দিলরুবা

153


অনিদ্রায় আক্রান্ত পুরুষ-মহিলা ব্যতীত যখন আর কারো শখের বশে জেগে থাকার কথা নয়, নিকট কিংবা দূর পাহাড়ের দেশ থেকে যখন কোন অলক্ষুণে বা অদ্ভূতুড়ে আওয়াজও স্বভাবত আসে না ভেসে, যখন হুতোম প্যাঁচা আর ডাহুক-ডাহুকীরাও থাকে নিস্তব্ধ মফস্বলের সেই গভীর নিঝুম রাতে এক বুক দুঃস্বপ্ন নিয়ে জেগে উঠে দিলরুবা। কিংবা বলা যায়, জেগে উঠতে বাধ্য হয় সে। চোখ মেলে দেখে, হালকা-পাতলা আস্তরনযুক্ত অন্ধকারের নিঃশব্দ পায়চারী ঘরময়। জানালার শিক গলে সিঁদেল চোরের মত প্রবেশ করেছে রূপালী চাঁদের মায়াবী আলো। দিলরুবার মনে পড়ে, ঘুমের মধ্যেই তার চোখে চোখ রেখে কে যেন গাইছিল গান, এই রূপালী গিটার ফেলে একদিন চলে যাব দূরে বহুদূরে, সেদিন চোখের অশ্রূ তুমি রেখো গোপন করে। এতটুকুন গাওয়ার পর ‘এক নিঃশ্বাসের নাই ভরসা, বন্ধ হবে রং-তামাশা’-কে সত্যি প্রমাণিত করে অকস্মাৎ ঢলে পড়ে চিরঘুমের কোলে।
বেদম হকচকিয়ে যায় দিলরুবা। প্রবল উত্তেজনায় শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তার। বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করে। সে উঠে বসে। সুইচ অন করে বাতি
জ্বালায়। ইনহেলার নেয়। তারপর কয়েক মিনিট বসে থাকে ঝিম মেরে। এরই মাঝে স্বাভাবিক হয়ে আসে শ্বাস-প্রশ্বাস।
তারপর মশারি উল্টে বেরিয়ে আসে দিলরুবা। টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি ঢেলে খেয়ে ফেলে ঢকঢক করে। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে, আড়াইটা বাজতে বাকী তিন মিনিট। মোবাইলটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে কিছুক্ষণ। খটুজে বের করে নম্বর। ভাবে। তারপর অফ করে রেখে দেয় আগের জায়গায়।
অফমুডে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর মশারির ভিতর ঢুকে আবার ঘুমোতে চেষ্টা করে দিলরুবা। পারে না। কারণ ঘুম হয়েছে গুম, ভাবনা দিচ্ছে চুম। আতংকিত মনে সে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন শুধায়, তিনি এখন কী করছেন? ভাল আছেন তো? কোন ক্ষতি হয়নি তো?
এমনতরো ভাবনায় দিলরুবা বেশ অবাকই হয় বটে। তাহলে কি নটঘট ব্যাপার ঘটে গেছে তলে তলে বহুদিন তালা দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা তার দিলমহলে?
