দিশেহারা রাঙামাটির লঞ্চ মালিকরা

37

বৈশ্বিক করোনা পুরো পৃথিবীকে স্তদ্ধ করে দিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যেই যেমন মানুষের প্রাণ যেমন কেড়ে নিচ্ছে তেমনি অর্থনীতির চাকাও বন্ধ করে দিয়েছে। মালিক-শ্রমিক সবারই আয়ের চাকা বন্ধ হয়ে রয়েছে। করোনা থেকে বাঁচতে স্বেচ্ছায় ঘরবন্দি হয়ে রয়েছেন মানুষ। ঘরবন্দি থেকে ব্যয় বাড়লেও আয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই।
অনেকেই জমানো টাকা খরচ করে এ সময় পার করছেন। অনেকের আবার ব্যাংকে জমানো সম্বলও শেষ হয়ে গেছে।
করোনার ক্রান্তিকালেও অনেক লঞ্চ মালিকপক্ষ নিজেদের কর্মচারীদের পুরো বেতন দিতে না পারলেও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে অর্ধেক বেতন দিয়ে তাদের ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। যে কারণে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসেব মিলছে না। এ কারণে মালিকপক্ষকেও কষ্ট করতে হচ্ছে। তারাও অসহায় হয়ে পড়েছেন।
অনেকে ঋণ নিয়ে প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। আয় না থাকলেও ঋণের টাকা তাদের শোধ করতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত তাদের দুশ্চিন্তা বেড়ে গিয়ে ঘুম হারাম হচ্ছে।
সারাদেশের মতো পাহাড়ি জেলা রাঙামাটির ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন মালিকদেরও একই হালচাল।
করোনার প্রাদুভার্ব ঠেকাতে রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের নির্দেশ মেনে লঞ্চ মালিকরা গত ২৫ মার্চ থেকে নৌ-পথের সব যাত্রী পরিবহন বন্ধ ঘোষণা করে। বর্তমানে বন্ধের মেয়াদ দেড় মাস পার হতে চলেছে। আর দেড় মাস ধরে নৌ-চলাচল বন্ধ থাকায় লঞ্চ মালিকরা পড়েছেন চরম বিপাকে।
তাদের একমাত্র আয়ের পথ হলো লঞ্চে যাত্রী পারাপার। এখন সেই জীবিকা নির্বাহের পথ বন্ধ থাকায় দুশ্চিন্তা তাদের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে। একদিকে নিজেদের পারিবারিক খরচ অন্যদিকে কর্মচারীদের দায়িত্ব। রয়েছে ব্যাংক ঋণের মতো বড় বোঝা। যে কারণে তারা হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন।
এছাড়া লঞ্চগুলো বন্ধ থাকায় মেশিনারিজ অনেক পার্টস অকেজো হয়ে পড়ছে। আবার লঞ্চগুলো সচল রাখতেও অনেক সময় জ্বালানি খরচ মেঠাতে হচ্ছে।
লঞ্চ মালিক মঈন উদ্দীন সেলিম বলেন, শান্তিতে নেই, সুখে নেই। কী করবো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। আজ প্রায় দেড় মাস হতে চললো আমার লঞ্চগুলো বন্ধ রয়েছে। কোনো আয়-রোজগার নেই। লঞ্চগুলো চলাচল বন্ধ থাকলেও সেগুলো সচল রাখতে খরচ করতে হচ্ছে জ্বালানি। এছাড়াও যানগুলো বন্ধ থাকায় মেশিনারিজ অনেক যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়ছে। সেদিকেও খরচ বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, আমার ব্যক্তিগত ৯টি লঞ্চ রয়েছে। এর মধ্যে প্রতিটিতে প্রায় ৫ জন করে শ্রমিক রয়েছে। এদের মধ্যে প্রতি মাসে প্রতি শ্রমিকদের বেতন দিয়ে দিতে হয়। চালকের বেতন মাসিক ২৫ হাজার টাকা, সারেং এর বেতন ২০ হাজার, মিস্ত্রির ১৮ হাজার ও দুই শ্রমিককে জনপ্রতি মাসে ১২ হাজার টাকা করে দিতে হয়।
বর্তমানে করোনার এই কঠিন সময়ে তাদের পুরো মাসের বেতন দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই মানবিক জায়গা থেকে শ্রমিকদের কিছু টাকা দিয়েছি। আমি তাদের বের করে দিলে তারা কোথায় যাবে। সারাজীবন তারা আমার কাজ করেছে। চেষ্টা করছি তাদের জন্য কিছু করার। তাদের জন্য ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণের ব্যবস্থা করেছি। কারণ আমারও সীমবদ্ধতা রয়েছে। ব্যাংক ঋণ শোধ করতে হয়, পারিবারিক খরচ রয়েছে, দিতে হবে সরকারি কর। সবমিলে চরম দুর্দিনে দিন কাটছে।
এদিকে অন্যান্য লঞ্চ মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাঙামাটি জেলা শহরের সঙ্গে ৬টি উপজেলার যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হলো নৌ-পথ। এর মধ্যে নানিয়ারচর, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল, লংগদু এবং বাঘাইছড়ি উল্লেখযোগ্য। এই রুটগুলোতে প্রায় ৫৩টি লঞ্চ চলাচল করে। প্রতিটি লঞ্চে চালক, সারেং এবং মিস্ত্রীসহ পাঁচ থেকে ছয় জন শ্রমিক নিয়োজিত থাকে।
প্রতিটি লঞ্চে দিনে সব খরচ বাদ দিয়ে দৈনিক পাঁচ হাজার টাকা থেকে ছয় হাজার টাকা আয় হতো। প্রতিটি লঞ্চ মিলে মালিক পক্ষদের দৈনিক আয় হয় প্রায় তিন লাখ টাকা এবং তা মাসে গিয়ে দাঁড়ায় কোটি টাকার কাছাকাছি। কিন্তু করোনা তাদের আয়ের পথ গ্রাস করেছে। একদিকে কর্মচারীদের দেখভাল করা অন্যদিকে নানান খরচে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন বলে জানান তারা।
বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থা রাঙামাটি অঞ্চলের চেয়ারম্যান মঈনুদ্দীন সেলিম বলেন, দেড় মাস ধরে লঞ্চগুলো চলাচল বন্ধ থাকায় আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। মালিক পক্ষের অনেকে ব্যাংকের ঋণ নিয়ে লঞ্চগুলো চালাচ্ছে। এখন ঋণের চাপ ঘাড়ে উঠেছে।
এখন যদি করোনা মহামারি বিদায় না নেয় তাহলে আমাদের পথে বসা ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না। এই দুর্দিনে সরকারি ঊর্ধ্বতন মহলকে নজরদারির মাধ্যমে তাদের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য জোর দাবি জানান যাত্রী পরিবহন সংস্থার এই নেতা। খবর বাংলানিউজের