ঘুমিয়ে থাকার কথা ছিল মাহমুদউল্লাহদের। কিন্তু এক ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষী হয়ে ক্রাইস্টচার্চ টেস্ট না খেলেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে দেশে ফিরতে হলো বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে। গতকাল শনিবার রাত ১০টা ৪০ মিনিটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেছে কোচিং স্টাফসহ ১৯ জনের দল। এ খবর নিশ্চিত করেছেন বিসিবির মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস।
শুক্রবার দুপুর থেকেই ক্রিকেটাররা আতঙ্কের মধ্যে। ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাসী হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন তারা। নিরাপদে টিম হোটেলে ফিরলেও আতঙ্ক মুছে যায়নি মন থেকে। আরেকটু আগে মসজিদে পৌঁছালে কী ভয়ঙ্কর ঘটনাই না ঘটতো! চোখের সামনে ঘটা হত্যাযজ্ঞের ভয়ঙ্কর দৃশ্য স্মৃতিতে নিয়ে দেশের মাটিতে পা রেখেছেন তামিম-মুশফিকরা।
এই সফরে যাওয়া ১৫ ক্রিকেটার একই ফ্লাইটে দেশে ফিরেছেন। মাহমুদউল্লাহ, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মেহেদী হাসান মিরাজ, মোস্তাফিজুর রহমান, লিটন দাস, তাইজুল ইসলাম, সাদমান ইসলাম, মুমিনুল হক, খালেদ আহমেদ, এবাদত হোসেন, মোহাম্মদ মিঠুন, নাঈম হাসান, আবু জায়েদ ও সৌম্য সরকারের সঙ্গে বিমানে ছিলেন কোচিং স্টাফের চারজন। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
আল নূর মসজিদে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীর গুলিতে নির্মম হত্যাকান্ডের পর দুই দেশের ক্রিকেট বোর্ড শেষ টেস্ট বাতিল করে দেয়। তারপর থেকে কত দ্রুত ক্রিকেটারদের দেশে ফেরানো যায় সেটা ছিল চ্যালেঞ্জের। টিকিটের দুষ্প্রাপ্যতার আশঙ্কায় প্রথমে ভিন্ন ভিন্ন ফ্লাইটে খেলোয়াড়দের দেশে পাঠানোর কথা জানান টিম ম্যানেজার খালেদ মাসুদ পাইলট। তবে বিসিবি সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ করে বিশেষ ব্যবস্থায় টিকিটের ব্যবস্থা করে। তাতে সবাই একই বিমানে করে দেশে পৌঁছান।
শনিবার বাংলাদেশ সময় সকালে ক্রাইস্টচার্চ বিমানবন্দরে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের বিমানে দেশের উদ্দেশে রওনা দেন ক্রিকেটাররা। অস্ত্রসজ্জিত পুলিশের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবেষ্টনিতে তারা হোটেল থেকে বিমানবন্দরে পৌঁছান।
বিমানে ওঠার আগ মুহূর্তে মুশফিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। টুইটারে তার পোস্ট ছিল, ‘ইনশাল্লাহ, শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরছি।’ অবশেষে তারা ফিরলেন এবং কেটে গেলো দেশের মানুষের উদ্বেগও।
এর আগে দেশে ফেরা নিয়ে দলের ম্যানেজার খালেদ মাসুদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘(স্থানীয় সময়) শনিবার দুপুর ১২টায় (বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা) আমরা রওনা দেব। আশা করি, ঢাকায় পৌঁছাব রাত ১০টা ৪০ মিনিটে।’
কোচিং স্টাফদের কেউ কেউ যে দলের সঙ্গে ফিরছেন না, সেটি অবশ্য ম্যানেজার আগেই বলেছিলেন। পাইলট বলেন, ‘আমরা ১৯ জন ফিরব। কোচিং স্টাফের কেউ ওয়েস্ট ইন্ডিজ যাবে, কেউ হয়তো দক্ষিণ আফ্রিকায়। তারা দ্রæতই টিকিট পেয়ে যাবেন।’
তৃতীয় টেস্ট ম্যাচটিকে সামনে রেখে গত শুক্রবার সকালে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন সফরকারী বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। সংবাদ সম্মেলন শেষে দুপুর দেড়টায় জুমার নামাজ আদায় করতে টাইগারদের মসজিদে ঢোকার কথা ছিল তাদের। কিন্তু সংবাদ সম্মেলন শেষ করতে কিছুটা দেরি হয়ে যায় মাহমুদউল্লাহর। এই দেরি আর অজ্ঞাত এক নারীর সতর্কবানীর কারণে নৃশংসতা থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন মুশফিক, তামিম, মিরাজ ও পাইলটরা।
যতক্ষণে তারা টিম হোটেলে ফেরেন ততক্ষণে এই দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে চলে গেছেন ৪৯ জন। হোটেলে ফিরেও নিজেদের মনকে বোঝাতে পারছিলেন না মুশফিক। চোখের কোন থেকে অঝর ধারায় গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। বোকা বনে গেছিলেন তামিম, সৌম্যসহ সব ক্রিকেটার।