জানালার পাশে গিয়ে দিলরুবা চাঁদের আলো গায়ে মাখে, দুই হাতে শিক ধরে চিবুক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়। স্নিগ্ধ জোসনায় অবগাহন করে মনের খারাপ ভাব কিছুটা যেন দূর হয়ে যায় তার। উদাস চোখে চেয়ে থাকে দূরে দূর আকাশের পানে। দেখে রূপালী থালার মত দেখতে চাঁদটাকে, একে ঘিরে থাকা অজস্র অযুত নিযুত তারকারাজিকে। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে অবতরণ করে মাটির পৃথিবীতে। দেখে আশপাশ প্রতিবেশ, গাছপালা বৃক্ষরাজি। রাতের বেলার প্রকৃতিকে কী একটা রহস্য ঘিরে আছে বলে মনে হচ্ছে। দিলরুবা ভাবে, মানুষের মন ও জীবনও কি বেশ রহস্যময় নয়? মনের তল কে কখন পেয়েছে কবে? আর জীবনের মানে খটুজতে গিয়ে তো কেউ কেউ জীবনই বিলিয়ে দিয়েছে, সংজ্ঞার মঙ্গা দেখতে পেয়ে আজও পন্ডিতকুল হা-পিত্যেশ করছে, বুক চাপড়ে মরছে।

সৈয়দ আকবর হোসেন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টের ব্যবসা আছে তাঁর। কী পরিমাণ টাকা আছে তাঁর বগলের তলে এ ব্যাপারে নানান জন নানান মত। অবশ্য তিনি নিজেও বলতে পারবেন না ঠিকঠাক করে। সর্বক্ষণ ছায়ার মত পাশ ঘেঁষে থাকা পিএর সাহায্য নিতে হবে তাঁকে। বিলাসে আচ্ছাদিত গাড়ি আছে, আলিশান বাড়ি আছে। আছে ছেলে-মেয়ে, ছেলের বউ, মেয়ের জামাই, নাতি-নাতনি সব। মনুষ্যভর্তি পরিবার, সদা ব্যস্ত জীবন তাঁর। দৃশ্যমান সুখের অন্ত নেই। তার পাশাপাশি আছে মনে অসুখ, বুকে হাহাকার, হৃদয়ে খরতাপ। বছর পাঁচেক হতে চলল, স্ত্রী তাঁকে ক‚ল নাই কিনার নাই কালাপানিতে ভাসিয়ে দিয়ে ধূলোবালিময় পৃথিবী ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে অনন্তধামে। এখন তিনি মনের দিক থেকে সম্পূর্ণ একা। সারাদিনমান ব্যস্ততায় সময় বেশ কেটে যায়। কিন্তু যখন তিনি লোকজনরহিত হন, রাতের বেলা দরজা বন্ধ করে চার দেয়ালের মাঝে ছোট্ট জায়গায় বন্দী হয়ে পড়েন এবং ঘুমোবার আয়োজন করেন তখন মনে হয়, এই জগৎ সংসারে তাঁর কেউ নেই। তিনি একা, চির একা। একজন সঙ্গীর অভাব বোধ করেন প্রচন্ডভাবে যাকে তিনি প্রেম দেবেন খুব করে। তার সাথে দুটো মনের কথা বলবেন দিল উজাড় করে। খুনসুটি করবেন। এক চিমটি ঝগড়া করবেন, একটুখানি তর্ক করবেন, মান-অভিমানে জড়াবেন, তারপর উথালপাথাল মহব্বতে মহব্বতে ওকে বেতাল করে তুলবেন। তমার সাথে তিনি এমনটিই করতেন। এখন তমা জীবনের গল্পে জনমের তরে দাড়ি-কমা বসিয়ে পরপারে চলে যাওয়ার পর তাঁর বুকের ভেতরের চরাচরকে মনে হয় মরুর মত ধূ ধূ বালিময়। নিঃসঙ্গতার দাবানল ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। তাতে পুড়ে পুড়ে তিনি খাক হন। এই অনলের ধকল সামলে উঠতে হলে দরকার একজন মনের মত সঙ্গীর।
