দিল্লির মসনদ কার জানা যাবে আজ

54

ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা আজ (বৃহস্পতিবার)। আর এই ফলাফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে টান টান উত্তেজনা গোটা ভারতে। একটাই প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ৭ নম্বর লোককল্যাণ মার্গের ঠিকানাতেই কি থাকবেন নরেন্দ্র মোদী? না কি পঞ্চদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অন্য কেউ দখল নেবেন নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের? বুথফেরত সমীক্ষার সম্ভাবনাকে পিছনে ফেলে আজ সরাসরি এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার দিন। আজ বেলা যত গড়াবে, ততই স্পষ্ট হয়ে যাবে কার দখলে যাচ্ছে দিল্লির মসনদ।
সকাল ৮টা থেকে শুরু হবে ভোট গণনা। গণনা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষিত হতে থাকবে ফলাফল। যদিও নির্বাচন কমিশন বলছে, ফলাফল খানিকটা বিলম্বিত হতে পারে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, আসনপ্রতি পাঁচটি করে বুথের ইভিএম আর ভিভিপ্যাটের ফল মেলানোর কথা। ভিভিপ্যাট হলো এক ধরনের প্রিন্টার। ইভিএমে ভোট দেওয়ার পর ভোটার নিজেই ওই প্রিন্টার থেকে ছাপা হয়ে বের হওয়া কাগজের স্লিপে দেখে নিতে পারেন যে- তিনি যেখানে ভোট দিয়েছেন, সেখানেই ভোট পড়েছে কি-না। এই স্লিপটি ভোটার নিতে পারেন না, কেবল দেখতে পারেন। গত ১১ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে ১৯ মে পর্যন্ত ৭ ধাপে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। ২৯টি রাজ্য ও ৭টি কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ৫৪৩টি আসনে এ ভোটের আয়োজনে ভারতজুড়ে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ।
প্রায় ১৩২ কোটি জনগোষ্ঠীর ভারতে এবার ভোটার ছিলেন প্রায় ৯০০ মিলিয়ন বা ৯০ কোটি। ভোট কেন্দ্র ছিল ১০ লাখেরও বেশি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন ৮১ কোটি ৪৫ লাখ ভোটার। এবার নতুন অর্থাৎ ১৮ থেকে ১৯ বছর বয়সী ভোটার ছিলেন প্রায় দেড় কোটি। ২০১২ সাল থেকে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেয়ে আসা তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী থেকে এবার ভোটার ছিলেন ৩৮ হাজার ৩২৫ জন।
ভারতের সংসদ দ্বিকক্ষ-বিশিষ্ট। এরমধ্যে একটি হলো লোকসভা, এটি নিম্নকক্ষ; আরেকটি রাজ্যসভা, সেটি উচ্চকক্ষ। লোকসভায় মোট আসন ৫৪৫। এর মধ্যে ৫৪৩ আসনে সরাসরি নির্বাচন হয়। বাকি দু’টি আসনে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান প্রতিনিধিকে মনোনীত করে আনা হয়। সরকার গঠনের জন্য লোকসভায় ২৭২ আসনের প্রয়োজন। রাজ্যসভার সদস্য সংখ্যা ২৫০। এরা রাজ্য বা অঞ্চলগুলোর বিধানসভার সদস্যদের ভোটে রাজ্যসভায় আসেন।
এবার নির্বাচনের সপ্তম ও শেষ দফা ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন সংস্থা জানাতে থাকে বুথফেরত জরিপের (এক্সিট পোল) ফলাফল। বেশিরভাগ সংস্থার জরিপ মতে, এবারও নরেন্দ্র মোদীর দল বিজেপি প্রায় ৩০০ আসন পেয়ে সরকার গঠন করতে চলেছে।
যদিও বুথফেরত জরিপের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক দলগুলোর জোট ফেডারেল ফ্রন্ট। কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধী সরাসরিই জরিপগুলোকে ‘ভুয়া’ আখ্যা দিয়ে নেতাকর্মীদের আত্মপ্রত্যয়ী থেকে ফলাফলে চোখ রাখতে বলেছেন। মাটি কামড়ে ফলের অপেক্ষা করতে বলেছেন তৃণমূল কংগ্রেস প্রধান মমতা বন্দোপাধ্যায়ও।
তবে বুথফেরত জরিপ যা-ই হোক, পর্যবেক্ষকদের পাশাপাশি বিশ্ববাসীও নজর রাখছে চূড়ান্ত ফলাফলের দিকে। কারণ এই ফলাফলই বলবে, আগামী পাঁচ বছর কারা চালাবে ভারত!