ঘটনার পর থেকেই সারাবিশ্বের গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গেই প্রকাশ হয়েছে ক্রাইস্টচার্চের সন্ত্রাসী হামলা ও টাইগার ক্রিকেটারদের অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়ার খবর। এমনকি বিশ্বের বাঘা বাঘা ক্রিকেটারগণ টুইটারে ঝেড়েছেন ক্ষোভ। টাইগারদের জানিয়েছেন সাধুবাদ।
ক্রিকেটের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ক্রিকবাজ লিখেছে, রক্তাক্ত লোকজন যেভাবে মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসছিলেন তা যেন কোনো এক সিনেমার দৃশ্য। ক্রিকবাজ আরো লিখে, ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাসী হামলায় অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।
ঘটনার পর একটি ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশ দলের টিম ম্যানেজার খালেদ মাসুদ পাইলট বলেছিলেন, ‘আমরা সত্যিই ভাগ্যবান ছিলাম। যে নরকীয় অবস্থার কথা শুনেছি, তা মেনে নেওয়া কষ্টকর।’
সফররত দলে ছিলেন টেস্ট স্পেশালিস্ট ব্যটসম্যান মমিনুল হক। কয়েকটি সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বাসের মধ্যে পাঁচ-দশ মিনিট বসে ছিলাম। তখন পাইলট ভাই (ম্যানেজার) ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিলেন। পেছন থেকে তামিম ভাই এলেন, আমরা বাসের ড্রাইভারকে জানালা খুলতে বলি। দেখলাম বেশ কিছু লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমরা বাসের পেছনের দরজা খুলে পার্কের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলে আসি। আমরা পাঁচ মিনিট আগে মসজিদে পৌঁছালে ভেতরে থাকতাম এবং সবাই শেষ হয়ে যেতাম। পরম করুণাময়ের অশেষ রহমত যে পাঁচ মিনিট দেরিতে পৌঁছেছি।’
তবুও দেশটিকে ভালোবাসেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের উইকেট কিপার ও ব্যাটিং স্তম্ভ মুশফিকুর রহিম। তিনি বলেছেন, ‘আমার চোখে নিউজিল্যান্ড এখনো বিশ্বের সেরা দেশগুলোর একটি। আমরা এখনো নিউজিল্যান্ডকে ভালোবাসি।’
গতকালকের (শুক্রবারের) ঘটনার পর বাংলাদেশ দলের বাস ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর একটু আগেই রক্তের ¯্রােত বইতে শুরু করেছিল ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদে। সে হামলার সরাসরি শিকার না হলেও ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পার করেছেন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা। ভীত-সন্ত্রস্ত দলকে দ্রুত হোটেলে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হলেও ঘটনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে বহুদিন সময় লাগবে।
আমরা খুব ভাগ্যবান : বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মনের অবস্থা বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণে বেঁচে দেশে ফিরলেও আতঙ্ক দূর হয়নি তাদের মন থেকে। তা হওয়ার কথাও নয় অবশ্য।
দেশে ফিরে বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে টেস্ট দলের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ সবার মনের কথাই তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, এ ঘটনা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা কারোরই কাম্য নয়।
নিজেদের ভাগ্যবান উল্লেখ করে এই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান বলেছেন, আমরা খুব ভাগ্যবান। এমন ঘটনার পরও আমাদের কিছু হয়নি।
তিনি আরও বলেছেন, ‘কাল সারা রাত আমরা কেউ ঘুমাতে পারিনি। আমাদের শুধু মনে হচ্ছিল, একটু এদিক-ওদিক হলে কী ভীষণ ঘটনাই না ঘটতো!
এমন দুঃসময়ে পাশে থাকার জন্য ক্রিকেট বোর্ডকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ। সেই সঙ্গে দেশের মানুষের কাছে দোয়া চেয়েছেন তিনি, বিসিবিকে এবং পাপন ভাইকে (বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান) ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমাদের দ্রæত দেশে ফিরিয়ে এনেছেন তারা। দেশবাসীর কাছে আমরা দোয়া চাই। আমরা যেন মানসিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারি সেই দোয়াই চাই তাদের কাছে।