দিলরুবাকে দেখে তাঁর বিশ্বাস জন্মেছে, সে-ই পারবে তাঁকে একাকীত্বের আন্দামান থেকে উদ্ধার করতে। তিনি তাকে একান্ত আপন করে পেতে উদগ্রীব। বুকের খাঁচায় বন্দী করে পোষ মানিয়ে ময়না পাখির মত তাকে আদর-আপ্যায়ন করতে চান। আর তার কটুড়েঘরে তিনি গড়তে চান চিরদিনের বসত। সত্যি বলতে কী, এখন তাঁর হয়েছে সেই মরণ দশা, যে দশায় মন বিগড়ে গেলে লোহার বেড় দিলেও থামে না।
তবে দিলরুবার দিল আছে কী নেই এ ব্যাপারে সৈয়দ সাহেব এখনও ঘোর অন্ধকারে। এমন মন উদাসী পাথর-মেয়ে তিনি দেখেননি আর একটিও। তিনি কোটি টাকার বিল দিতে প্রস্তুত আছেন যদি তার মতিগতি জানা যায়। ফোনে মাঝেমধ্যে কথা হয় বটে, তবে সেরকম অন্তরঙ্গ আলাপ কখনোই নয় যা দিয়ে তিনি তার মন-মহলের অন্দরে পৌঁছতে পারেন। সদর দরজায় দিলরুবা ঝুলিয়ে রেখেছে ইয়া বড় তালা যা হয়েছে সৈয়দ সাহেবের অন্তজ্বালার কারণ। তাঁর ঘুরঘুর এখনও মহলের চৌহদ্দীর বাইরে। ফেসবুকেও দুই একবার চ্যাটিং হয় অনেকটা হাই হ্যালো টাইপের। কী খবর, কেমন আছেন, কী করছেন, ভাত খেয়েছেন, কী রান্না হয়েছে আজ, আজ খুব গরম পড়েছে তাই না, আকাশে বসেনি আজ কোন তারার মেলা, বৃষ্টি হবে বোধ হয়- এই জাতীয় আপাত অদরকারি কথামালায় সীমাবদ্ধ তাঁদের খুদে আলাপ। সৈয়দ সাহেব ভিন্ন পথে হাঁটতে চাইলেও দিলরুবা থাকে বরফের মত শীতল, নির্বিকার। এড়িয়ে যায় অথবা। দিলরুবার জন্য তিনি তাঁর মহল রাখেন খোলা, অবারিত। ওর দিক থেকে তিনি ঠিক এরকমটিই প্রত্যাশা করেন। কিন্তু নিরাশ হন কপাট লাগানো দেখে। খুদের জাউ পায় না, ক্ষীরের জন্য কাঁদে- এই অবস্থায় পড়ে তিনি মিউমিউ করতে থাকেন মেনি বিড়ালের মত। তবে নাছোড়বান্দা তিনি। হাল ছাড়েন না। অনেক পোড় খাওয়া মানুষ বলেই হয়ত। লগি বৈঠা ধরে থাকেন শক্ত করে যতক্ষণ না তীরে ভিড়ে তরী।
দুর্দান্ত রোমান্টিকতায় সৈয়দ সাহেব ভরিয়ে রাখতেন তাঁর স্ত্রী তমার শরীর ও মন। যৌবনে যেমন মধ্যবয়সেও তেমনি। দুরন্ত ভালবাসা বসতি গড়েছিল তাঁদের দাম্পত্য জীবনে। যেমন তমা সমাদ্দার তেমনি তাঁর সৈয়দ ভাতার। দুজন দুজনকে ছাড়া বুঝতেন না আর কিছু, অন্য কারো দিকে নজর দেননি কখনোই। ‘বউ তুমি কেঁদো না কেঁদো না, চাল চিবিয়ে খাব আমি রেধোঁ না রেধোঁ না’- এই বচনে একজন রতির জন্য তার পতির যতটা রতি রাগ আসক্তি লুকিয়ে আছে বলে ধারণা করা হয় ঠিক ততটাই তমার জন্য জমা ছিল সৈয়দ সাহেবের হৃৎকমলের পাপড়ির তলে। তিনি চিন্তা-দুশ্চিন্তায় তালপাতার সেপাইয়ের মত রোগা পাতলা হয়ে গিয়েছিলেন যখন তমা কঠিন রোগে পড়ে বিছানা নেন এবং দীর্ঘদিন এভাবে দিন গুজরান করে অচিনলোকে পাড়ি জমান একা একা। স্ত্রীবিয়োগের দুইদিন পূর্বে এক একান্ত মুহূর্তে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে তিনি তাঁকে কথা দিয়েছিলেন হাতে হাত রেখে চোখে চোখ রেখে, তাঁর স্মৃতি বুকে নিয়েই তিনি কাটিয়ে দেবেন জীবনের বাকী দিনগুলো, রূপনদী আর শুকপাখিকে দেখাবেন কাচকলা ও মূলো।
