দুঃখ ও বেদনার কবি হেলাল হাফিজ

195

“এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।” এই শ্রেষ্ঠ বাক্যগুলো প্রথমে শুনি অষ্টম কিংবা নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়। তখন প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার ফলে এসব কবিতার লাইন শুনার সৌভাগ্য হয়েছিল। কবিতার সাথে পরিচিত তাই কবির সাথেও পরিচয় হয়ে যায়। এই প্রেম, দ্রোহ ও বিরহের কবির নাম হেলাল হাফিজ।
‘আমি‘ ময় এই সমাজের একজন নিভৃতচারী ‘প্রবল-আমি’ কবি হলো হেলাল হাফিজ। তাঁর সেই আমি হয়ে ওঠে আমরা, হয়ে উঠে সকলে। তিনি কখনো খ্যাতির পেছনে ছুটেন নি, বরং খ্যাতিই ছুটে এসে তাঁকে ছুয়ে গেল। তিনি কখনো রাজপথের মিছিলে ছুটেন নি কিংবা মিছিলেও যোগ দেননি কখনো। কিন্তু মিছিলের প্রাণ বলি কিংবা সত্তা বলি তাই-ই ঝলসে উঠেছে তাঁর হৃদপিন্ডের স্পন্দনে।
“এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।” ‘এভাবে মিছিলে যাবর সময়’, ‘যুদ্ধে যাবার সময়’ কথা স্পষ্ট করে হৃদয়ে গেঁথে দেয়া ব্রূপদীর স্রষ্টা তিনি।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় তিনি ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ এ কবিতাটি লিখেন। এই একটি কবিতা লিখে তিনি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র মাত্র। তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র আধুনিক কবি যিনি বিংশ শতাব্দীর শেষাংশে জনপ্রিয়তার চূড়ান্ত শেকড়ে পৌঁছে যান। শুধু মাত্র একটি কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ দিয়ে। শুধু তাই নয় জনপ্রিয়তার বদৌলতে কবিতা পাঠের আসর ছাপিয়ে মিছিলে – সেøাগানে উচ্চারিত হতে থাকে তাঁর কবিতা। এ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর কবি নিজেকে আড়ালেসরিয়ে নেন। যদিও এ কাব্য গ্রন্থের আরো অসংখ্য সংস্করণ হয়েছে, যে কাব্য দিয়ে তিনি বাংলা বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। নাম লিখিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ প্রকাশিত হওয়ার দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর পর ২০১২ সালে তাঁর দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ কবিতা ‘একাত্তর’ প্রকাশিত হয়।
কবি আজীবন দুঃখের চাষাবাদ করেছেন। বেদনাকে করেছেন নিজের বোন। জীবনও তাঁকে হতাশ করেনি। জীবনের কোনো খানে দুঃখের ঘাটতি হলে সেখানে কবি নিজেই নিজের মত করে দুঃখ বানিয়ে এ শূন্যস্থান পূরণ করেছেন।
কবি দুঃখ-বেদনার তাড়নায় সৃষ্টি করে আসছেন অনবদ্য সাহিত্য। কষ্টের এ ফেরীওয়ালা তাই সারাজীবন কষ্ট ফেরী করে বেড়াচ্ছেন। ফেরিওয়ালা কবিতায়ও কবি কষ্টের ফেরী করেছেন-
“কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।”
কষ্টের কত গভীরে গেলে, তাকে কত আপন করে নিলে কিংবা কতটুকু কাছ থেকে দেখলে এমন উপমা দিতে পারে। এ কষ্টের সাথে কবির ছিল গভীর প্রেম। তাই কষ্টকে ছাড়তে তিনি রাজি নন, কষ্টহীন কবি অসহায়, নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। কাষ্টের সাথে সংসার, বসবাস বলেই কবি নিজেকে জনসম্মুখ থেকে দীর্ঘ পঁচিশ বছর অত্ম গোপনে রাখতে পেরেছেন।
মানব সভ্যতা যখন মানুষেই প্রতিমূর্তির উৎপরদ করার ক্ষমতায় অভিষিক্ত, মানুষের কাছে সবচেয়ে না বোঝা প্রপঞ্চের নাম ‘মানুষ’ তখন তিনি বলে উঠেছেন-
“নিউট্রন বোমা বোঝো
মানুষ বোঝো না”।
মানবের এ অশ্লীল সভ্যতার জন্য এ দুই লাইনের কবিতাই যথেষ্ট। তিনি বিদ্রোহ ও প্রেমকেও একসূত্রে গেঁথেছেন তাঁর ‘নিষিদ্ধ সম্পাদর্কীয়’ কবিতাতেই-
“কোনো কোনো প্রেম আছে
প্রেমিকাকে খুনি হতে হয়।
যদি কেউ ভালবেসে খুনি হতে চান
তাই হয়ে যান।
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়।”
সুদীর্ঘ সময় ধরে নগরে থেকেও নাগরিক কলুষে আক্রান্ত হননি, স্রোতের উজানে গা ভাসান নি। তিনি প্রেম, দ্রোহ ও তারুণ্যের কবি হেলাল হাফিজ। এ স্পষ্ট-নিভৃতচারী তপস্বীর তপস্ব্যাকে ভক্তকুল দখল করে নিয়েছে তাদের অকৃত্রিম ভালবাসায়।