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে নজিরবিহীন জয় পেয়ে সরকার গড়ে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপির জোট ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স। ১৯৮৪ সালের পর প্রথমবারের মতো একক দল হিসেবে সরকার গঠনের মতো আসন পেয়ে যায় বিজেপিই। পদ্মফুল ফুটেছিল ২৮২ আসনে। বিজেপি জোটের অন্য দলগুলো পেয়েছিল ৫৫ আসন। অন্যদিকে আগের সরকার চালানো সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস পায় মাত্র ৪৪টি আসন। তাদের জোটের দলগুলো পায় ১৫ আসন। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস পায় ৩৪ আসন। তামিলনাড়ুর প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার দল এআইএডিএমকে পায় ৩৭ আসন।
বুথফেরত সমীক্ষার এই মেজাজই দেখা যাচ্ছে এনডিএ নেতানেত্রীদের মধ্যে। শরিকদের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে জোটবদ্ধ থাকার একটা প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছে গত মঙ্গলবারের এনডিএ বৈঠকেই। সূত্রের খবর, সেখানেই মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের সঙ্গে একটা ছোট বৈঠকও করে ফেলেছেন নরেন্দ্র মোদী। পাশাপাশি একটি বৈঠক সেরেছেন বিদায়ী সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকের দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলাদের সঙ্গেও। কোন পথে যাবে তার নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার, আগের এনডিএ সরকারের থেকে কতটা আলাদা হবে তার সরকারের নীতি, সেই নকশাও নাকি তৈরি করে ফেলেছেন মোদী-শাহ জুটি। নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন পাওয়ার জন্য দেশের জনতাকে আগাম অভিনন্দন জানিয়ে দিয়েছেন বিদায়ী সরকারের বস্ত্রমন্ত্রী স্মৃতি ইরানিও।
বুথফেরত সমীক্ষার ফল সামনে আসার পর শাসক দলের মধ্যে আবেগে ভাসার প্রবণতা দেখা দিলেও কর্মী সমর্থকদের চাঙ্গা করতে বিরোধীদের মধ্যে তৎপরতার কোনও অভাব নেই। ভোট শেষ হওয়ার পরই ইভিএম কারচুপির প্রসঙ্গ তুলে নির্বাচন কমিশনের উপর চাপ তৈরি করে স্ট্রং রুম পাহারা দেওয়ার ডাক দিয়ে তারা দলীয় কর্মী-সমর্থকদের হতাশা ঢাকার চেষ্টা করছেন। অন্য দিকে, ফলাফল সামনে আসার পর বিরোধীদের কী কৌশল নেওয়া হবে, তা নিয়ে হয় একের পর এক ম্যারাথন বৈঠক। ভোটের পরই সামনে আসবে মহাজোটের চরিত্র, যার মেরুদন্ড হবে বিজেপি বিরোধিতা, এই কথা বার বার বলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, চন্দ্রবাবু নায়ডু, অখিলেশ যাদব ও ফারুক আবদুল্লারা। সেই ভোট পরবর্তী জোটের ছবিই যেন স্পষ্ট হল গত তিন দিনে চন্দ্রবাবু নায়ডু-র গতিবিধিতে।
বুথফেরত সমীক্ষার ফল আসল ফলাফলের সঙ্গে মিলছে না, এমন ঘটনা যে ঘটে, তার নিদর্শন আছে অনেক। কিছু দিন আগেই অস্ট্রেলিয়া আর ব্রাজিলে ঘটেছিল এমনই ঘটনা। বুথফেরত সমীক্ষা বলল এক, হয়তো হল আর এক। অনেকে বলছেন ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনের কথা। সেই নির্বাচনেও ক্ষমতায় ফিরবে এনডিএ সরকারই, এমনটাই বলেছিল বুথফেরত সমীক্ষা। যদিও তা মেলেনি। উল্টে তৈরি হয়েছিল মনমোহনের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার। এ রকম কিছু হবে, সেই আশাতেই বুক বেঁধে আজ ভোটগণনার দিকে কড়া নজর রাখছে বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। নজর রাখছে আমআদমিও।