ওয়াদামত কেটে যাচ্ছিল সৈয়দ সাহেবের সঙ্গীহীন অরঙিন সময়, রচিত হচ্ছিল তাঁর করুণ রসে ভরা নিঃসঙ্গতার গল্প। হয়ত নিরানন্দলোকের সাদামাটা পথই তিনি মাড়িয়ে যেতেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যদি না দেখা পেতেন দিলরুবার কোন এক কমিউনিটি সেন্টারে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে। আটপৌরে সাজগোজে ওকে দেখেই ঝড়ো বেগে নাড়া পড়ে গিয়েছিল তাঁর মনোগাঙের বহুদিনের শ্যাওলা পড়া থিতানো পানিতে। তাঁর সর্বাঙ্গ উন্মুখ হয়ে চেয়েছিল ওর দিকে। দশা এই, কী যেন দেখলুম আহা, কী যেন পেলুম। তারপর থেকে প্রতিনিয়ত পঞ্চবাণে দগ্ধ হয়েছেন সৈয়দ সাহেব। তাঁর পাথরচাপা দিয়ে রাখা একাকীত্ব চাঙ্গা ভাব নিয়ে জেগে উঠে প্রতিরাতে, দিবালোকে ব্যস্ততার ফাঁকে অবসর সময়গুলোতে। দিলরুবার কথা ভাবতে বসলে নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত হয়ে পড়েন তিনি, আবার ভালও লাগে। মন কেমন যেন আনচান আনচান করতে থাকে। ওকে নিয়ে উড়াল দিতে ইচ্ছে করে বুঝি ওই দূর আকাশে মেঘের দেশে। আউলা বাতাসে তিরতির করে কেঁপে উঠে শরীর মন যেমন করে মৃদুমন্দ দখিনা হাওয়ায় হালকা চালে দুলতে থাকে গাছের পাতা গুল্মলতা। প্রেমের জোশ ও জৌলুশে উদ্দীপিত মনের পাঁচ বছরের জমে থাকা নিঃসঙ্গতার কষ্ট যেন মুছে যেতে থাকে একটু একটু করে। তাঁর মনে হয়, বাউল হয়ে যাওয়া ঢের ভাল এরকম সঙ্গীহীন থাকার চেয়ে। তাঁর একজন সঙ্গী দরকার। হ্যাঁ দরকার। ‘ক্ষমা করে দিও তমা, প্রিয়তমা আমার,’একান্ত সঙ্গোপনে এমনভাবে সৈয়দ সাহেব কথাগুলো আওড়ান যেন নিজের কাছ থেকে আপনাকেই করতে চান আড়াল,‘ওকে দেখার পর মন পবনের নাও কখন যে চওড়া করে পাল তুলে দিয়েছে টেরই পাইনি। দোহাই লাগে, কিছু মনে করো না, প্লীজ। ভেবো না যে, ওর রূপ তোমার থেকে অপরূপ। রূপে তুমি ছিলে আমার আফ্রোদিতি, গুণে হেলেন। তোমার সাথে ওর কোন তুলনাই হয় না। হতে পারে না। যদি হয় হবে প্রতিতুলনা। যেমন টিয়া পাখিও পাখি, আবার ঈগল পাখিও পাখি। আসলে ইয়ে মানে…..।’, যুৎসই কথা খটুজে না পেয়ে আমতা আমতা করতে থাকেন নূতন প্রেমের কাদা জল গায়ে মাখা চিরসবুজ সৈয়দ আকবর হোসেন। জঙ্গমে ও সঙ্গমে প্রবীণত্বের জরা এখনও তাঁকে ছটুতে পারেনি। প্রায় নবীনের মতই তিনি দুর্দান্ত গতিতে পান করছেন প্রেমের ঘোল। এই উৎকট ঘোলই দুগ্ধ হয়ে পুষ্টি বিলোচ্ছে তাঁর দেহ-মন-হৃদয়ে। তিতা করলা খেলেও মনে হয় হালুয়া চিবুচ্ছেন।

দিলরুবা ভেবেছিল, অনেক তো হল। যা হওয়ার কথা ছিল তা হল, যা ঘটবে না বলে আশা করেছিল তাও ঘটল। এবার বৈরাগ্য সাধনেই মিলবে আসল মুক্তি। বিবাগী মন আর হবে না উচাটন। বোধ হবে উন্মুল, বোধন হবে অনিকেত। মনে করি করি করি, কিন্তু হয় হয় হয় না। মনের নাচন শুরু হয়েছে ধিঙ্গি মেয়ের মতন। বিষয় রোগে আবার যার-পর-নাই পেয়ে বসেছে তাকে। জাপটে ধরেছে সজোরে, ঠোকর মারছে, দংশন করছে। দীর্ঘ প্রায় এক বছরের সাধনা, সব কর্ম হবে নট। মন পুনর্বার ছুটছে মোহের কাছে মায়ার পাছে। ‘বারে বারে করি মানা, লীলার দেশে আর যেওনা’- বললেই কি মন শুনে বারণ? দীর্ঘদিনের ক্ষুধায় কাতর দেহও করছে বিদ্রোহ। এসব নষ্টের মূলে আছেন চব্বিশ গিয়ে চল্লিশ পেরিয়ে ষাট বৎসরে যৌবনপ্রাপ্ত সৈয়দ আকবর হোসেন। তিনি করছেন সবকিছু তছনছ। উস্কে দিচ্ছেন আরব বসন্তের মত স্ফুলিঙ্গ জাতীয় একটা কিছু।
আরব বসন্ত মার খেয়েছে, সিসিদের বুটের তলায় পড়ে হয়েছে পিষ্ট। কিন্তু দিলরুবা একটু ছাড় দিলেই বোধ করি তার জীবনে আবার ফিরে আসবে আগুন লাগা ফাগুন। পাখি ডাকবে, ফুল ফুটবে, চারদিক ম ম করবে মনকাড়া আ¤্রমুকুলের গন্ধে। কোকিলের কুহুতানে পেলেও পেয়ে যেতে পারে জীবনের অন্য একটা মানে।
মন যা চায় না, মন যা লয় না তাই হয়। সুদীর্ঘ বিশ বছরের সংসার যাপন থেকে দিলরুবার প্রাপ্তি মোটেমাটে ক‚ন্য, এ্যা বিগ জিরো। না ধন মিলেছে, না জন। কোলের বোল না ফোটায় এক‚ল ওক‚ল গেল দু’ক‚লই। তারপর একদিন যখন আড়াল সরিয়ে দৃশ্যপটে এসে হাজির হল তার পোয়াতি সতীন, তখন মনে হয়েছিল,‘এই যে লাঠি ভালকে বাঁশের, আমার বাপের বাবার হাতের’ বলে সমস্ত শক্তি জড়ো করে কেউ বুঝি তাকে আঘাত করেছে প্রচন্ডভাবে। বাকপ্রতিবন্ধী হয়ে গিয়েছিল সে কিছু সময়ের জন্য। লোপ পেয়েছিল চেতনা। ঠায় দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ হা করে চিত্রার্পিতের মতন। জ্ঞান ফিরে এলে ভেঙ্গে পড়েছিল কান্নায়। আহারে, সে কী কান্না! অঝোর কান্না যাকে বলে। চোখের পানিতে নাকের পানিতে ভেসে গিয়েছিল চোখ-মুখ-বুক সব। এক পর্যায়ে দিলরুবার মনে হল, অশ্রূর ফোঁটাসমূহ কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ির মত টকটকে লাল। বুঝতে পারল, এ হল ছুরি দিয়ে কুচি কুচি করে কাটার ফলে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। সেটাই অশ্রু হয়ে দরদর করে বের হয়ে আসছে চোখের ক‚ল ছাপিয়ে। কান্না বন্ধ করে কিছুক্ষণ অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকে দিলরুবা। তারপর হঠাৎ উপস্থিত সকলের কান ঝালাপালা করে গগণবিদারী চিৎকার দিয়ে সত্যি সত্যি জ্ঞান হারায় সে উচ্চন্ড ভয় আর আতংকে।