এদিকে ভোট গণনার সময় সহিংসতার ছড়ানোর উসকানির আশঙ্কায় গতকাল বুধবার সবগুলো রাজ্যের কাছে সতর্ক বার্তা পাঠিয়েছে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি এ খবর জানিয়েছে।
বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সবগুলো রাজ্যের প্রধান পুলিশ কর্মকর্তা ও প্রধান সচিবদের সতর্ক করে জানিয়েছে, বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার উসকানি ও গণনা ভুন্ডুল করার ডাক দেওয়ার প্রেক্ষিতে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
মন্ত্রণালয়ের সতর্ক বার্তায় বলা হয়েছে, রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের স্ট্রং রুম, যেখানে ভোটযন্ত্রগুলি রাখা হয়েছে ও গণনাকেন্দ্রগুলিতে নিরাপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে।
মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা সংস্থা খবর পেয়েছে কোনও কোনও সংগঠন ও ব্যক্তির উসকানিমূলক মন্তব্যের কারণে উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ত্রিপুরায় সহিংসতার আশঙ্কা ও ভোটগণনায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
১১ এপ্রিল থেকে ১৯ মে পর্যন্ত সাত দফায় লোকসভার ভোট গ্রহণ হয়েছে। এবার ৯০ কোটি ভোটারের মধ্যে ৬৭ শতাংশ ভোট দিয়েছেন। তবে কয়েকটি স্থানে বিক্ষিপ্ত সহিংসতার খবর পাওয়া গিয়েছে। বিজেপির বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ভোটযন্ত্র বিকৃতি ও কোনও কোনও অঞ্চলে নির্বাচনি কর্মকর্তাদের হুমকির অভিযোগ জানিয়েছে বিজেপির বিরুদ্ধে।
অপরদিকে বুথফেরত সমীক্ষায় ক্ষমতাসীন বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে এমন খবর আসতেই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে শঙ্কিত ভারতের বিরোধী দলগুলো।
কারচুপির আশঙ্কায় ভোটগণনার আগে ভিভিপ্যাটের ক্লিপের সঙ্গে ইভিএমে প্রদত্ত ভোট শতভাগ মিলিয়ে দেখার আবেদন নিয়ে নির্বাচন কমিশনে স্মারকলিপি জমা দিয়েছে ২২টি বিরোধী দল।
বুধবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ২২টি দলের প্রতিনিধিরা। ভোটগণনার শেষ ধাপে নয়, শুরুতেই ভিভিপ্যাটের ¯িøপের সঙ্গে ইভিএম মিলিয়ে দেখার দাবি জানান তারা।
কমিশন থেকে বেরিয়ে কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদ বলেন, আমরা বলেছি, আগে ভিভিপ্যাটের স্লিপ গুণে দেখা হোক। ভুলভ্রান্তি পাওয়া গেলে শতভাগ স্লিপ মিলিয়ে দেখার ব্যবস্থা করুন।
কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু বলেন, তিন মাস ধরে নির্বাচন কমিশনের কাছে বিষয়টি নিয়ে বলছি। কিন্তু তারা কোনো জবাব দেয়নি। আগামীকাল (আজ) আবারও বৈঠকের সময় দিয়েছে কমিশন।
তেলেগু দেশম পার্টির চন্দ্রবাবু নাইডু বলেন, সাধারণ মানুষের ভোটের সঙ্গে কাটাছেঁড়া করা যাবে না।