সেই ক্ষোভ থেকে সে খুব করে সিদ্ধান্ত নেয়, অনেক হয়েছে, আর নয়। এই দুনিয়া মায়া রঙ ঢঙ তামাশা বিলাস সব যাক দূর অস্ত। বিজন বনে বাউলি প্রান্তরে সে যাপন করবে একাকী জীবন। আর কারো ঠাঁই হবে না সেখানে। কখনও না। কস্মিনকালেও না। নেভার এভার।
ইস্পাত-কঠিন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সেই দিলরুবাই এখন গলে গলে পড়ছে মোমের মত। দেহ ও মনে জোর টান অনুভব করছে মদন-জোশপ্রাপ্ত ধনপতি সৈয়দ আকবর হোসেনের জন্য, ষাটেও যিনি পঁয়তাল্লিশ এবং চলনে-বলনে দৃষ্টিনন্দনরূপে ব্যাপক পৌরুষদীপ্ত। এই দুইয়ের সম্মিলিত টানে বানের জলের মত ভেসে যায় সে। তাঁর বিপদ আশংকায় উদ্বিগ্ন হয় খু..উ..ব। বুক উঠানামা করে দ্রুত লয়ে। ধড়ফড় ধড়ফড় করে। বন্ধ হয়ে আসতে চায় নিঃশ্বাস।
ঠগি এসে বগির গলে দিয়ে গেল ফাঁস। আর তাতেই হৃদয়ের আগল খুলে গেছে, বইতে শুরু করেছে প্রেমের ফোয়ারা- বুঝতে পারছে দিলরুবা। কারণ সে যা স্পর্শ করছে তাই সোনা হয়ে যাচ্ছে না বটে, কিন্তু সোনা লাভের অনুভূতি হচ্ছে। প্রতি পরশে সরস মাত্রা যোগ হচ্ছে যাপিত সময়গুলোতে। বর্ণহীনও এখন হয়ে উঠে রং-রূপ-রসে বাঙময়। হররোজ ঘন ঘোর বরিষাকেও মনে হয় না একঘেয়ে, ক্লান্তিকর। বরং ইচ্ছে করে বাদল বরষায় খুশিমত ভিজে জবজব হতে রোজ রোজ। তখন সে গাইবে গান গলা ছেড়ে, কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে।
সবকিছুই চলে আপন ধর্ম অনুযায়ী, দিলরুবার নয়া উপলব্ধি। অধর্মের বেড়া দিয়ে একে আটকে রাখা যায় না। সময় সুযোগ পেলে বেড়া ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে আপন পথ ধরে।
‘প্রহর শেষের রাঙা আলোয় সেদিন চৈত্রমাস, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।’,কবির বচন মনে করে মরমে মরে যায় দিলরুবা। লজ্জায় আরও রাঙ্গা হয় তার রঙ্গভরা অঙ্গ।
‘সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র মনুষ্য প্রজাতির প্রাণী! কী নকশাদার মানুষের মন!’, আপন মনে বলে উঠে দিলরুবা।

‘ তুই বুঝবি না, আমি ঠিক পথেই এগুচ্ছি, মাথাও খারাপ হয়নি।’
‘কিন্তু বুবু….।’
‘মেয়েদের একান্ত নিজস্ব কিছু না থাকলে সমাজে তাদের দাম থাকে না রে। সিদ্ধান্ত যেটা নিয়েছি তাতে আমার যেমন উপকার হবে লাভ হবে তোরও। মন খারাপ করিস না ভাই।’
ভাইকে কতটুকুই বা বলা যায়? দেহ যখন বিদ্রোহ করে, মনও যোগ দেয় ওই পক্ষে তখন আর কিছুই করার থাকে না। তাড়নাটা এতদিন ঘুমিয়ে ছিল, কঠোর শাসন আর সংযমে দিলরুবা একে একঘরে করে রেখেছিল। এখন সৈয়দ সাপুড়ে এসে বেদম বাঁশি বাজিয়ে এক বের করে এনেছে ঘুমন্তপুরী থেকে। তাকে আর পায় কে? ক্ষুধাতুর সিংহের মত চারদিক দাবড়ে বেড়াচ্ছে একটু সুযোগ পেলেই।
স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্সের পর একমাত্র ভাইটার সংসারে এসে আশ্রয় নিয়েছে দিলরুবা। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা যাওয়ার পর একেই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে সে। সেই আদরের ছোট ভাইয়ের আলাদা একটা জগৎ আছে, সংসার হয়েছে। ছেলেপুলে হয়েছে। তবুও ভাই তাকে দূরে ঠেলে দেয়নি। তার নির্ঝঞ্জাট সংসারে উপদ্রব মনে করেনি। কিন্তু ভাইয়ের বউ ব্যাপারটা ভালভাবে নেয়নি। অবশ্য মুখ ফুটে কিছু বলেওনি আবার। কিন্তু মুখে কুলুপ এঁটে থাকবে কতদিন? অশান্তি শুরু হওয়ার আগেই তাই কেটে পড়া ভাল। সুযোগ যেহেতু একটা পাওয়া গেছে লুফে নেয়াই হবে দূরদর্শিতার পরিচয়। হাতছাড়া করলে আখেরে পস্তাতে হবে। তাছাড়া সৈয়দ সাহেব, যতটুকু মনে হয়েছে, ভাল মানুষ। তার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ প্রেমিক। রোমান্টিক সুপুরুষ। রস-কষ আছে মনে। আছে অঢেল পয়সা-কড়ি যা শীতে গাইবে উষ্ণতার গীত এবং গরমে যার শীতল পরশে গীতল হবে পরিবেশ। উহ্্, ভাবতেই অদ্ভূত শিহরণ খেলছে মনে যা যৌন উদ্দীপনার চেয়েও কম রোমাঞ্চকর নয়। দ্বিতীয় সংসার যদিও, সে অসুখী হবে না ধরে নেয়া যেতেই পারে।
দিলরুবা মনে করে, ভবের বাজারে তার পরিভ্রমণ শেষ হয়নি। সদাই করার এখনও অনেক কিছু বাকী। এগুলো বাদ দিয়ে রঙ্গরস পরিহার করে সন্যাসী জীবনযাপন করার কোন মানেই হয় না। তার বিশ্বাসের হয়েছে ইউ-টার্ন, ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়’।

গোসল সেরে বাথরুম থেকে বের হয়ে আসার পর দিলরুবার যে অনুভূতি হয় সে এক তুলনারহিত ব্যাপার। ভাবে, গত দুটো বছর ধরে সে এমন ফ্রেশ অনুভূতি থেকে বঞ্চিত ছিল। সে এক অন্ধকার সময় ছিল বটে। সবুজ লতার ধূসর জীবন। এখন সে বাঁচে হাফ ছেড়ে। তাছাড়া আরেকটা জিনিস তার চোখ এড়িয়ে যায়নি, কবুল বলার পর থেকে নিজেকে বেশ ওজনদার ওজনদার মনে হচ্ছে। ছিল সর্বহারা, আর এখন রূপকথার মত সর্বক‚লপ্লাবী প্রাপ্তি।
সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত বেশ খুশি ও সুখী দিলরুবা।
‘ওয়াও, যেন শিশিরভেজা টকটকে লাল বসরাই গোলাপ।’, বিছানায় আধশোয়া হয়ে মুগ্ধ চোখে সৈয়দ সাহেব অপলক চেয়ে থাকেন তাঁর নয়া জীবনসঙ্গীর দিকে। তাঁর এতদিনের চৈত্রের খরতাপে চিরে যাওয়া বুকে এখন বয়ে চলেছে বৃষ্টিভেজা হিমেল হাওয়া।
নয়া পতির মুখে নতুন বচন শুনে মূর্ছা যাবে যেন দিলরুবা। সর্বাঙ্গ করে উদ্বাহু নৃত্য। দেহের গহন কন্দরে হৃদয়ের বন্দরে কলকলিয়ে উঠে উচ্ছ্বাসের ঢেউ। তার চোখ ভিজে আসে খুশির আতিশয্যে। সেটা আড়াল করতেই দ্রুত লয়ে ব্যালকনির দিকে হাঁটা ধরে সে। এক পর্যায়ে চোখের পানি দরদর করে গড়িয়ে পড়ে গন্ডদেশ বেয়ে। সে বাঁধা দেয় না। মুখ ঠোঁট যখন অশ্রুজলের পরশ পায় নোনতা স্বাদে ভরে উঠে তার মন জীবন যৈবন। এই নোনতা তো নোনতা নয়, বড়ই মিষ্টি বড়ই মধুর।
তবে একটা খচখচানি তার মনের কোণে সেই যে গতদিন শুরু হয়েছে আজো তা দূর হয়নি। বিয়ের অনুষ্ঠানে সৈয়দ সাহেবের বড় ছেলে ও বড় মেয়ের পরিবারের কাউকেই দেখা যায়নি যদিও তিনি সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন এই দুজনকেই। এই দুই ক্ষ্যাপা বড় ধরণের কোন হ্যাপা সৃষ্টি করে কিনা কে জানে। শুভলগ্নে এসব কুভাবনাকে প্রশ্রয় দিতে চায়নি দিলরুবা। কিন্তু চাইলেই কি সব পারা যায় যেখানে নিজের প্রসারিত হাত গিয়ে পৌঁছায় না? শুধুমাত্র তখন ভূলেছিল ঝিম ধরা গভীর রাতে যখন চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছিল।
ঝুলবারান্দায় রেলিংয়ে ভর দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে দিলরুবা। ওর চোখে অশ্রু, বুকে স্বপ্ন, মনে শংকা। আর দৃষ্টি প্রসারিত বহুদূরে দূর আকাশের পানে। নীল আকাশের নিচে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা যায় অনেকটা। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ আকাশে গুড়–ম করে শব্দ হয় প্রকান্ড। বিজলী চমকায় ভয়ানক। ভয় ওকে জাপটে ধরে। সহসা ঋজু হয়ে দাঁড়ায় সে। তারপর দৌড়ে গিয়ে মুখ লুকোয় সৈয়দ সাহেবের চওড়া লোমশ বুকে। ভয় দূর হয়। পুলকের আবেশ ছড়িয়ে পড়ে দেহ ও মনে। বেশ অনুভব করে সে, ঝড় বাদল মেঘলা দিনে এই তার নিরাপদ আশ্রয়।
তবে স্বামীর বুকের উষ্ণতা পেয়েও এলিয়ে না পড়ে দিলরুবাকে একটু জেগে থাকতে হবে বৈকি, সে জানে। সাবধানের মার নেই। সতর্ক চোখে এগোতে হবে, চোখ কান খোলা রাখতে হবে। পঞ্চইন্দ্রিয়ের নিদ্রায় সময়যাপন করলে হবে না। কেউ দাঁও মারতে চাইলে প্রতিহত করতে হবে সর্বশক্তি দিয়ে। ঢাল সবসময় প্রস্তুত রাখতে হবে আত্মরক্ষার জন্য। আবার তলোয়ারও রাখতে হবে শাণ দিয়ে যেন সময়ের প্রয়োজনে আক্রমণ প্রতিআক্রমণে উদ্যত হওয়া যায়। কারণ এতদিনের মিথষ্ক্রিয়ায় তার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে, সৈয়দ সাহেব হচ্ছেন গল্পের সেই রাজার মত যিনি কোন এক দোষে একটা কচ্ছপকে শাস্তি দিতে চান। এজন্য এটাকে উল্টে দিতে বললেন যাতে চিৎ হয়ে রোদে পড়ে থাকে।
‘ভাল শাস্তিই হবে মহারাজ’, বলল চতুর কচ্ছপ, ‘এতে করে আমার পাকস্থলীতে রোদ লাগবে, আর অনেকদিন ধরে চলতে থাকা আমার হজমের সমস্যাটাও দূর হয়ে যাবে।’
‘তাহলে মারব চাবুক তোমার পিঠে।’ বললেন ক্রুদ্ধ রাজা।
‘ওহ কী মজা কী মজা, তাতে আরো শক্ত হবে আমার পিঠের ঢাল। কী মজা, কী মজা।’
হয়রান-পেরেশান হয়ে রাজা চেঁচিয়ে বললেন, ‘এই কে আছিস, বদমাসটাকে পানিতে ছটুড়ে মার। পানিতে ডুবেই ওর ভবলীলা সাঙ্গ হউক।’